কাজী নজরুল ইসলাম ‘সংকল্প’ কবিতায় বলেন, ‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’; তখন নজরুলকে মুঠোফোনের স্বপ্নদ্রষ্টা ভাবতে আমার বাঁধে না। দুঃখ একটাই, নজরুল ইঙ্গিতে মোবাইলের ভবিষ্যদ্বাণী করলেও নির্দিষ্ট করে ফেসবুক জাতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে কিছু বলে যেতে পারেননি।
মনে পড়ে, ঘরের পাশে বিশাল লম্বা তল্লা বাঁশ শূন্যের দিকে তুলে দেওয়া থাকত। আগায় বাঁধা থাকত অ্যান্টেনা। একজন বাঁশটা ধরে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে চেঁচিয়ে বলত, ‘কী রে আইছে? আইছে?’
ঘরের ভেতর থেকে জবাব আসত, ‘না, আসে নাই, এহনও ঝিরঝির।’
বাইরের জন ফের বাঁশ মোচড়াত। ভেতর থেকে আচমকা আওয়াজ আসত—‘আইছে! কিলিয়ার আইছে! আর নাড়াইস না।’
ঘরের ভেতর টিভিটার সাদাকালো মনিটরের দিকে সবগুলো চোখ হুমড়ি খেয়ে পড়ত। আশপাশের পনেরো কুড়ি বাড়ি থেকে আসা দর্শক গাদাগাদির মধ্যেই ফের ‘যুৎ করে’ সিনেমা দেখতে থাকত।
আশির দশকের পুরোটা এবং নব্বইয়ের শেষ নাগাদ মফস্বল শহরগুলোতে এই দৃশ্য ছিল নিত্যকার। বিটিভিতে মাসের মধ্যে যে একদিন ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ কিংবা ‘কাচের দেয়াল’ বা ‘সুতরাং’ বা এই ধরনের সিনেমা চলত, সেদিন দর্শকদের বসতে দেওয়ার জায়গা ঘরে হতো না। টিভি চলে আসত বারান্দায়। দর্শক চলে যেত হোগলার চাটাই কিংবা খেজুরের পাটিপাতা উঠোনে।
তখন একটাই টিভি। বিটিভি। সেখানে সাপ্তাহিক নাটক চলত। যেহেতু দ্বিতীয় কোনো চ্যানেল ছিল না, সেহেতু তুলনা করার সুযোগ ছিল না। সেখানে যা চলত, সেটাই আমাদের চোখে দুর্দান্ত জিনিস ছিল। একটা গৎবাঁধা সাংস্কৃতিক রুচির হাত ধরে আমরা চলছিলাম। তারপর প্রায় চার দশক কাটল। কালে কালে কত কী দেখলাম। একটার জায়গায় পনেরো কুড়িটা চ্যানেল হলো। সেখানে হাজার পদের নাটক হতে থাকল। বিটিভির যুগে প্রথমে মাসে একটা; তারপর সপ্তাহে একটা করে সিনেমা হতো। স্যাটেলাইট চ্যানেল এসে সিনেমার বন্যা বয়ে গেল। প্রতিদিন বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি—আরও কত ভাষার সিনেমা!
প্রতিদিন সকালে একটা আটার রুটির সঙ্গে একটা ডিম; আর রাতে এক পদের তরকারি দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে যে লোক অভ্যস্ত তার সামনে প্রতিদিন তিন বেলা মাছ-মাংস-ফলফলাদির দশ বারো পদের খাবার দিলে যে অবস্থা হয়, বিটিভি পার হওয়া স্যাটেলাইট চ্যানেল যুগের দর্শকদের তাই হলো। দর্শকের রুচি বদলাতে লাগল। বিটিভির প্রায় সব নাটকে মধ্যবিত্ত চরিত্রগুলো টাইপ করা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলত। কিন্তু বারোয়ারি চ্যানেলের যুগে সেই চরিত্রগুলো ‘যাইতাছি, খাইতাছি’ বলা শুরু করল।
সন্ধ্যার পর মূলত মা-খালাদের (বাবা খালুরাসহ) টিভি সিরিয়ালে আসক্তি বাড়ল। রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে এ চ্যানেল থেকে সে চ্যানেলে যাওয়া আসা শুরু হলো।
এরপরই বিদ্রোহী কবির ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করে দিয়ে ইন্টারনেটের হাত ধরে লোকের হাতের মুঠোয় ‘বিশ্বজগৎ’ চলে এল। নেটফ্লিক্স থেকে ফেসবুক। টিকটক থেকে রিল। এখন আর ঘটনার পর ঘণ্টা ধরে সিরিয়াল দেখায় সুখ নেই। এখন মানুষের রুচি আরও বদলে গেছে।
বাদাম বেচতে গিয়ে মুখে মুখে বানানো গানও এখানে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। একটা লোকের একটা অট্টহাসির ভিডিওই তাঁকে রাতারাতি সেলিব্রেটি বানিয়ে দিতে পারে। এটি যে কারও আত্মপ্রকাশের অবাধ পরিসর। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যে নিঃশব্দ সমাজবিপ্লব ঘটে গেছে তা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা মুরুব্বিরা বিপদে পড়েছেন।
হাওর বাঁওড়ের দেশি কই পেলে লোকে যেমন ওষুধ বিষুধ খাইয়ে খামারে চাষ করা থাই কই খায় না; তেমনি ফেসবুকে প্রতিদিনকার জীবনের কাঁচা বা ‘র’ দৃশ্য পেয়ে লোকের আর ‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের’ কনটেন্ট আর আগের মতো ভালো লাগে না। এখানে সাধারণ মানুষই খবর, সাধারণ মানুষই বিনোদন। এখানে যিনি মতামত দিচ্ছেন, শুনছেন তিনিই। ‘আমরা সবাই রাজা’ টাইপের এই পরিসর চব্বিশ ঘণ্টার চ্যানেলের মতোই সাধারণ মানুষের আত্ম-অভিব্যক্তির একটি বর্ণিল বিচিত্রানুষ্ঠান।
এখানে অসংখ্য মানুষ একই সঙ্গে কিছু বলছেন বা করছেন, সেই মানুষই সেকেন্ডের মধ্যে ভূমিকা পাল্টে শুনছেন ও দেখছেন, মতামত দিচ্ছেন, অন্য শ্রোতা ও দর্শকের সঙ্গে মত বিনিময় করছেন। দিন শেষে ব্যাপারটা জমল কি জমল না, তার ব্যাপারে একটা জনমত তৈরি হচ্ছে।
বাদাম বেচতে গিয়ে মুখে মুখে বানানো গানও এখানে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। একটা লোকের একটা অট্টহাসির ভিডিওই তাঁকে রাতারাতি সেলিব্রেটি বানিয়ে দিতে পারে। এটি যে কারও আত্মপ্রকাশের অবাধ পরিসর। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যে নিঃশব্দ সমাজবিপ্লব ঘটে গেছে তা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা মুরুব্বিরা বিপদে পড়েছেন।
সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা, যে যোগাযোগ মাধ্যমের নামের সঙ্গে ‘সামাজিক’ শব্দটি জড়িত, সেটিই অনেক সময় অসামাজিক কাজের অস্ত্র হয়ে উঠছে। কাউকে ছোট করার জন্য তার ছোটখাটো ত্রুটিকেও ফেসবুকে বড় করে তুলে দেওয়া হচ্ছে। লোকে সত্যাসত্য যাচাই ছাড়াই তা বিশ্বাস করছে। যেহেতু এখন ‘র’ কনটেন্টের কাটতি বেশি, সেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই আপাত-সর্বময় বিশ্বাসযোগ্যতার ঘরে সিঁধ কেটে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কুমতলব ঢুকে পড়ছে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]