ম্যাজিশিয়ান মোদির শ্রেষ্ঠ মায়াজাল

নরেন্দ্র মোদি

কর্ণাটক হারানোর পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুব একটা নিশ্চিন্তে ছিলেন না। কংগ্রেসের মাথাচাড়া দেওয়া, বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠন, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের ক্রমাগত ঝাপটার মধ্যে উটকো বিপত্তি হিসেবে হাজির হয় কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের অভূতপূর্ব জোড়া অভিযোগ। এ অবস্থার মধ্যে বসন্ত সমীরণ হয়ে হাজির মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের বিজয়-আখ্যান। নরেন্দ্র মোদির কাছে বছরের শেষটা এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতো না।

এই আবেশে মাখামাখি হয়ে তিনি নতুন বছরকে আবাহন করবেন। ২০২৪ তাঁর হ্যাটট্রিকের বছর। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই যে তৃতীয়বার শপথ নেবেন, সেই আগাম ঘোষণা মোদি করে দিয়েছেন। নিজের ক্ষমতার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা না থাকলে এমন বজ্র নির্ঘোষ সম্ভবপর নয়।

এই তিন রাজ্যের ফল, সত্যি বলতে কী, সবার সব হিসাব গুলিয়ে দিয়েছে। রাজনীতির প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, পণ্ডিতদের ভুল প্রতিপন্ন করে তিন রাজ্যেই বিজেপি বিজয় ধ্বজা উড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রাক্‌–নির্বাচনী জরিপগুলোয় চোখ বোলাচ্ছিলাম। কেউ বলেনি বিজেপি তিন রাজ্যেই কংগ্রেসকে বেবাক করে দেবে! ভোট–পরবর্তী বুথফেরত সমীক্ষাগুলোতেও চোখ বোলাচ্ছিলাম। প্রতিটি সমীক্ষক দল ছত্তিশগড় দিয়েছে কংগ্রেসকে। ৯টির মধ্যে পাঁচ সমীক্ষক মধ্যপ্রদেশে বিজেপির জয় দেখেছিল, চারজন বলেছিল কংগ্রেসের পাল্লা ভারী।

রাজস্থান নিয়ে সবাই বলেছিল, লড়াই সমানে সমানে, যদিও বিজেপি সামান্য এগিয়ে। অথচ গণনা কী দেখাল? তিন রাজ্যেই কংগ্রেস হেঁটমুন্ড! বিজেপি জিতল ছেলেখেলা করে! মধ্যপ্রদেশে দুই–তৃতীয়াংশ ভোটে, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসকে নাস্তানাবুদ করে, রাজস্থানে সম্মানের সঙ্গে। ভোট রাজনীতির এমন অ্যান্টি–ক্লাইম্যাক্স সমকালীন ভারতে অদৃশ্যপূর্ব! ম্যাজিশিয়ান মোদির এটাই সম্ভবত ইদানীংকালের শ্রেষ্ঠ মায়াজাল!

বিস্ময়কর বিহ্বলতায় কংগ্রেস আচ্ছন্ন। অন্যরাও। মায়াবতী বলেছেন, তিন রাজ্যের এই ফল একপেশে, মানা কঠিন, মানুষের মনে সন্দেহ জাগাবে। বিধ্বস্ত কংগ্রেসিদের কারও কারও মন্তব্যেও সেই ইঙ্গিত। যেমন মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং। তিরটা ইভিএম কারচুপির দিকে ধাবিত। যদিও মুখে বলছেন, সবকিছু আরও খতিয়ে দেখতে হবে।

বিস্ময়কর বিহ্বলতায় কংগ্রেস আচ্ছন্ন। অন্যরাও। মায়াবতী বলেছেন, তিন রাজ্যের এই ফল একপেশে, মানা কঠিন, মানুষের মনে সন্দেহ জাগাবে। বিধ্বস্ত কংগ্রেসিদের কারও কারও মন্তব্যেও সেই ইঙ্গিত। যেমন মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং। তিরটা ইভিএম কারচুপির দিকে ধাবিত। যদিও মুখে বলছেন, সবকিছু আরও খতিয়ে দেখতে হবে।

হেঁয়ালি সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রদেশেই। কেননা, সেখানে বিজেপির ভোট বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ! সর্বকালীন রেকর্ড! কংগ্রেসের কমলনাথের দেড় বছরের সংক্ষিপ্ত শাসন বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে সাড়ে আঠারো বছর সেখানে বিজেপি ক্ষমতায়।

মুখ্যমন্ত্রী এক ও অদ্বিতীয় শিবরাজ সিং চৌহান। তাঁর বিকল্প সন্ধানে মোদি এবার দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। তাই প্রচারে তাঁকে আমল দেননি। রাজ্যটা ধরে রাখতে তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসহ সাত সংসদ সদস্যকে বিধানসভায় ভোট লড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই রাজ্যে বিজেপি যে সাড়ে ৭ শতাংশ ভোট বাড়তি পেয়ে রেকর্ড গড়তে চলেছে, তার কোনো আন্দাজই কোনো রাজনৈতিক পণ্ডিতই পেলেন না! এমনকি মোদি অনুগত গোদি মিডিয়াও নয়! এটাই ঘোরতর বিস্ময়!

ভোট–বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব যথার্থই বলেছেন, ‘ঘুষঘুষে জ্বর ধরতে গেলে থার্মোমিটার লাগে। ১০৪ ডিগ্রি জ্বরের আন্দাজ কপালে আঙুল ছোঁয়ালেই মালুম হয়। মধ্যপ্রদেশে সাড়ে ৭ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি ধুম জ্বরেরই শামিল। অথচ কেউ তার হদিস দিতে পারল না!’

আরও পড়ুন

বিস্ময় আছে আরও। আগের তুলনায় তিন রাজ্যের কোথাও কংগ্রেসের ভোট শেয়ার কিন্তু মারাত্মকভাবে কমেনি। মধ্যপ্রদেশে গতবার কংগ্রেস পেয়েছিল ৪০ দশমিক ৮৯ শতাংশ ভোট, এবার ৪০ দশমিক ৪০ শতাংশ। রাজস্থানে পেয়েছিল ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, এবার ৩৯ দশমিক ৩০। ছত্তিশগড়ে পেয়েছিল ৪৩ শতাংশ, এবার ৪২ দশমিক ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রবল হাওয়া সেই অর্থে কোনো রাজ্যেই ছিল না। অথচ মোদি ভেলকি দেখিয়ে গেলেন!

তিন হিন্দিভাষী রাজ্য ছাড়া ভোট হয়েছিল দাক্ষিণাত্যের তেলেঙ্গানা ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের মিজোরামেও। তেলেঙ্গানা কংগ্রেসের সান্ত্বনা পুরস্কার। জয়ও কৃতিত্বপূর্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই জয় আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে। বিজেপিকে হারিয়ে নয়; বরং বিজেপি সেখানে শক্তি বাড়িয়েছে। গতবার একটি আসন জিতেছিল। এবার আটটি। মিজোরামেও বিজেপির আসন ১ থেকে বেড়ে ২ হয়েছে, কংগ্রেসের ৪ থেকে কমে ১। সেখানে মাথা তুলেছে নতুন আঞ্চলিক শক্তি।

গত বছর হিমাচল প্রদেশ ও এ বছর কর্ণাটক জয়ের পর কংগ্রেস ভাবছিল মোদির বিজয়রথ রোখার ফর্মুলা তারা পেয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে সেই ভাবনা ভুল ছিল। সত্য এই, গো বলয়ে মোদিকে থামানোর ‘ক্লু’ কংগ্রেস এখনো খুঁজে পায়নি। গরিবের হাতে কাজ পকেটে নগদ, নারীর হাতে মাসোয়ারা ও বিনা ভাড়ায় সরকারি বাহনে চড়ার অধিকার, সস্তায় রান্নার গ্যাস, শিক্ষিত বেকারদের মাসিক ভাতা, সরকারি কর্মীদের জন্য পুরোনো পেনশন স্কিম চালু, ‘মোদি-আদানি অনাচার প্রসঙ্গ’ এমনকি জাত গণনার অঙ্গীকারেরও চিড়ে ভিজল না! শেষ হাসি মোদিই হাসলেন। বিরোধীদের জন্য রেখে গেলেন একরাশ উদ্বেগ।

আরও পড়ুন

উত্তর ভারতের হিন্দি হৃদয়পুরে মোদি-রহস্যের উদ্‌ঘাটন ১০ বছরেও হলো না। এটা অপারগতা হলে বিরোধীদের অপরাধ হলো সম্মিলিত মোকাবিলার চেষ্টাটাই না করা। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দায় ৯০ শতাংশ। ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরির প্রধান উদ্যোগী হয়েও তারা এই ভোটে জোট শরিকদের চরম অবহেলা করেছে। মধ্যপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশকে অসম্মান করেছে। রাজস্থান ও তেলেঙ্গানায় সিপিএম ও ভারতীয় আদিবাসী পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করেনি। তা না করায় রাজস্থানে হারাতে হয়েছে অন্তত ১৫টি আসন।

কংগ্রেস ভেবেছিল, ছত্তিশগড় দখলে রাখবে ও মধ্যপ্রদেশ ছিনিয়ে নেবে। রাজস্থানে সরকার বদলের রীতি-রেওয়াজ বহাল থাকলেও বিজেপির ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে। ভেবেছিল, তেলেঙ্গানা জিতে স্কোর ৩-১ করলে লোকসভা ভোটে ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের কাছ থেকে বাড়তি আসন পেতে পারবে। এই ওপরচালাকি ও টেক্কা দেওয়ার মানসিকতা কংগ্রেসকে নতজানু হতে বাধ্য করবে। লোকসভা ভোটে জোট শরিকদের দাবি অন্যায্য হলেও মানা ছাড়া অন্য উপায় থাকবে না।

বিজেপির আর্যাবর্ত জয় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের হুঁশ ফেরালে লোকসভা ভোটে মোদি-মোকাবিলার আশাটুকু অন্তত জেগে থাকবে। একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিতে পারলে খেলাটা ঘুরলেও ঘুরতে পারে।

অঙ্কটা এই রকম, দাক্ষিণাত্যের ১৩০ আসনে ‘ইন্ডিয়া’রই রমরমা। ঠিক যেমন উত্তর প্রদেশ (৮০), উত্তরাখন্ড (৫), হরিয়ানা (১০), দিল্লি (৭), মধ্যপ্রদেশ (২৯), রাজস্থান (২৫), ছত্তিশগড় (১১), গুজরাট (২৬), ওডিশা (২১) ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের (২৫) মোট ২৩৯ আসন বিজেপি ও তার সঙ্গীদের দিকে ঝুঁকে আছে। যে চার রাজ্যে ভোট হলো সেখানে মোট আসন ৮২। এর মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৬৬টি। এখানে তাদের আসন বাড়ানোর সুযোগ নেই। জোটবদ্ধ ‘ইন্ডিয়া’ ঠিকঠাক চাল দিলে বরং কমবে।

একইভাবে পাঞ্জাব (১৩), হিমাচল প্রদেশ (৪), জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ (৬) ও মহারাষ্ট্রের (৪৮) মোট ৭১ আসনে ‘ইন্ডিয়া’ বিজেপিকে রুখে দিতে পারে। বাকি থাকে পশ্চিমবঙ্গ (৪২), বিহার (৪০), ঝাড়খন্ড (১৪), তেলেঙ্গানা (১৭) ও অন্ধ্র প্রদেশের (২৫) মোট ১৩৮টি আসন। ‘ইন্ডিয়া’ এখানে কোমর কষে নামলে ২০২৪–এর লড়াই আর যা–ই হোক একপেশে হবে না।

এটা নিছকই পাটিগণিত। ১০ বছর রাজত্ব সত্ত্বেও মোদি-রসায়নই কিন্তু বারবার কেল্লা ফতে করছে। এবারের ফলও সেটাই দেখাল!

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি