তেলের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং ও ভর্তুকির কথা

সারা দেশে এখন বিপুল বিক্রমে লোডশেডিং চলছে। আসলে এর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে আগেই এবং বহু অঞ্চল আগে থেকেই এ সমস্যায় ভুগছিল। আমি রাজধানী শহরে থাকি। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সরকারি উচ্ছ্বাসে হাতিরঝিলে যেদিন আতশবাজি উৎসব হলো, দূর থেকেও তা আমার চোখে এসে পড়েছে। কারণ, আমাদের বাসায় তখন বিদ্যুৎ ছিল না। শতভাগ কেন, সরকারের দাবি অনুযায়ী, চাহিদার তুলনায় দুই শত ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার হিসাবের মধ্যেও এ রকম দিন বাসায় আমি কমই পেয়েছি, যেদিন কমপক্ষে দু–তিনবার বিদ্যুৎ যায়নি। ঢাকার বাইরে বহু জায়গায় পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। এগুলো তখন সংবাদমাধ্যমে আসেনি, সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এখন এর ব্যাপকতা বাড়ায় সরকারও তার ‘অস্বীকারের স্বভাব’ রক্ষা করতে পারছে না। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে শুরু হয়েছে দেশব্যাপী লোডশেডিং।

সরকারের লোকজন বিদ্যুৎ–সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কারণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এটা ঠিক যে এর কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-এলএনজির দাম বাড়ছে, জোগানব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। কিন্তু এর কারণে যে আমরা বিপদে পড়ছি, তা কি অনিবার্য ছিল? বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল–এলএনজি আমদানি করতেই হবে আমাদের? আর কোনো বিকল্প নেই, ছিল না? জি ছিল। আসলে বর্তমান বিদ্যুৎ–সংকট, বিদ্যুৎ খাতে ক্রমবর্ধমান হারে ভর্তুকি, ঋণনির্ভরতা, রামপাল, রূপপুরসহ বিদ্যুতের নামে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি ও দেশের জন্য বিপজ্জনক প্রকল্প গ্রহণ এ সবকিছুই এই খাত নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা ও এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রণীত দায়মুক্তি আইনের ফলাফল।

জাপান প্রণীত সরকারের এই মহাপরিকল্পনায় নিজেদের গ্যাস উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি, কয়লা ও পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণের পথ তৈরি করা হয়েছে। সর্বোপরি জ্বালানি সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সক্ষমতার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এদিকে রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ এসব অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি রক্ষায় বারবার দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এভাবে গৃহীত সব প্রকল্প দেশি কিছু গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির জন্য উচ্চ লাভজনক হলেও দেশের জন্য আর্থিক ও পরিবেশগত মহাবিপদ তৈরি করেছে।

এর বিপরীতে আমরা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে যে মহাপরিকল্পনা (২০১৭-২০৪১) প্রস্তাব করেছিলাম, তাতে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল জ্বালানি সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সক্ষমতার ওপর। একদিকে নিজেদের গ্যাস, অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি—এই দুইয়ের মিশ্রণে ২০২১-২০৩১-২০৪১ তিন পর্বে ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরির প্রস্তার ছিল আমাদের। এতে কোনো ঋণনির্ভরতা, আমদানি বা নির্ভরশীলতা দরকার হতো না, বিদ্যুতের জন্য সুন্দরবন বিনাশ, কয়লা বা পারমাণবিক মহাবিপদের দরকার হতো না। জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় দেশের শিক্ষাজগৎও নতুন মাত্রায় যেতে পারত, বিদ্যুতের দামও ক্রমে কমে আসত। কিন্তু দেশি–বিদেশি স্বার্থান্বেষী চক্র এই পথে যেতে রাজি হয়নি। কারণ, এতে অতি মুনাফা নেই, বড় কমিশন নেই।

গত কিছুদিনে অর্থনীতির সংকটের কথা বলে বিশ্বব্যাংকের কাছে সরকার ঋণপ্রার্থনা করেছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, এডিবির কাছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা এবং আইএমএফের কাছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে বহুরকম শৃঙ্খলে দেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কাছে যে ঋণ প্রার্থনা করা হচ্ছে, তার চেয়ে কতিপয় বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীকে সরকার বসিয়ে বসিয়ে যে টাকা দিয়েছে, তার পরিমাণ বেশি। শুধু তাই নয়, ঋণখেলাপি আর মুছে ফেলা ঋণের যে টাকা কতিপয় গোষ্ঠী আত্মসাৎ করেছে, তার পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। দেশে তাহলে টাকার অভাব কোথায়? জনগণ এসবের বোঝা কেন ঘাড়ে নেবে?

বর্তমান সংকট এই যাত্রারই ছোট পরিণতি। এ যাত্রাপথ অব্যাহত থাকলে যে অনেক বড় সংকট ও বিপদ ক্রমাগত আসতে থাকবে, জ্বালানি তেলের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধি তার একটি নমুনা, যেখানে কোনো বিচার-বিবেচনা পর্যালোচনা ছাড়া ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের। পরিবহনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের দাম এমনিতেই বাড়তি ছিল। এখন তা আরও লাফিয়ে বাড়ছে। করোনায় আগে থেকেই সংকটগ্রস্ত মানুষ এখন দিশাহারা। অর্থনীতিও আক্রান্ত।

সরকারের ভাঙা যুক্তি—বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে, তাই নিরুপায় হয়ে বাড়াতে হচ্ছে। কথাটা ভুল। কারণ, এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী নয়, বরং নিম্নমুখী। দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে তেল আমদানিতে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সরকারি প্রধান তথ্যসূত্র বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২২ (জুন ২০২২–এ প্রকাশিত) বলছে উল্টো কথা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে কোনো ভর্তুকি দেয়নি। উপরন্তু এই সময়ে (২৩ মে ২০২২ পর্যন্ত) মোট মুনাফা করেছে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ পয়সা। গত কয়েক মাসে যে লোকসান হয়েছে, তার তুলনায় এই লাভ কয়েক গুণ বেশি। তার মানে সরকার জনস্বার্থ ও অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে লাভের টাকার একাংশ দিয়েই এই লোকসান ঠেকাতে পারত। তৃতীয়ত, দাম বাড়ালে যে ভয়াবহ পরিণতি হয়, সে কথা চিন্তা করে বহু দেশেই তেল আমদানির ওপর কর–শুল্ক প্রত্যাহার করে দাম কম রাখতে চেষ্টা করছে। সরকার সেটিও করেনি। চতুর্থত, বলা হয়েছে, অকটেন ও পেট্রল আমাদের কিনতে হয় না, দেশেই উদ্বৃত্ত হয়। তাহলে বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি কীভাবে আসতে পারে?

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতেই জনগণের ওপর আক্রমণ শেষ নয়। বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে সরকার বিপুল ভর্তুকি দিচ্ছে, এই ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। আইএমএফও তা–ই বলছে। কিন্তু সরকার বা আইএমএফ ভর্তুকির কারণ দূর করতে অনিচ্ছুক। কেন এই ভর্তুকি, কারা পাচ্ছে ভর্তুকির টাকা? এর কিছু উত্তর পাওয়া যাবে নিচের তথ্য থেকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের নামে সরকার গত ১১ বছরে (২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে ১২ কোম্পানির পকেটেই গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

জনগণকে বিদ্যুতের সুবিধা না দিয়ে বসিয়ে বসিয়ে দেশি–বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে, তার দায় কার? এ রকম পরিকল্পিত বাজে চুক্তি তো সরকারই করেছে। সরকারের লোকজন কত কমিশন পেয়ে এ রকম চুক্তি করেছে, তা তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। দায়টা অতএব তাঁদেরই নিতে হবে। গত কিছুদিনে অর্থনীতির সংকটের কথা বলে বিশ্বব্যাংকের কাছে সরকার ঋণপ্রার্থনা করেছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, এডিবির কাছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা এবং আইএমএফের কাছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে বহুরকম শৃঙ্খলে দেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কাছে যে ঋণ প্রার্থনা করা হচ্ছে, তার চেয়ে কতিপয় বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীকে সরকার বসিয়ে বসিয়ে যে টাকা দিয়েছে, তার পরিমাণ বেশি। শুধু তাই নয়, ঋণখেলাপি আর মুছে ফেলা ঋণের যে টাকা কতিপয় গোষ্ঠী আত্মসাৎ করেছে, তার পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। দেশে তাহলে টাকার অভাব কোথায়? জনগণ এসবের বোঝা কেন ঘাড়ে নেবে? জনগণের একমাত্র কাজ তো হওয়া উচিত তার জীবনসম্পদ হরণ করা এই লুটপাটকারীদের পাকড়াও করা।

আরও পড়ুন

ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমাদের একজন কৃষক জোর গলায় বলেছিলেন, ‘যারা ক্ষমতায় থেকে যা খুশি তা–ই করে, তারা নিজেদের সরকার বললে কী হবে? তারা তো অস্থায়ী, আসে আর যায়। আমরা জনগণই তো স্থায়ী, আমরাই আসল সরকার।’ সেই স্থায়ী সরকারের সক্রিয়তা ছাড়া আমাদের ক্রমবর্ধমান বিপদ থেকে কোনো উদ্ধার নেই।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক