স্মরণকালের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাস পার করল বাংলাদেশ। এত তীব্র তাপপ্রবাহ এবং কালবৈশাখী ও বৃষ্টিহীন এপ্রিল মাস শেষ কবে দেখেছেন, তা বয়োজ্যেষ্ঠরাও মনে করতে পারছেন না। মাসজুড়েই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০-এর আশপাশে থেকেছে। শেষভাগে এসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। আবহাওয়াবিজ্ঞানের ভাষায় যা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।
গাছ কেটে, জলাশয় ভরাট করে কংক্রিটের আবর্জনায় পরিণত করায় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় তাপমাত্রা যা উঠছে, তার চেয়ে অনুভূত হচ্ছে কয়েক ডিগ্রি বেশি। জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন এল নিনোর প্রভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা বড় অঞ্চলজুড়েই এবার অসহনীয় আবহাওয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ আরব দেশগুলোর তাপমাত্রা আর আমাদের দেশের তাপমাত্রা পাশাপাশি দিয়ে ঠাট্টা করছেন, মরুভূমি হতে আর কত দেরি। মরুভূমির ৪০-৪২ ডিগ্রি আর আমাদের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ৪০-৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য আছে।
আমাদের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে তাপমাত্রার সঙ্গে আর্দ্রতা যুক্ত হওয়ায় এ রকম আবহাওয়ায় বেশিক্ষণ কাজ করার মানে হলো, কর্মশক্তি হারানো। অনেক ক্ষেত্রেই প্রাণের ঝুঁকি তৈরি হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বারবার সতর্ক করছেন এ ধরনের চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় দিনের বেলা কাজে বা অন্য কোনো দরকারে বাড়ির বাইরে বের হলে ছাতা ও পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে বের হতে। আঁটসাঁট, রঙিন পোশাক না পরে সাদা কিংবা হালকা রঙের, সুতির, ঢিলেঢালা কাপড় পরে বাইরে বের হতে বলছেন। হাঁপিয়ে উঠলে ছায়াময় জায়গায়, ঠান্ডা কোথাও বসে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
কিন্তু বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের যে চিত্র, সেখানে ৮৭ থেকে ৮৮ শতাংশ মানুষকে অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আনুষ্ঠানিক হোক আর অনানুষ্ঠানিক হোক, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কায়িক পরিশ্রম করেই রোজগার করতে হয়। তাপপ্রবাহের সময়টা ঠিক কত শতাংশ মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব? দীর্ঘ ও টানা তাপপ্রবাহে প্রায় প্রতিদিন হিটস্ট্রোকে মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে, যাঁদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী।
স্বাধীনতার ৫০ বছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন বইয়ের লেখক গওহার নঈম ওয়ারা মনে করেন, এবারের তাপপ্রবাহকে জাতীয় দুর্যোগ বলা চলে। তিনি বলছিলেন, তাপপ্রবাহ যে ক্ষতি করছে, সেটা বহুমাত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি।
তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ বলা হোক আর না-ই বলা হোক, অস্বাভাবিক আবহাওয়া থেকে নাগরিকদের বিশেষ করে নাজুক শ্রমজীবীদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। জলবায়ুবিজ্ঞানী ড. শামসুদ্দিন শহিদ প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতের কলকাতা ও আহমেদাবাদের মতো শহরগুলোয় বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ জনপরিসরগুলোয় সিটি করপোরেশন গোসল ও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে, যেখানে শহরের বস্তিবাসী, ট্যাক্সিচালক ও হকারদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা সেবা নিতে পারেন।
বিশেষ করে মৎস্য ও পোলট্রিশিল্পের ক্ষতিটা বেশ কিছুদিন ভোগাবে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা বলতে গিয়ে সাবধান করছিলেন, তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলেই নির্মাণশিল্পসহ চড়া রোদে কাজ করতে হয়, এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীদের কাজ বন্ধ করা প্রয়োজন। কাজের সময় ভাগ করে সকালের দিকে ও সন্ধ্যার দিকে কাজ করার পরামর্শ তাঁর।
এবারের তাপপ্রবাহ দীর্ঘতার দিক থেকে ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। কিন্তু এপ্রিল–মে মাসে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার মুখোমুখি এ দেশের মানুষকে হতে হয়। ফলে এ ধরনের আবহাওয়ায় কীভাবে কাজ করতে হয়, সে ব্যাপারে আমাদের কৃষকেরা একটা পরম্পরা তৈরি করেছেন। গ্রীষ্ম মৌসুমে কৃষক ও কৃষিমজুরেরা সাধারণত সূর্যোদয় থেকে সকাল নয়টা–সাড়ে নয়টা পর্যন্ত কাজ করেন। আবার রোদ পড়ে গেলে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন।
কিন্তু শহরে বা নগর অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কাজের ক্ষেত্রে সে রকম কোনো পরম্পরা গড়ে ওঠেনি। প্রশ্ন হলো, সূর্যোদয় যেখানে ভোর সাড়ে ৫টায়, সেখানে অফিস, আদালতে কাজ শুরু সকাল ১০টায়? অন্তত গরমের তিন মাস কাজের সময় এগিয়ে আনা গেলে শ্রমজীবী মানুষদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময়টা এগিয়ে আনা সম্ভব হতো।
অন্য যেকোনো দুর্যোগের মতো তাপপ্রবাহে শ্রমজীবী মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন সবচেয়ে বেশি। নির্মাণশ্রমিক, পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, হোটেলশ্রমিক, কারখানাশ্রমিক, গৃহশ্রমিক, দিনমজুরদের বেশির ভাগেরই এ সময় আয় কমে গেছে। সোমবার সকালে গ্রিন রোড থেকে কারওয়ানবাজারে আসছিলাম রিকশায়।
ষাটোর্ধ্ব রিকশাচালক আবদুল আলী স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন মোহাম্মদপুরের বউ বাজারে। তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে ৯টা। হাতের স্মার্টফোন জানাচ্ছে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পারদ স্পর্শ করেছে। অনুভূত তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি। বাতাসে আর্দ্রতা ৫৩ শতাংশ। এই গরমে কীভাবে রিকশা চালাচ্ছেন?
জিজ্ঞাসা করতেই, রাস্তার পাশে রিকশার হুডের নিচে পা তুলে আধশোয়া হয়ে কিংবা ফুটপাতে বসে জিরোনো আরও কয়েকজন রিকশাচালককে দেখিয়ে বললেন, ‘একটা করে খ্যাপ মেরে আধঘণ্টা বসে জিরায়ে নিতি হয়। এক্বেবারে হাঁসফাঁস দশা।’ কিন্তু কংক্রিটে মোড়া শহরে শ্রমজীবীদের একটু জিরিয়ে নেওয়ার ছায়া কোথায়?
গায়ের সাদা হাফশার্টটা ঘামে ভিজে পিঠের সঙ্গে লেপটে গেছে। রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় একটা ক্যাপ পরেছেন। আর ঘাড়ের গামছা দিয়ে একটু পরপর মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছেন। জানালেন, ‘রোদের যে তাপ আর এমন চিটচিটে গরম যে জোহরের আজানের (বেলা ১টা) পর আর রিকশা চালাতে পারি না।’ গরমের কারণে আয় কমে গেছে। আগে যেখানে সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করতে পারতেন, এখন সেটা কমে ৪০০-৪৫০ টাকায় নেমেছে। অথচ গরমের কারণে খরচ বেড়েছে। একটু পরপর পানি, শরবত, আখের রস খেতে হয়। রাস্তায় বের হলে খাওয়ার খরচ দিনে অন্তত ৫০০ টাকা।
ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল আর ডেলিভারি ম্যানসহ ঢাকায় গত কয়েক বছরে নতুন যে আধা শ্রমজীবী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তীব্র এই তাপপ্রবাহে তাঁদের অবস্থাও সঙিন। আয় তো কমেছেই, আবার প্রচণ্ড গরমে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা মোটরসাইকেল চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
সোনারগাঁও হোটেলের সামনে সকাল ১০টায় যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলচালক আবু হানিফ বলেন, যতক্ষণ গাড়ি রানিংয়ের ওপর থাকে, ততক্ষণই স্বস্তি। সিগন্যালে দাঁড়ালে যেন ‘দোজখের আজাব’ নেমে আসে। রাস্তার পিচ থেকে আগুনের হলকা এসে গায়ে বেঁধে।
তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ বলা হোক আর না-ই বলা হোক, অস্বাভাবিক আবহাওয়া থেকে নাগরিকদের বিশেষ করে নাজুক শ্রমজীবীদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। জলবায়ুবিজ্ঞানী ড. শামসুদ্দিন শহিদ প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতের কলকাতা ও আহমেদাবাদের মতো শহরগুলোয় বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ জনপরিসরগুলোয় সিটি করপোরেশন গোসল ও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে, যেখানে শহরের বস্তিবাসী, ট্যাক্সিচালক ও হকারদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা সেবা নিতে পারেন।
অন্য দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাপপ্রবাহকালে আমাদের সরকার, আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো শ্রমজীবী মানুষদের একটু স্বস্তি কি দিতে পারে না? এখানেই হয়তো গণতন্ত্র, জবাবদিহি আর নাগরিকের প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মূল প্রশ্নটি জড়িত।
● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী