বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সিসিইউ ও কেবিনের মধ্যে ছোটাছুটি করছেন কয়েক মাস ধরে। গত ২৮ অক্টোবরের সংঘাতকে কেন্দ্র করে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় সবাই এখন কারাগারে। সারা দেশে কয়েক হাজার মানুষকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসারে শহর সয়লাব। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান অগ্নিসংযোগকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। আর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন–অর–রশীদ বলেন, ‘কারা আগুন লাগাচ্ছে, আমরা জানি। যে–ই লাগাক, ছাড় নেই।’
ছাড় যে নেই, তা খুব স্পষ্ট। মাঠের বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে কারাগারে ভরা শেষ। আর গ্রেপ্তার ও অগ্নিসংযোগ ভাঙচুরের অভিযোগ থেকে যখন প্রবাসী বাংলাদেশি, পলাতক নেতার পরিবর্তে তাঁর যমজ সন্তানেরা রেহাই পাননি, তখন বোঝাই যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই তৎপর। কিন্তু তারপরও যখন অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই তৎপরতার ফল কী?
কারাগারে যাঁদের ঢোকানো হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কি অগ্নিসংযোগ বা ভাঙচুরের সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে? নাকি যা চলছে, তা বিএনপিকে নির্বাচনের আগে আরও চাপে ফেলার জন্য? বাজারে তো এই আলোচনা আছেই যে সরকার এখন বিএনপিকে ভাঙতে চায়। নাকি ধারণার বশে পুলিশ আবার গণগ্রেপ্তারে নেমেছে? তা না হলে তারা কোনো ঘটনায় চোখ বন্ধ রাখছে, আবার কোনোটায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে কেন?
সংবাদপত্র, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই প্রশ্নগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ভণ্ডুল হওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন দল ও রাজপথের বিরোধী দল পাল্টাপাল্টি যুক্তি উপস্থাপন করছে ছবি, ভিডিওসহ।
যেমন আওয়ামী লীগ বলছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ককটেল ছোড়া, বাস ও বাসযাত্রীদের ওপর হামলা, নির্দোষ যাত্রীদের লাঞ্ছনা, পুলিশ বক্সে আগুন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করায় সাধারণ মানুষ বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
কোনো দলই দোষ স্বীকার করে না। আর তাদের এই দায় চাপানোর খেলায় প্রাণ যায় বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা ১৮ বছর বয়সী পরিবহনশ্রমিকের। বাসে হামলা, ভাঙচুরের কারণে ভুগছেন শুধু সাধারণ মানুষ। জনগণকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যাঁরা জনগণের রাজনীতি করেন, তাঁদের খেলা শেষ হয় না। আগুন যদি না-ই লাগান, অন্তত নেভান, ছড়িয়েন না।
৬ নভেম্বর পর্যন্ত তারা চলমান অবরোধে পিকআপ ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর, বাসে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা নিয়ে পোস্ট দিয়েছে। ২০১৩-১৫ এই সময়কালের অগ্নিসংযোগের ছবি ও ভিডিও দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে বিএনপি আসলে ‘সন্ত্রাসী দল’।
বিএনপিও একগাদা পোস্ট, ভিডিও লিংক ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে তারা আসলে ভুক্তভোগী। আওয়ামী লীগ একটি ‘সন্ত্রাসী দল’। তারা বেশ কিছু ঘটনার কথা বলছে, যেগুলোর অনুসন্ধানে পুলিশের খুব একটা হেলদোল নেই।
যেমন ২৮ অক্টোবর কাকরাইলে বাসে অগ্নিসংযোগ নিয়ে ইংরেজি দ্য ডেইলি স্টার একটা প্রতিবেদন ছাপে। ওই প্রতিবেদনে তারা বাসচালককে উদ্ধৃত করে বলেছে, পুলিশের পোশাক পরা দুজন ব্যক্তি এশিয়ান পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে। ওই বাস পুলিশ ‘রিকুইজিশন’ করেছিল। তারা বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাসটি থেমেছিল দুটি পুলিশ চেকপোস্টের মাঝখানে।
পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে বলেছে, ঢাকা শহরের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরাই বাসে আগুন দিচ্ছিলেন। সেই দাবি কেউ কেউ আবার মানতে চাইছেন না।
আবার ওই একই দিনের একটি ছোট ভিডিওতে একদল তরুণকে লাঠি দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করতে দেখা যায় রমনার আশপাশে। এর কিছুক্ষণ পরই ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সামনে লাঠিসোঁটা হাতে পুলিশের পাশাপাশি কিছু তরুণকে দেখা যায়। বিএনপির দাবি, দুটি ভিডিও ক্লিপে থাকা তরুণেরা মূলত একই দলভুক্ত এবং তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী।
ওই দিন পুলিশের ওয়্যারলেস কথোপকথন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, যেখানে পুলিশকে বারবার বলতে শোনা যায় উপাসনালয়ে কোনো হামলা হয়েছে কি না। উঁচু ভবনের ছাদ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের দিকে বন্দুক তাক করার ছবিও দেখাচ্ছেন বিএনপির লোকজন।
এর দু–এক দিন পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওতে এক গাড়িচালককে বলতে শোনা যায় পাঁচ তরুণ তাঁর বাসে উঠেছিলেন। তাঁকে নামিয়ে দিয়ে তাঁরা আগুন ধরান। হঠাৎ ‘দেশের জনগণ’ বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া এক তরুণ গাড়িচালককে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তিনি চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, ‘মিথ্যা বলছিস ক্যান? পাঁচটা ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে তুই নিজে আগুন দিসনি?’ বেকায়দা দেখে সাদাপোশাকের ও সানগ্লাস চোখে দেওয়া এক ব্যক্তি গাড়িচালককে নিয়ে সটকে পড়েন।
এখানেই শেষ নয়। তৈরি পোশাক খাতের আন্দোলনরত শ্রমিকদের প্রতিহত করতে রাইফেল হাতেও নেমেছিলেন যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু। তাঁকেও গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টা করেনি পুলিশ।
এর মধ্যেই আবার দ্বিতীয় দফা অবরোধের শেষ দিনে সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশ পাহারায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মিছিল করতে দেখা যায়। যেখানে তাঁরা ‘একটা করে বিএনপি ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ স্লোগান দেন।
পুলিশ অবশ্য আগেই ভিডিও ডকুমেন্টারি বানিয়ে ফেলেছে। ২৮ অক্টোবরের পর বানানো সেই ডকুমেন্টারির শুরুর দিকেই আছে, ‘আবার প্রমাণ হলো সন্ত্রাসের রাজনীতির প্রতীক হলো বিএনপি।’
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি পুরোপুরিভাবে তার দায় অস্বীকার করতে পারে? প্রেসের ভেস্ট পরে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারে বলাকা গাড়িতে আগুন দেওয়া ব্যক্তিটি কি তাদের দলের নয়? নজরদারির এই যুগে চেহারা লুকানো কঠিন। জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম রবিউল ইসলাম নয়ন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুবদলের নেতা।
১ নভেম্বর সকালে মুগদায় মিডলাইন পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে পালানোর সময় স্থানীয় জনগণ আল আমিন নামের একজনকে ধরে পুলিশে দিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরাও বিরোধীদলীয় কর্মী।
এর বাইরেও এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি প্রকাশ করেছে পুলিশ। তাঁর নাম মো. জামাল হোসেন। তিনি নিজেকে ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের নেতা বলে পুলিশকে জানান। তাঁকেও বাসের কন্ডাক্টর ধরে দিয়েছেন। জিম্মায় থাকা সন্দেহভাজন অপরাধীর বক্তব্য এভাবে পুলিশ প্রচার করতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু যাদের ব্যাপারে অভিযোগ উঠছে, তাদের নিয়ে রাজপথের বিরোধী দল রা করছে না।
অবাক করা ব্যাপার হলো, দুই দলই পরস্পরকে দোষারোপ করছে। কিন্তু তারা নিজেদের নেতা-কর্মীদের সহিংসতা থেকে দূরে রাখার কোনো চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় না, বরং উসকানি আছে। যেমন সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে বলা হয়েছে, আগুন দিতে দেখলে আগুনে ফেলে দিতে হবে বা পুড়িয়ে দিতে হবে। এই কাজের দায়িত্ব কে পালন করবে, তার অবশ্য কোনো নির্দেশনা নেই।
প্রশ্ন জাগে, এই দায়িত্ব কি যাঁরা বড় বড় লাঠিসোঁটা নিয়ে বিরোধী দলের কর্মীদের জবাই করার স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদেরই? ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের আগে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তো বললেনই, ‘২৮ তারিখ আমাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। যেমন আমরা লগি-বইঠা নিয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলাম, তেমনি ২৮ অক্টোবরও আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করব।’
আর বিএনপিও ২০১৪ সালের অগ্নিসংযোগের প্রসঙ্গ এলেই ইতিহাস নিয়ে বসে। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম শেরাটনের সামনে যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ নিয়ে কী বলেছিলেন, তার ভাষ্য প্রচার করে।
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের নির্দেশে বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল এ নিয়ে। অগ্নিসংযোগ ও সংঘাতের খবর এলেই তাঁরা ঝুলি থেকে এই খবরের কাটিং বের করে বসেন।
কোনো দলই দোষ স্বীকার করে না। আর তাদের এই দায় চাপানোর খেলায় প্রাণ যায় বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা ১৮ বছর বয়সী পরিবহনশ্রমিকের। বাসে হামলা, ভাঙচুরের কারণে ভুগছেন শুধু সাধারণ মানুষ। জনগণকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যাঁরা জনগণের রাজনীতি করেন, তাঁদের খেলা শেষ হয় না। আগুন যদি না-ই লাগান, অন্তত নেভান, ছড়িয়েন না।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]