এই ধাক্কা বিএনপি কীভাবে কাটিয়ে উঠবে

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ছাত্রদলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছেন।

ডাকসু নির্বাচনের পর কেবল ছাত্রদল নয়, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও জোরেশোরে প্রচার করতে থাকলেন, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সঙ্গে আঁতাত করে ইসলামী ছাত্রশিবির নির্বাচনে জিতেছে।

এ অভিযোগের দুটি দিক আছে। প্রথমত, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠনটি এখনো ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারকের ভূমিকায় আছে। যদি ছাত্রদলের নেতারা ছাত্রলীগের এমন শক্তি আগে আঁচ করে থাকেন, তাহলে তাঁরা তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করলেন না কেন? সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, কিন্তু তাদের সমর্থকদের ভোটাধিকার তো কেউ কেড়ে নেয়নি।

আসলে বিএনপি ও ছাত্রদলের এসব অভিযোগ যে কত অসার, তা একটি হলের ভোটের ফলাফল তুলে ধরলেই পরিষ্কার হবে। ওই হলে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম পেয়েছেন ১ হাজার ২৭৬ ভোট ও শিবির–সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্রার্থী সাদিক কায়েম পেয়েছেন ১০ ভোট। জিএস পদে ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৩৯৮ ভোট আর শিবির–সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ৫ ভোট। হলটি ঐতিহ্যগতভাবে ছাত্রলীগ প্রভাবিত। অতীতে অন্যান্য হলে যখন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল বা ছাত্র ফ্রন্ট জয়ী হতো, তখনো হলটিতে ছাত্রলীগ জিতত।

আরও পড়ুন

ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, তাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ক্যাম্পাসে যেতে পারেননি। অথচ ছাত্রশিবির ছদ্মবেশে ছাত্রলীগে থেকে কাজ করেছে এবং ক্যাম্পাসে থেকেছে। কিন্তু গত ১৩ মাস ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসে থাকতে সমস্যা হয়নি। 

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ৫০ থেকে ৬০ জন নেতা–কর্মী যোগ দিয়েছিলেন। কোনো টিভি অনুষ্ঠানে ছাত্রদলের কোনো নেতা গেলেও ২০ থেকে ২৫ জন কর্মী–সমর্থককে তাঁর সঙ্গে থাকতে দেখেছি।

সময়ের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিএনপি সব সময়ই নিজেকে আধুনিকায়ন করেছে বলে দাবি করেছেন তারেক রহমান। কিন্তু ছাত্রদল তো একটুও নিজেকে বদলায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগ তাদের বোঝা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হয়েছিল ছাত্রলীগের কারণে। ছাত্রদল বিএনপির বোঝা না আশীর্বাদ, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। বিএনপির নেতৃত্ব তরুণদের আস্থা পুনর্গঠন করার কথা বলেছেন। কিন্তু আস্থাটি কেন ভেঙে গেল, সে প্রশ্নের উত্তর বিএনপি খুঁজছে বলে মনে হয় না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যখন ছাত্রলীগের কোনো নেতা টিভিতে আসতেন, তাঁর সঙ্গে ৩০ থেকে ৪০ জন সমর্থক আসতেন, কেউ নেতার গাড়িতে, কেউ বাইকে চড়ে। চেহারা বদল হয়েছে, সংস্কৃতিটা বদলায়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিপদে–আপদে যে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশে পেয়েছেন, তাঁদেরই ভোট দিয়েছেন। তাঁরা প্রতীক বা নেতা দেখে ভোট দেননি। বিএনপির নেতারা শিবিরের বেনামি প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সমালোচনা করছেন।

এর মানে হলো শিবির পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে পারলেও ছাত্রদল বা বিএনপি বুঝতে পারেনি। শিবির দেখেছে, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেল করলে তাদের মতাদর্শের বাইরের শিক্ষার্থীদেরও সমর্থন মিলবে। প্রতীকী হলেও একজন জাতিগত সংখ্যালঘু প্রার্থীকেও প্যানেলে রেখেছিল তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর অর্ধেক থাকেন হলের বাইরে। নির্বাচনের আগে তাঁদের কতজনের সঙ্গে ছাত্রদল ও শিবিবের নেতারা যোগাযোগ করেছেন, সে খোঁজ নিলেই জয়–পরাজয়ের রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে। ছাত্রদলের হারের আরেকটি কারণ অতি আত্মবিশ্বাস। তারা ভেবেছে, জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, ফলে ক্যাম্পাসেও ছাত্রদলকে কেউ হারাতে পারবে না।

আরও পড়ুন

স্বীকার করতে হবে, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফল যেমন জামায়াতে ইসলামীকে উজ্জীবিত করেছে, তেমনি বিএনপিকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, সেই ধাক্কা তারা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে?

১৭ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের অভিযোগসহ নানাভাবে তৃণমূল নিয়ন্ত্রণে যখন বিএনপি হিমশিম খাচ্ছে, তখন দলটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে তৃণমূল পর্যায়ে ঘরে ঘরে বৈঠক, সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটাকে অনেকে ওয়েক-আপ কল হিসেবেও অভিহিত করেছেন।

বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া বার্তায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নানা অভিযোগে বিএনপির সাত হাজারের বেশি দলীয় সদস্যের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অসদাচরণের দায়ে কেউ পদচ্যুত হয়েছেন, আবার অনেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন।’

আরও পড়ুন

কিন্তু যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিকে মদদ দেয়, তার অবসান ঘটাতে না পারলে ‘বহিষ্কার ও তিরস্কার’ দিয়ে দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না।

সময়ের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিএনপি সব সময়ই নিজেকে আধুনিকায়ন করেছে বলে দাবি করেছেন তারেক রহমান। কিন্তু ছাত্রদল তো একটুও নিজেকে বদলায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগ তাদের বোঝা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হয়েছিল ছাত্রলীগের কারণে। ছাত্রদল বিএনপির বোঝা না আশীর্বাদ, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। বিএনপির নেতৃত্ব তরুণদের আস্থা পুনর্গঠন করার কথা বলেছেন। কিন্তু আস্থাটি কেন ভেঙে গেল, সে প্রশ্নের উত্তর বিএনপি খুঁজছে বলে মনে হয় না।

যেদিন তারেক রহমানের বার্তাটি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সেদিনই দেখলাম, নরসিংদীর আলোকবালী ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। তিনি দলটির কেউ নন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতিতে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কেন সাধারণ মানুষ জীবন দেবে? সেখানে একটি পক্ষে ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক শাহ আলম চৌধুরী এবং আরেক পক্ষে সদ্য বহিষ্কৃত সদস্যসচিব আবদুল কাইয়ুম মিয়া নেতৃত্ব দেন। মেঘনা নদী থেকে বালু তোলাসহ নানা অভিযোগে সম্প্রতি দলীয় পদ থেকে বহিষ্কৃত হন আবদুল কাইয়ুম। 

আরও পড়ুন

অভিযোগ আছে, আবদুল কাইয়ুমকে ঠেকাতে শাহ আলম চৌধুরীর ইন্ধন ও হস্তক্ষেপে আওয়ামী নেতা-কর্মীদের আবার এলাকায় ফেরানোর পরিকল্পনা করা হয়। এর অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটার দিকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে এলাকায় ফিরতে শুরু করেন আত্মগোপনে থাকা স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। এ খবর পেয়ে আবদুল কাইয়ুমের সমর্থকেরা বাধা দেন। এ সময় উভয় পক্ষ টেঁটা, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষের খবর প্রকাশের জেরে নরসিংদী সদর হাসপাতাল চত্বরে এক সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগী সাংবাদিকের নাম আইয়ুব খান সরকার। তিনি বেসরকারি যমুনা টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি। এলোপাতাড়ি কিল–ঘুষিতে তাঁর মাথা ফেটে গিয়ে চারটি সেলাই দিতে হয়েছে।

হামলার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন সময় টেলিভিশনের সাংবাদিক আশিকুর রহমান। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, যমুনা টিভির সংবাদে কেন বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ বলা হয়েছে, তা নিয়েই প্রথমে তর্কাতর্কি শুরু হয়। আইয়ুব খান বারবারই বলেন, এটা তো তাঁর বলার কিছু নয়, ওসি ও স্থানীয় লোকজনই জানিয়েছেন। এরপরই ‘লিখলি কেন’, ‘এখনই ঠিক কর’ বলে হামলা করা হয়। তাঁকে উপর্যুপরি কিল–ঘুষি মারা হয়।

এ রকম ঘটনা কেবল নরসিংদী নয়, দেশের আরও জায়গায় ঘটছে।

সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি

[email protected]

* মতামত লেখকের নিজস্ব

[২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখাটি ‘ছাত্রদলের ব্যর্থতা বিএনপির জন্য ওয়েক–আপ কল?’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]