বিএনপি না থাকলে আওয়ামী লীগের উপায় কী

অতীতে আমাদের সমাজে গণনার একরকম পদ্ধতি ছিল। যেমন জোড়া, হালি, কুড়ি ইত্যাদি। পরে পশ্চিমাদের কাছ থেকে ঢুকে পড়েছে ডজন, মিলিয়ন, বিলিয়ন। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অনেক কিছু বাদ পড়লেও মানুষের মুখে মুখে এখনো দেশি শব্দগুলো বহাল। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনাকাটা করতে গেলে আমরা সংখ্যা বা পরিমাণ হিসেবে এসবের উল্লেখ করি। তো এ রকম একটা শব্দ দিয়েই শুরু করি।

পাকিস্তানি জমানায় যে সিএসএস (হাল আমলের বিসিএস) পরীক্ষা হতো, তাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেতেন বড়জোর এক কুড়ি। তাঁদের বলা হতো সিএসপি। সংখ্যায় কম বলে সবারই সচিব হয়ে অবসরে যাওয়ার সুযোগ মিলত। তাতে ঠেলাঠেলি হতো না।

মোসাহেবিরও দরকার পড়ত না। এখন তো শত-সহস্র-অযুত বিসিএস। পদোন্নতির মইটা ওপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। সে জন্য ওপরে ওঠার জন্য ধাক্কাধাক্কি অনেক। তৈলমর্দনও বেশি।

আরও পড়ুন

আইয়ুব খান দোর্দণ্ডপ্রতাপে প্রায় সাড়ে ১০ বছর দেশ শাসন করেছেন। তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল ডজনখানেক। স্কুলে পড়ার সময় গড়গড় করে নাম এবং পোর্টফোলিও মুখস্থ বলতে পারতাম। এখন মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা কয়েক কুড়ি। সব কটি নাম মুখস্থ বলতে পারার মেধা খুব কম লোকেরই আছে। তাঁরা নিজেরাও বলতে পারবেন কি না সন্দেহ। প্রধানমন্ত্রী হয়তো পারবেন।

তো কয়েক কুড়ি মন্ত্রীর মধ্য থেকে দুজন সম্প্রতি একটি কথা বাতাসে ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, বিএনপি নেতা খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই। তবে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। কথাটি রাজনীতির নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ তুলেছিল। অনেকেই নড়েচড়ে বসেছিলেন।

জন-আলোচনায় খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় কিছুটা ঝড় উঠেছিল। তাতে জল ঢেলে দেন অন্য দুই মন্ত্রী। তাঁরা বললেন, দণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে খালেদা রাজনীতি করতে পারবেন না, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া তো দূরের কথা। যাহোক, তাঁদের বাহাস জারি থাকল কয়েক দিন। তারপর মিইয়ে গেল।

আরও পড়ুন

আসল ঘটনা কী? আমরা সবাই জানি, সামনে একটা শত্রু না থাকলে টার্গেট প্র্যাকটিস করা যায় না। চাঁদমারিতে আমরা ‘বুলস আই’ নিশানা করে রাইফেলের গুলি ছুড়ি। খড় দিয়ে বানানো শত্রুর প্রতীকী মূর্তিতে বেয়নেট চার্জ করে আমরা যুদ্ধের মহড়া দিই। রাজনীতিতেও এ রকম টার্গেট লাগে।

ক্ষমতাসীন দলের টার্গেট হলো বিএনপি এবং তার জীবিত ও মৃত নেতা। তাঁদের নাম ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁদের নাম জপ না করে তাঁরা দিন যাপন করেন না। তাঁরাই দলটির মৃত নেতাকে অমর ও নিষ্ক্রিয় জীবিত নেতাকে আলোচনায় রেখেছেন। বোঝা যায়, বিএনপি না থাকলে আওয়ামী রাজনীতি এক দিনও চলবে না।

আমরা দুই জোড়া অর্থাৎ চার মন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী কথা শুনলাম। বুঝলাম না তাঁদের কথার খেলা ড্র হয়েছে, নাকি তাঁদের এক জোড়া জয়যুক্ত হয়েছেন। আমরা জানি, চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলো নিয়ে সন্ধ্যার আকাশে উদিত হয়। তারপর দিনের আলো উঁকি দিলে সে হারিয়ে যায়। মন্ত্রীদের অবস্থাও অনেকটা সে রকম।

প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকারব্যবস্থায় তাঁদের আয়ু নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর মর্জির ওপর। প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়াকে নিয়ে তাঁদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা কি তাঁদের নিজস্ব বিবেচনাপ্রসূত, নাকি আদিষ্ট হয়ে তাঁরা এসব কথা বলেছেন। দুদিকেই একজন করে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আছেন। তাঁরা তো আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য।

প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকারব্যবস্থায় তাঁদের আয়ু নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর মর্জির ওপর। প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়াকে নিয়ে তাঁদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা কি তাঁদের নিজস্ব বিবেচনাপ্রসূত, নাকি আদিষ্ট হয়ে তাঁরা এসব কথা বলেছেন। দুদিকেই একজন করে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আছেন। তাঁরা তো আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য।

সুতরাং, তাঁরা না জেনে, না বুঝে কথাগুলো বলেছেন, এটা কীভাবে বলি? আবার একদিকে স্বয়ং আইনমন্ত্রী এক কথা বলেছেন। তিনি আইন জানেন না—এটা কল্পনা করারও ধৃষ্টতা আমার নেই। অন্যদিকে আছেন সভাপতির পর দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের নেতা। কারও কথা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কথা হলো, তাঁরা এ বিতর্ক কেন তুললেন? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাঁদের মোটিভ কী?

আমাদের রাজনীতিবিদেরা প্রতিপক্ষের মঙ্গলের জন্য কিছু বলবেন, এটা অবিশ্বাস্য। খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না-করা নিয়ে এ বিতর্ক কি বিএনপিকে নতুন করে কোনো ফাঁদে ফেলার কৌশল? দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার কান্ডারি শেখ হাসিনা যে দক্ষ খেলোয়াড়, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই চার মন্ত্রীর কথাবার্তায় সন্দেহ জাগে, তাঁরা এ সময় এই রকম একটি বিষয় কেন ছুড়ে দিলেন। এটা কি খালেদা জিয়ার প্রতি ভালোবাসা বা সহানুভূতি থেকে? এটা কি একধরনের ‘রিকন্সিলিয়েশনের’ উদ্যোগ? নাকি আওয়ামী লীগ চাপে আছে?

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের কথাবার্তায় সবটা আন্দাজ করা যায় না। পাকিস্তানের প্রয়াত নেতা ইয়াহিয়া খানের এক প্রশ্নের জবাবে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘আমরা, রাজনীতিবিদেরা যা বলি, তা করি না।’ কে না জানেন, রাজনীতির উপাস্য দেবতা হলেন ম্যাকিয়াভেলি। মন্ত্রীদের কথাবার্তায় অনেক জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। জিজ্ঞাসার জবাব না পাওয়া গেলে তৈরি হয় গুঞ্জন। গুজবের গায়ে ডালপালা জন্মে এবং তা দ্রুত ছড়ায়। তখন অনেক বার্তা পাওয়া যায় হাওয়া থেকে। তো হাওয়া থেকে পাওয়া একটি বার্তা হলো, সরকার বিদেশিদের চাপে আছে। বিদেশিরা এবার একটা ‘ভালো’ নির্বাচন দেখতে চান।

তাঁদের আশ্বস্ত করতেই দুই মন্ত্রীর এ ধরনের উক্তি। কিন্তু ঢিলটা মাটিতে পড়তে না–পড়তেই অন্য দুই মন্ত্রী রিজয়েন্ডার দিয়ে দিলেন। বোঝা যায়, এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু ‘বসের’ অনুমতি ছাড়া বা তাঁর অজান্তে তাঁরা এসব কথা বলেছেন বলে মনে হয় না। এ যেন ‘সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো’। আসলে সভাপতি শেখ হাসিনার মনে কী আছে, তা আগাম বোঝা মুশকিল। রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন নিয়ে সম্প্রতি যা হলো, তাতেই এটা বোঝা যায়।

বিএনপি নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সময় হলেই খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নামবেন। এটা অনেকটা আশ্বাসবাণীর মতো। মন্ত্রীদের কথা-চালাচালি দেখে তিনি নিজেও হয়তো ধন্দে পড়ে গেছেন। এখন তাঁরা কী করবেন? সবাই কোনো না কোনো জায়গা থেকে বার্তার অপেক্ষায় আছেন। আবার অনেক কথাবার্তা, লেনদেন, সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত হয় নেপথ্যে। যদিও আমরা জোর গলায় স্বচ্ছতার কথা বলি। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা হলো নীতি, কৌশল হলো গোপনীয়তা। তুরুপের তাসটা সবাই হাতে রেখে দেন। প্রশ্ন হলো, তুরুপের তাস কার হাতে? শেখ হাসিনা? খালেদা জিয়া? ওয়াশিংটন? নয়াদিল্লি? নাকি অন্য কোথাও?

নির্বাচনের আর বাকি আছে ১০ মাস। এর মধ্যে ভূমিষ্ঠ হতে পারে আরও অনেক চমক। আমার মনে হয়, যত দিন যাবে, নির্বাচন কমিশন ততই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। হুইসেল বাজাবে অন্য কেউ।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক