২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো। ইতিমধ্যে ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডানপন্থী থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন একটি নীতিপত্র প্রকাশ করেছিল। এর নাম প্রজেক্ট এসথার: ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলায় একটি জাতীয় কৌশল।
এই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনই সেই গোষ্ঠী, যারা প্রজেক্ট ২০২৫ নামের একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। প্রজেক্টের লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ডানপন্থী একটি রাষ্ট্র গঠন।
বাইবেলের রানি এসথারের নামে নামকরণ করা হয়েছে এই প্রজেক্টের। এসথার মূলত এক ভয়ানক উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছে। আর তা হলো ইসরায়েলের বর্তমান গণহত্যার যেকোনো বিরোধিতাকে অপরাধ হিসেবে দাঁড় করানো। আর একে সামনে রেখে বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এমনকি নাগরিক অধিকারগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া।
নীতিপত্রের প্রথম ‘মূলবার্তা’ হলো ‘আমেরিকার ইসরায়েলবিরোধী, জায়নবাদবিরোধী এবং তথাকথিত ‘ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলন’ আসলে এক বিশ্বব্যাপী হামাস সমর্থক নেটওয়ার্ক (গ্লোবাল হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক-এইচএসএন)-এর অংশ।‘
তবে মজার ব্যাপার হলো বাস্তবে এমন কোনো ‘গ্লোবাল হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক’ বলে কিছু নেই। স্বাভাবিকভাবেই, এর সঙ্গে জড়িত বলে যেসব সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর অস্তিত্বও নিছক কল্পনা। জায়নবাদ আর ফিলিস্তিনি গণহত্যাবিরোধী সবাই এই কল্পনার আওতায় পড়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদি সংগঠন জিউস ভয়েস ফর পিস পর্যন্ত হামাস সমর্থক বলে চিহ্নিত হয়েছে এই এসথার প্রজেক্টের তালিকায়।
প্রজেক্টের দ্বিতীয় মূলবার্তা আরও কৌতূহলোদ্দীপক। এই কথিত হামাস নেটওয়ার্ক নাকি ‘সেসব অ্যাকটিভিস্ট ও পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা সমর্থিত, যারা পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র ধ্বংসে নিবেদিত’। এটি শুনে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কারণ, যে থিঙ্কট্যাংক নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তারাই এখন গণতন্ত্র বাঁচানোর বুলি আওড়াচ্ছে!
এই রিপোর্টে ‘পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র’ শব্দজোড়া অন্তত পাঁচবার এসেছে। অথচ ইসরায়েলি আগ্রাসনে যে হামাসশাসিত গাজা গত ১৯ মাস যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ধ্বংস হয়েছে, এ কথা কে না জানে! দুনিয়াজোড়া অস্ত্রশিল্পের মুনাফার চোখে দেখলে অবশ্য গণহত্যা তো পুঁজিবাদের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা!
যদি ট্রাম্প প্রশাসন এখন এই প্রজেক্ট এসথারকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, তবে এর কারণ মূলত শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদের এজেন্ডা। এই এজেন্ডা জায়নবাদের নাম ব্যবহার করে চরম ডানপন্থী লক্ষ্য হাসিল করতে চায়।
প্রজেক্ট এসথারের ভাষায়, ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাই নাকি ইহুদিবিদ্বেষ। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী একটি ‘জাতীয় কৌশল’ চাইছে—এই কথিত হামাস-সমর্থক নেটওয়ার্কের প্রভাব সমাজ থেকে নির্মূল করতে হবে।
এই রিপোর্ট প্রকাশ পায় জো বাইডেন প্রশাসনের সময়েই। বাইডেন প্রশাসনকে রিপোর্টে ‘ইসরায়েল-বিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যদিও বাস্তবে গাজায় ইসরায়েলের প্রতিটি অপরাধে তারা একেবারে সক্রিয় সহযাত্রী।
এই নীতিপত্রে বহু সুপারিশ রয়েছে। যেমন ‘যখন হোয়াইট হাউসে কোনো বন্ধু প্রশাসন থাকবে, তখন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিরোধ করতে হবে।’
সাত মাস পর নিউইয়র্ক টাইমস–এর একটি বিশ্লেষণ জানায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর হোয়াইট হাউস এবং রিপাবলিকানরা প্রজেক্ট এসথারের অর্ধেকের বেশি সুপারিশ বাস্তবায়নের ডাক দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিরোধ বন্ধ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিল কেটে নেওয়ার হুমকি। এমনকি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করলেও বৈধ বাসিন্দাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী, কথিত এই হামাস-সমর্থক নেটওয়ার্ক ও তাদের সংগঠনগুলো নাকি যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈচিত্র্য, সমতা আর অন্তর্ভুক্তি এবং তথাকথিত মার্ক্সবাদী আদর্শের আড়ালে ‘জায়নবাদের বিরুদ্ধে’ বয়ান ছড়াচ্ছে। আর শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, তারা নাকি মার্কিন গণমাধ্যমেও দাপটের সঙ্গে সক্রিয়। বড় হোক কিংবা ছোট—প্রতিটি বিক্ষোভই নাকি তারা সব জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে তুলে ধরতে সক্ষম।
এখানেই অবশ্য রিপোর্ট থেমে থাকেনি। তাদের মতে, এই নেটওয়ার্ক ও সংগঠনগুলো টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইহুদিবিদ্বেষী প্রচার’ অবাধে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ‘হুমকি’ দমন করতে প্রজেক্ট এসথারে রয়েছে বেশ কিছু চরম সুপারিশ।
যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্লোবাল হামাস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক-সমর্থক শিক্ষক-কর্মী অপসারণ, বিক্ষোভকারীদের এমনভাবে ভীত করা যাতে তাঁরা এইচএসওর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকেই ভয় পায়, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ কনটেন্ট নিষিদ্ধ করা। এর মানে ইসরায়েলিদের হাতে হওয়া গণহত্যা নিয়ে যেকোনো কিছুই ইহুদিবিরোধী হিসেবে গণ্য হবে।
তবু এসব জোরালো প্রচারণার মধ্যেও দ্য ফরোয়ার্ড পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় জানানো হয়—এই প্রজেক্টে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি সংগঠন অংশ নেয়নি বা প্রকাশ্যে এর সমর্থন করেনি। মার্কিন ইহুদিদের এই সংবাদপত্র জানায়, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ইহুদিদের সমর্থন পেতে হিমশিম খেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সংগঠনের মাধ্যমে। এর পুরো মনোযোগ শুধু বামপন্থী ইসরায়েল সমালোচকদের দিকেই। ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ইহুদিবিরোধীদের নিয়ে তারা নিশ্চুপ।
এদিকে এই মাসেই মার্কিন ইহুদি নেতৃত্বের একটি খোলাচিঠিতে সতর্ক করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বহু শক্তি এখন ‘ইহুদি নিরাপত্তা’র কথা বলে আসলে উচ্চশিক্ষা, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাাধীনতা ধ্বংস করতে চাইছে।
যদি ট্রাম্প প্রশাসন এখন এই প্রজেক্ট এসথারকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, তবে এর কারণ মূলত শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদের এজেন্ডা। এই এজেন্ডা জায়নবাদের নাম ব্যবহার করে চরম ডানপন্থী লক্ষ্য হাসিল করতে চায়। ইহুদিবিদ্বেষ বা ইহুদিপ্রীতির কথা সেখানে কেবল বাহানা।
বেলেন ফের্নান্দেস কলাম লেখক, আল–জাজিরা
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ