২০০৪-২০০৫ সালের কথা। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে (বিইআই) বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রবাসী আয়ের আকার বা পরিমাণের ওপর এক আলোচনায় অংশ নিয়ে জানতে পারলাম, ওই সময়েই এটি ছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো আর তার মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে তৎকালে আসছিল ১১–১২ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কিছুদিন আগে এক আলোচনায় বলেছিলেন, ‘আমাদের সম্ভাব্য বা প্রাক্কলিত প্রবাসী আয়ের মাত্র ৫১ শতাংশ আসে বৈধ পথে আর বাকিটা হুন্ডি হয়ে। এটি বিবেচনায় নিলে আমাদের প্রাক্কলিত প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ বর্তমানে প্রাপ্ত ২২–২৩ বিলিয়ন ডলার বিবেচনায় নিয়ে ৪০-৪২ বিলিয়ন ডলার।’
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছি, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে আমাদের প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণের সুপারিশও করেছে কমিটি।
কমিটির বৈঠকে বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ১০টি প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়। কারণগুলো হলো বৈধ পথের তুলনায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্সে বিনিময় হারের বেশ ফারাক, প্রবাসী কর্মীর বৈধ কাগজপত্র না থাকা, প্রবাসে বাংলাদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা না থাকা বা পর্যাপ্ত শাখার অভাব।
এ ছাড়া বাংলাদেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান না থাকা বা পর্যাপ্ত মানি এক্সচেঞ্জ পয়েন্ট না থাকা, রেমিট্যান্স প্রেরণে উচ্চ ফি বা সার্ভিস চার্জ এবং নির্ধারিত সীমা (সিলিং), হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের বা প্রবাসীদের নিকটাত্মীয়দের দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না, আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রতিবন্ধকতা, অননুমোদিত ব্যবসা বা কাজের আয় বৈধ পথে প্রেরণের সুযোগ না থাকা, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে সচেতনতা ও উৎসাহের অভাব।
এতে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কুমিল্লা জেলা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার ৫৭২ জন বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৪৯ হাজার ৩৯১, চট্টগ্রাম থেকে ৪৩ হাজার ৮, টাঙ্গাইল থেকে ৩৮ হাজার ৭১২, চাঁদপুর থেকে ৩৪ হাজার ৯৫৬, কিশোরগঞ্জ থেকে ৩২ হাজার ৯০৭, নোয়াখালী থেকে ৩০ হাজার ৮৪১, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ হাজার ৮০, নরসিংদী থেকে ৩০ হাজার ২৯ এবং ঢাকা থেকে ২৬ হাজার ৮৮৩ জন বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থায়নে উন্নয়ন সহযোগীরা ইতিমধ্যে স্থানীয় রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাপক আয় বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। ভারত, ফিলিপাইন, মেক্সিকো এমনকি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায়ও প্রবাসী আয় বাজার অর্থনীতি বা বিশ্বায়নের এই যুগে বিদেশি মুদ্রায় বর্ধিষ্ণু দায় নিষ্পন্নে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। আমাদেরও সেই পথ ধরে, এমনকি সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনায় উঠেপড়ে লাগতে হবে।
একই বৈঠকে বিদেশগামী জনবলকে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণ প্রাপ্তিতে সহায়তা এবং বিদেশে শ্রমিক মৃত্যুজনিত সমস্যা নিরসনের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। সেই সঙ্গে বিদেশে জনশক্তি প্রেরণে নতুন নতুন শ্রমবাজার অন্বেষণ ও অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্বের সব শ্রম চাহিদার দেশে যুক্তিসংগত বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিনা অভিবাসন ব্যয়ে জনশক্তি পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণেরও অনুরোধ করা হয়।
আমাদের প্রাক্কলিত বা সম্ভাব্য প্রবাসী আয়ের একটি বিরাট অংশ বিদেশি মুদ্রায় দেশে না এলেও তার সমপরিমাণ এমনকি ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি স্থানীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকা কিন্তু চলে আসে। এমনকি প্রবাসীদের স্থানীয় আত্মীয়স্বজনের আগাম ঋণও দেওয়া হয়। শুধু সৌদি রিয়াল, ইউএই দিরহাম বা অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা চলে যায় অন্য কোনো দেশে আন্ডার-ইনভয়েসিং বা আমদানির বিপরীতে কর ফাঁকির কাজে বা বিদেশে সম্পদ পাচারে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থায়নে উন্নয়ন সহযোগীরা ইতিমধ্যে স্থানীয় রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাপক আয় বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। ভারত, ফিলিপাইন, মেক্সিকো এমনকি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায়ও প্রবাসী আয় বাজার অর্থনীতি বা বিশ্বায়নের এই যুগে বিদেশি মুদ্রায় বর্ধিষ্ণু দায় নিষ্পন্নে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
আমাদেরও সেই পথ ধরে, এমনকি সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনায় উঠেপড়ে লাগতে হবে।
বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে আরও তৎপরতা দেখাতে হবে। এ কাজে অ কিছু দেশের মতো বিশ্বব্যাংকেরও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। হুন্ডিকে চতুরভাবে উৎসাহিত করার কাজে যুক্ত কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বা তাদের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। রপ্তানি আয় দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ বাজারে সব উপায়ে ডলারের জোগান বাড়াতে হবে আর বিনিময় হারেও আনতে হবে স্থিতিশীলতা।
● মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক