ভিন্নমতের ছাত্রদের পেটানো যেখানে অপরাধ নয়

সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক রাজু ভাস্কর্যকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। প্রতিবাদে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া হলো।ছবি : প্রথম আলো

পাহাড়ে চার তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। চারটি প্রাণ তাদের সব সম্ভাবনা নিয়ে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। চারজনই ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। পাহাড়ের পাশাপাশি সমতলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁরা যুক্ত ছিলেন। কয় দিন আগেই ফেসবুকের টাইমলাইনে আসা ছবিতে দেখছিলাম গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, গণহত্যার প্রতিবাদে ও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাসংগ্রামে সংহতি জানিয়ে তাঁরা প্রতিবাদ করছিলেন।

পাহাড়ে চার তরুণের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন। গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের ওই মিছিলে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের সদস্য। খাগড়াছড়ি হত্যাকাণ্ডে নিহত চারজনের একজন বিপুল চাকমা তাঁদের কারও কারও পরিচিত, কারও–বা আবার বন্ধু। জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে আসা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি ছিলেন বিপুল চাকমা।

বিপুল চাকমাকে নিয়ে আবেগের আরও কারণ রয়েছে। ২০১৭ সালে গুরুতর অসুস্থ মাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়ার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিছুদিন পর মা মারা গেলে হাতকড়া পরা অবস্থায় মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন বিপুল। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের আবেগ বলি আর ক্ষোভ বলি, সেটা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাঁদেরই কেউ কেউ রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের টানানো ফেস্টুন ছিঁড়েছেন। সেটা কি গুরুতর কোনো অপরাধ? ছাত্রলীগ বিক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিবাদ কি কোনো স্বাভাবিক উপায়ে করা যেত না?

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিওতে আমরা দেখলাম, কীভাবে বাঁশ ও লাঠি নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্র জোটের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছেন। লাঠি ও বাঁশ দিয়ে যে যেভাবে পারছেন, বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন। মুখে তাঁদের অশ্লীল গালির তুবড়ি। ছেলে বা মেয়ে কেউই রেহাই পাচ্ছেন না পিটুনি থেকে। পিটিয়ে আহত করে কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠানো হলো।

যে দল ক্ষমতায় থাকবে, তাদের ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে, সেই মান ঠিক করা হয়েছে পাকিস্তান পর্বে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) গঠন করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বিরোধী মতের ছাত্রদের দমন-নির্যাতনের একটা মান তৈরি করেছিল। বাংলাদেশ পর্বে এসে সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি। বরং নব্বইয়ের পর যত দিন গড়িয়েছে, ততই তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।

না, এখানেই থামল না। সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক রাজু ভাস্কর্যকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। প্রতিবাদে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া হলো। কাউকে ঘায়েল করার অতি পুরোনো এ কৌশল কেন ব্যবহার করা হলো, তা জানতে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথে শাহবাগ ও টিএসসি এলাকায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হলেন ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতা। তাঁদের দলবদ্ধভাবে পেটানো হলো। ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসুকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হলো, মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হলো, চোখে আঘাত করা হলো। আর সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমদেকও পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এভাবে হামলা ও পিটিয়ে আহত করা ফৌজদারি অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি চেয়ে সাবেক ২১৬ ছাত্রনেতা বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের পুরো সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারও কাছেই ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়ে আহত করা, তাঁদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন করা অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়। এ বিষয়ে গণ-উপেক্ষা আমাদের ক্যাম্পাসগুলোকে এককথায় নিপীড়নকেন্দ্রে পরিণত করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর কিংবা ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর কিংবা ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর যে হামলা চালিয়ে আহত করে আসছে, তার কোনো ঘটনার বিচার হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে কি? ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতে ভিন্নমতের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের কয়টা হত্যারই–বা বিচার হয়েছে? বরং এ ক্ষেত্রে একটা দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু আছে।

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সাত খুনের ঘটনা সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিতে সাত শিক্ষার্থীকে রুম থেকে তুলে এনে মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ আরও কয়েকজন। বিচারে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাঁকে মুক্তি দেন এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় নিহত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দরিদ্র কৃষক পরিবারের অবলম্বন হতে যাওয়া সম্ভাবনাময় আবু বকর হত্যাকাণ্ডের বিচার কি হয়েছে? ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘আবু বকরকে কেউ খুন করেনি!’ প্রকাশিত সংবাদে বলা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আট মাস আগে এ মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু আবু বকরের মা-বাবা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে জানানো হয়নি। বাদীর পক্ষে সরকারি কৌঁসুলি এ মামলা পরিচালনা করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার বিচার সাত বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। দিয়াজের মা জাহেদা চৌধুরী ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে এত বছর ধরে একাই প্রতিবাদ করে চলেছেন। গত ২০ নভেম্বর ছেলের মৃত্যুর সাত বছরে তিনি বলেন, ‘বিচার দূরে থাক, মামলার তদন্তও শেষ হয়নি এখনো। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য লড়ে যাব। মৃত্যুর আগে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।’

আরও পড়ুন

ক্যাম্পাসে বিরোধী মতের ছাত্রনেতাদের ওপর হামলার পর যথারীতি এ হামলার সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান। তাঁর অনুসারীরা এই হামলায় জড়িত বলে অভিযোগ থাকলেও তিনি বলেছেন, ‘বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ হামলা করেছে।’ এমন বক্তব্য দায় এড়ানোর অতি ব্যবহৃত ও অতি জীর্ণ কৌশল। কিন্তু শুধু দায় এড়িয়েই থেমে থাকলেন না, বলে বসলেন, ‘ছাত্র ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা না চাইলে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার শক্তি-সামর্থ্য আমাদের থাকবে না।’

প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব কে দিয়েছে? এ কথার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে অস্তিত্বশীল থাকে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তার কিছুটা আঁচ ২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর ‘অপরাধের ৩৮ ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম’ শিরোনামের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। এ বছরের ১১ মাসে ছিনতাই, মারধর, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ এবং নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাঁরা ভিন্নমতের রাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন অন্তত আটবার। এসব ফৌজদারি অপরাধের শাস্তি হলো, সংগঠন থেকে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি।

যে দল ক্ষমতায় থাকবে, তাদের ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে, সেই মান ঠিক করা হয়েছে পাকিস্তান পর্বে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) গঠন করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বিরোধী মতের ছাত্রদের দমন-নির্যাতনের একটা মান তৈরি করেছিল। বাংলাদেশ পর্বে এসে সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি। বরং নব্বইয়ের পর যত দিন গড়িয়েছে, ততই তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।

● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী