আত্মহত্যাপ্রবণতা থেকে যেভাবে রক্ষা পেতে পারি

একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আমি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছি। এ কাজের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে কান পেতে রই মানসিক সহায়তা ও আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক হেল্পলাইনে যোগদানের মাধ্যমে। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে মানসিক সহায়তার পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কাজ হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আজকের প্রবন্ধটি আমার দীর্ঘ সময় আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।

আত্মহত্যার কথা আলোচনা করতে গেলে আত্মহত্যাসম্পর্কিত মিথ বা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে কথা বলা জরুরি। আত্মহত্যা বিষয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। মনঃকষ্টে ভোগা কিংবা বিষণ্নতায় আক্রান্ত কারও সঙ্গে আত্মহত্যার কথা বলা মানে তাকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা নয়; বরং ছোট্ট এ প্রশ্নের কারণে মানুষটি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে এই ভেবে যে কেউ একজন তার কষ্টের গভীরতা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পেরেছে। কেউ একজন ভেবেছে, তার কষ্টের পরিমাণ এতই বেশি যে সে এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারে। এ প্রশ্নের মাধ্যমে বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি তার ভেতর থাকা নানান ধরনের চিন্তা ও অনুভূতি নিয়ে খোলা মনে আলোচনা করার সাহস পাবে। ক্রাইসিসে থাকা, কষ্টে থাকা ও মানসিক রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির জন্য এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমরা পারিপার্শ্বিক ভুল শিক্ষার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। নিজেদের কথা লুকিয়ে রাখি এবং অন্যদের কথাও শুনতে চাই না। এ রকম যখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, সেখানে এ ধরনের একটি প্রশ্ন ওই দুই ব্যক্তির মাঝে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে। যার ফলে লম্বা একটা কথোপকথন শুরুর সুযোগ হয়ে যেতে পারে।

আত্মহত্যা বিষয়ে কারও সঙ্গে খোলা মনে কথা বলা উপকারী হতে পারে। কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, আপনার কথা বলার ধরনে যদি কটূক্তি, ব্যঙ্গ, অশ্রদ্ধা, অসম্মান, অযাচিত উপদেশ ইত্যাদি থাকে, তাহলে উপকার না হয়ে ওই ব্যক্তির বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আপনি যদি সুন্দর ও সহজভাবে তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ মনোভাব প্রকাশ করেন, তাহলে এটা খুবই চমৎকারভাবে কাজে আসতে পারে।

কোনো মানুষ যখন কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, যখন তার আর কষ্ট সহ্য করার মতো অবস্থা থাকে না, যখন কোনো কঠিন বিপদে পড়ে যায়, যেখান থেকে মুক্তির উপায় সে খুঁজে বের করতে পারে না কিংবা তার কাছে যখন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অর্থবহ বা সহজ লাগে, সে রকম একটা পরিস্থিতিতে গিয়ে সে মুক্তির উপায় হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। এই কষ্ট নানাবিধ কারণে হতে পারে—শারীরিক, মানসিক, পরিবেশগত ও সামাজিক। অপমানিত হলে, প্রতারিত হলে, সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ, বুলিং, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, নির্যাতনের শিকার হলে কেউ একজন ব্যর্থ মনে করতে পারে নিজেকে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটতে পারে মানুষের জীবনে, যেখানে সে আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। দীর্ঘ সময় কোনো একটি মনঃপীড়ায় জর্জরিত থাকায় ব্যক্তির মধ্যে চরম হতাশা বাসা বাঁধে। যার ফলে তার মধ্যে যুক্তিযুক্তভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা হ্রাস পায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে আমরা বলি ‘টানেল ভিশন’; মানে হলো তার মধ্যে চিন্তার সীমাবদ্ধতা চলে আসে। চরম হতাশা বা বিষণ্নতার কারণে সে আশপাশে থাকা নানান ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা দেখতে পায় না। সে ভাবে, আমার সঙ্গে এ রকম হয়েছে, তার মানে আমি ব্যর্থ এবং আমার মরে যাওয়াই শ্রেয়।

আরও পড়ুন

জীবনের কোনো সংকটপূর্ণ পরিস্থিতে সে এ রকম একটি কঠিনতম সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, যেটিকে সে একমাত্র সমাধান ভেবে ভুল করে এবং সেটা ছাড়া আর কোনো সমাধান যে থাকতে পারে, সেটি সে দেখতে পায় না। এ অবস্থায় ব্যক্তিটি যদি কারও সঙ্গে তার সংকট সম্পর্কে একদমই কথা বলতে না পারে, তাহলে তার মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি সংগত কারণেই বেড়ে যাবে। আশার কথা, এ রকম অবস্থায় কেউ এসে যদি তাকে সহমর্মিতার সঙ্গে কথা বলার আহ্বান করে, তার মধ্যে আত্মহত্যামূলক চিন্তা আসে কি না জানতে চায়, তখন কিন্তু সে তার ভেতর জমানো চিন্তা বা অনুভূতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে। এর ফলে তার ভেতরে যে টানেল ভিশন তৈরি হয়েছিল, পারস্পরিক কথাবার্তার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আর এটুকু পর্যন্ত যেতে পারলেই ওই ব্যক্তির ঝুঁকি প্রাথমিকভাবে অনেকটা কেটে যাবে, যেটা কিনা আত্মহত্যা প্রতিরোধে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।

এ ছাড়া কিছু মানসিক রোগ রয়েছে, যেগুলোয় আক্রান্ত হলে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যেমন বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে প্রফেশনালদের (চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) সাহায্য নেওয়া জরুরি (http://shuni.org/wp-content/uploads/2017/12/Referral-Pack-of-Mental-Health-Services-in-Bangladesh-1.pdf <https://www.blogger.com/blog/post/edit/5756856587798957166/1661370023249027579>)। অবস্থাভেদে এসব ক্ষেত্রে কখনো শুধু সাইকোথেরাপি বা শুধু ওষুধ নিতে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি ও ওষুধ একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হয়। এসব ক্ষেত্রে সবার জন্য চিকিৎসাপদ্ধতি একই হতে হবে, এমন নয়। উপরন্তু, প্রফেশনালের কাছে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাপদ্ধতি চালু করা এবং তা নিয়মিতভাবে চালিয়ে নেওয়া অনেকটাই পরবর্তী স্তরের কাজ। সবার এটা দরকার নাও হতে পারে। তাই আমাদের এটা বোঝা জরুরি, অবস্থা যা-ই হোক না কেন, মানসিক কষ্টে ভোগা সবার জন্যই বন্ধুত্বপূর্ণ সহমর্মী দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে উপকারে আসে। বিশেষ করে আত্মহত্যা প্রতিরোধে এটি প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ করে।

একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে আমার কাছে উল্লেখিত ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কেননা, কোনো মানুষ যতই সহমর্মী মনোভাবসম্পন্ন হোক না কেন, তার মধ্যে যদি উপরিউক্ত ভ্রান্ত ধারণা থাকে, সে ক্ষতি অনুমান করে কখনোই আরেকজনকে সাহায্যের জন্য সাহস করে এগিয়ে যাবে না। কষ্টে থাকা বন্ধুটি যদি কথা বলতে গিয়ে আত্মহত্যার চিন্তা প্রকাশ করেও ফেলে, সে ক্ষেত্রে শুধু ওপরের ভ্রান্ত ধারণা থাকায় প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাবে এবং নিজেও ভয় পেয়ে যাবে।

প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা বিষয়ে কারও সঙ্গে খোলা মনে কথা বলা উপকারী হতে পারে। কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, আপনার কথা বলার ধরনে যদি কটূক্তি, ব্যঙ্গ, অশ্রদ্ধা, অসম্মান, অযাচিত উপদেশ ইত্যাদি থাকে, তাহলে উপকার না হয়ে ওই ব্যক্তির বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আপনি যদি সুন্দর ও সহজভাবে তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ মনোভাব প্রকাশ করেন, তাহলে এটা খুবই চমৎকারভাবে কাজে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তির কষ্ট বোঝার চেষ্টা করা, খোলা মনে কথা শোনার চেষ্টা করা, ব্যক্তিগত নৈতিক মানদণ্ডে না বিচার করা, ধর্মীয় মানদণ্ডে বিচার না করা, জাজমেন্টাল প্রশ্ন না করা, উচিত-অনুচিত শিক্ষা না দেওয়া, উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা আশ্বাস না দেওয়া, গোপনীয়তা বজায় রাখা।
আত্মহত্যার ভ্রান্ত ধারণার পাশাপাশি এর বিপৎসংকেতগুলো সম্পর্কেও জানুন (https://suicidology.org<https://www.blogger.com/blog/post/edit/5756856587798957166/1661370023249027579>)।

আরও পড়ুন

যখনই কারও মধ্যে আপনি বিপৎসংকেত অনুমান করবেন, চেষ্টা করুন তার কাছে যাওয়ার। ‘কেমন আছ’—এ রকম সহজ প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করবেন। কিছুটা সহজ হয়ে এলে আপনি তার মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আছে কি না, তা জানতে চাইতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সামাজিক স্টিগমার কারণেই বেশির ভাগ মানুষ ব্যক্তিগত সংকট নিয়ে কথা বলে না। আত্মরক্ষার্থেই এই বাধা ভাঙতে হবে। জীবনের কোনো না কোনো সময় বেশির ভাগ মানুষই একবার হলেও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে। সঠিক যত্ন, সহযোগিতা ও চিকিৎসায় আত্মহত্যাসহ অধিকাংশ মানসিক সমস্যাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করছে। প্রতিটি আত্মহত্যা ঘটার আগে গড়ে ২৫ বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। প্রতিদিন পত্রিকা, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা এই আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান অবস্থা দেখতে পাই। সারা বিশ্বে তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এ বছর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আশার আলো জাগাতে কাজ করি একসাথে’। ‘আত্মহত্যা শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য’—এ আশার কথা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিরোধের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এ বিষয়ে বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে আত্মহত্যা বিষয়ে সচেতন করে তোলা। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি ভিন্ন দেশ ও জগতে বাস করা কেউ নয়; তারা আমাদের স্বজন, সহপাঠী কিংবা সহকর্মী।

আত্মহত্যা বিষয়ে সঠিক ধারণা এবং প্রতিরোধমূলক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা সবাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি।

  • রুবিনা জাহান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, হেড অব ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস, মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম, সাজেদা ফাউন্ডেশন