বিদ্যুতের দাম বাড়বে ১২ বার, ক্যাপাসিটি চার্জের বেলায় কী হবে

আন্দোলন ও রক্তপাতের পর গত বছরের নভেম্বরে পোশাকশ্রমিকদের নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা, আর সর্বোচ্চ মজুরি সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। অবশ্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি ছিল বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হলে ন্যূনতম মজুরি হতে হবে ২৫ হাজার টাকা।

কথা হচ্ছিল গাজীপুর কোনাবাড়ীর পোশাকশ্রমিক মনোয়ার বিশ্বাসের সঙ্গে। প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছেন পোশাকশ্রমিক হিসেবে। বর্তমানে ওভারটাইম মিলিয়ে তাঁর মাসিক আয় কমবেশি ১৯ হাজার টাকা। রান্নার সিলিন্ডার গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল মিলিয়ে জ্বালানির পেছনে এখন তাঁর মাসিক ব্যয় ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। মানে তার মোট আয়ের সাত ভাগের এক ভাগ ব্যয় হচ্ছে জ্বালানির পেছনে।

৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তগুলো বাংলাদেশ কতটা কার্যকর করেছে, তা দেখতে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে গেল। আইএমএফের প্রতিনিধিদলের কাছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ যা জানিয়ে এসেছেন, তার সরল অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, এ বছরে বিদ্যুতের দাম চারবার বাড়ানো হবে। তিন বছরে বাড়বে ১২ বার।

আরও পড়ুন

গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার আর খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে তিন দফা বেড়েছিল। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি গড়ে বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ৪ পয়সা। ভোক্তা পর্যায়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। তিন বছর পর তা বেড়ে হবে দ্বিগুণ। এখনই যেখানে শ্রমজীবী পরিবারগুলোকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পেছনে তাদের আয়ের ছয় বা সাত ভাগের এক ভাগ ব্যয় করতে হচ্ছে; তিন বছর পরে তাদের এই ব্যয়ের ভাগটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বাংলাদেশের অর্থনীতি, জ্বালানি নীতি, রাজস্ব নীতি—সবকিছু এখন যেন আইএমএফের ‘ব্যবস্থাপত্রে’ চলছে। আইএমএফ বলছে, ভর্তুকি কমাও। বিদ্যুৎ, সার, সেচে কৃষক, শ্রমজীবী কিংবা সাধারণ মানুষ যে ভর্তুকি–সুবিধা পেয়ে আসছেন; সবার আগে তা কাটা পড়ছে। আইএমএফ বলছে রাজস্ব বাড়াও। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা মেট্রোরেলের টিকিট থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য নিত্যপণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বসানোর তালিকা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। যেন এ দেশের সাধারণ মানুষের পকেট একেকটা আলাদিনের চেরাগ। সেখানে ঘষা দিলেই দৈত্য এসে হাজির হবে আর এনবিআর, বিদ্যুৎ বিভাগ যার যার চাহিদা অনুযায়ী রাজকোষে রাজস্ব জমা করে দেবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটের জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভুল নীতিকে প্রধানভাবে দায়ী করেন। কিন্তু এত কিছুর পরও কি সেই ভুল নীতি থেকে সরকার সরে এসেছে? বিদ্যুৎ-জ্বালানি কৌশলগত পণ্য। এর দাম বাড়লে তার যে প্রতিঘাত, তাতে সবকিছুর দাম বেড়ে যায়।

ভর্তুকি বাদ দেওয়া ও ভ্যাট-কর বাড়ানোর এই উৎসাহ–উদ্দীপনা দেখে মনে হচ্ছে কি, দুই বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের প্রকৃত আয় অনেকটা কমে গেছে? নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সবার ঘরে ঘরে যে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দুর্বিষহ সব গল্প জমে জমে পাহাড় হয়েছে, সেটা দেখার মতো চোখ, বোঝার মতো দরদ তাঁদের কোথায়? আর বুঝবেনই–বা কেমন করে? বিচ্ছিন্নতার দেয়াল এতটা পুরো হয়েছে যে শাসকশ্রেণির অভিজাতরা, তাঁদের সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব দিতেও কসুর করেন না।

এ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নয় থেকে ছয়ের ঘরে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদার লাগাম আটকে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার গতি থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে যে নীতি সরকার নিচ্ছে, তা মূল্যস্ফীতির লেখকে শাঁই শাঁই করে ওপরের দিকে নিয়ে যাবে। কারও কাছে স্পষ্ট নয়, সরকার আসলে কী চায়।

আরও পড়ুন

বিদ্যুৎ বিভাগ আইএমএফের কাছে জানিয়ে এসেছে, ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের লোকসান কমাতে চায় তারা। কিন্তু ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যাদের ক্যাপাসিটি চার্জের পেছনে বিদ্যুতের মোট ভর্তুকির ৮১ শতাংশ যায়, তার বেলায় কী হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর কী দিয়েছে, তা আমরা জানতে পারিনি। তবে পত্রিকার খবরে এটুকু জানা গেছে, আইএমএফ প্রতিনিধিরা ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছিলেন।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া– এ তিনটি মিলিয়ে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হয়। কয়লা, তেল, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় ভিন্ন। আবার গৃহস্থালী, শিল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভেদে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দামেও পার্থক্য আছে। বিদ্যুৎ বিভাগ গড় করেই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য ঠিক করে। বিদ্যুৎ বিভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের যে হিসাব দিচ্ছে, সেখানে বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন খরচের (জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ) সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়াও যুক্ত করে। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগ যে ভর্তুকির তথ্য দিচ্ছে, তাতে অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জও যুক্ত হয়। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জের বাড়তি বোঝাটাও ভোক্তার ঘাড়ে চাপছে।

বিদ্যুৎ ছিল না, তাই ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বল্পমেয়াদি সমাধান ছিল। কথা ছিল এসব কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল হবে তিন বছর। এর মধ্যে সরকার বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাবে।  কিন্তু বারবার লাইসেন্স নবায়ন করে সেগুলোর মেয়াদ বাড়তে বাড়তে ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, তার উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট। আর আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। তাহলে ২৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের কী কাজে আসছে?

অথচ ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১৭ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। উৎপাদন সক্ষমতার ৮০-৮৫ শতাংশ ব্যবহার হবে, এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে। গত অর্থবছরে উৎপাদন সক্ষমতার ৬২ শতাংশ বসে থাকলেও পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।

বণিক বার্তার তথ্য জানাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ (কাপাসিটি চার্জ) ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৮২টি বেসরকারি ও ৩২টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের বক্তব্য দিয়ে শেষের শুরুটা করা যাক। সম্প্রতি অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত একক বক্তৃতায় তিনি বলেন, বছরে ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ে কেউ কিছু বলে না। সরকার নিশ্চুপ, রহস্যজনকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ নিয়ে কিছু বলে না। ঋণখেলাপি, করখেলাপি ও অর্থ পাচারকারী একসূত্রে গাঁথা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটের জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভুল নীতিকে প্রধানভাবে দায়ী করেন। কিন্তু এত কিছুর পরও কি সেই ভুল নীতি থেকে সরকার সরে এসেছে? বিদ্যুৎ-জ্বালানি কৌশলগত পণ্য। এর দাম বাড়লে তার যে প্রতিঘাত, তাতে সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। ব্যাংক খাত বলি, শেয়ারবাজার বলি আর বিদ্যুৎ খাত বলি—বাংলাদেশের সবখানেই গোষ্ঠীতন্ত্র প্রবলভাবে গেড়ে বসে আছে। হাতে গোনা কয়েকজনের স্বার্থে পুরো জনগোষ্ঠী সেখানে জিম্মি।  

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
    [email protected]