নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে কেন এই ধন্ধ

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি কেমন হতে যাচ্ছে, এ নিয়ে ধন্ধে আছেন সবাই। অভিভাবকেরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, পরীক্ষা বলে তবে কিছু থাকছে না? শিক্ষকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, কীভাবে মূল্যায়নের কাজটি শুরু করবেন। শিক্ষাবছরের তিন মাস পার হতে চলল, অথচ মূল্যায়নের সমন্বিত কাঠামো তৈরি করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

এমনকি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন সংরক্ষণ করার জন্য একটি অ্যাপস তৈরির কথা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। এদিকে প্রশিক্ষণের অভাবে এখন পর্যন্ত নতুন পাঠদান প্রক্রিয়াই শিক্ষকেরা বুঝে উঠতে পারেননি। এর ওপর যোগ হয়েছে মূল্যায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধা। ‘শিক্ষক বাতায়ন’ এবং যোগাযোগের অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে শিক্ষকেরা প্রশ্ন রাখছেন, ‘এই তাড়াহুড়ার কী মানে ছিল?’ অবস্থা দেখে মনে হয়, আবার না পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরতে হয়!

করোনা এবং আরও অনেকগুলো কারণে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করতে হয়েছে পুরো প্রস্তুতি না নিয়ে। নতুন পদ্ধতি কতটুকু কাজের, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, এটি যথাযথভাবে চালু করা আদৌ সম্ভব হবে কি না। এখন মূল্যায়নে নম্বরের ব্যাপারটি থাকছে না। নম্বর ছাড়া কীভাবে মূল্যায়ন সম্ভব, এটি ভেবে প্রায় কেউই দিশা পাচ্ছেন না। আসলে এ রকম মূল্যায়নে অভ্যস্ত নয় পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ—মাত্র ১০-১৫টি দেশে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি ঠিকমতো না হওয়ায় তাঁরা আগের নিয়মেই ক্লাসে পড়িয়ে যাচ্ছেন।

অনেক স্কুলে পুরোনো নিয়মে পরীক্ষা নিতেও দেখা যাচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বাধ্য হয়ে নোটিশ জারি করেছে—শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণ করে শিখন-শেখানো কার্যক্রম চালাতে হবে এবং নির্ধারিত নির্দেশনা অনুযায়ী মূল্যায়নের কাজটি করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, শিক্ষক সহায়িকা এখনো সব স্কুলে পৌঁছায়নি এবং মূল্যায়নের নির্দেশিকাও চূড়ান্ত হয়নি।

রেজাল্ট কার্ড বা মূল্যায়নপত্রে নম্বরের বদলে লেখা থাকবে শিক্ষার্থীর দক্ষতার স্তর। কোন জায়গায় শিক্ষার্থীর সবলতা, কোথায় দুর্বলতা—এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকবে। সবই ভালো, কিন্তু নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের আধাখেঁচড়া অবস্থা দেখে মনে হয়, হিতে না আবার বিপরীত হয়!

এ অবস্থায় কীভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কিন্তু জবাব দেওয়ার কেউ নেই। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মানে পাঠদানের শুরু থেকেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নের তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। এই কাজ সুচারুভাবে করার জন্য অ্যাপসের বিকল্প নেই। কিন্তু অ্যাপস তৈরি করতে আরও দেরি হলে এবং শিক্ষকদের তথ্য ইনপুট দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলে মূল্যায়ন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হবে না।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সব সময় মনে হয়েছে, প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জন্য এই পদ্ধতি দারুণ কার্যকর। মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে আসা, শিক্ষার্থীর নিজের সক্ষমতাকে বের করে আনা এবং অর্জিত জ্ঞানকে স্থায়ী ও প্রয়োগযোগ্য করার জন্য এমন একটি শিক্ষাক্রমের প্রয়োজন ছিল। এখানে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানসহ প্রতিটি বিষয়ের জন্য কয়েকটি করে যোগ্যতা বা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন বাংলা বিষয়ের জন্য আটটি যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে।

আরও পড়ুন

এগুলো হলো: ১. ভাষা-যোগাযোগে দক্ষ হয়ে ওঠা, ২. প্রমিত ভাষায় কথা বলতে পারা, ৩. বয়স ও শ্রেণি-উপযোগী লেখা যথাযথভাবে পড়তে পারা, ৪. প্রায়োগিক, বিবরণমূলক, তথ্যমূলক, বিশ্লেষণমূলক ও কল্পনানির্ভর রচনা পড়ে বুঝতে পারা, ৫. ভাষার শৃঙ্খলা জেনে লিখিত ভাষায় দক্ষতা বাড়াতে পারা, ৬. নিজের অনুভূতি লিখতে পারা, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পারা, ৭. সাহিত্য পড়ে তার বিষয় ও কাঠামো বুঝতে পারা, একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করতে পারা এবং ৮. আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারা। শ্রেণি-অনুযায়ী এসব যোগ্যতার ধাপ বা ক্রমোন্নতি নির্ধারণ করা আছে।

এসব যোগ্যতা পূরণের জন্য শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। কার্যক্রম চালানোর সময়ে তিনি প্রতিনিয়ত মূল্যায়নের কাজটি করে যাবেন। মূল্যায়নের কাজটি সহজ করার জন্য একেকটি যোগ্যতাকে দু-তিনটি ছোট ছোট নির্দেশকে ভাগ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

সেসব নির্দেশক অনুযায়ী শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষক নির্ধারিত ঘরে টিকচিহ্ন দেবেন। এই পারদর্শিতা আবার তিনটি স্তরে বিভক্ত: প্রারম্ভিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর, পারদর্শী স্তর। প্রারম্ভিক স্তরে থাকা কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষা বছরের যেকোনো সময়ে তার দক্ষতার স্তর বাড়ানোর সুযোগ পাবে। শিক্ষার্থীর স্তর বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক মূল্যায়নের ছকে পরিবর্তন আনবেন। এভাবে বছরজুড়ে ধারাবাহিক বা শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকবেন শিক্ষার্থী পারদর্শিতার কোন স্তরে রয়েছে। পারদর্শিতার স্তরগুলো এতটাই কাঠামোবদ্ধ যে শিক্ষক স্বেচ্ছাচারী হয়ে মূল্যায়ন করবেন, এমন সুযোগ নেই। মূল্যায়নপত্রে বা রেজাল্ট কার্ডে নম্বর না থাকায় প্রথম প্রথম অভিভাবকেরা বিভ্রান্তিতে পড়বেন।

তাঁদের বোঝাতে হবে, নম্বর নয়, বরং শ্রেণিভিত্তিক নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করানোই মূল লক্ষ্য। ধারাবাহিক মূল্যায়নের পাশাপাশি সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর স্তর বা অবস্থান যাচাই করতে হবে। এই যাচাইয়ের কাজে আগের মতো কেবল লিখিত পরীক্ষা হবে না। এখন লেখার পাশাপাশি মূল্যায়নের কাজে যোগ হয়েছে বলার কাজ, বিষয় উপস্থাপনা, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, স্বপরীক্ষণ, আলোচনা-বিতর্ক ইত্যাদি প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীরা এককভাবে এবং দলগতভাবে কাজ করে তাদের দক্ষতা প্রকাশ করার সুযোগ পাবে।

রেজাল্ট কার্ড বা মূল্যায়নপত্রে নম্বরের বদলে লেখা থাকবে শিক্ষার্থীর দক্ষতার স্তর। কোন জায়গায় শিক্ষার্থীর সবলতা, কোথায় দুর্বলতা—এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকবে। সবই ভালো, কিন্তু নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের আধাখেঁচড়া অবস্থা দেখে মনে হয়, হিতে না আবার বিপরীত হয়!

  • তারিক মনজুর অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়