ভারত বলছে মোদিই ভারত নয়

ভারতের শাসকদের নীতি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো ছাড়াও ভারতের আরও অনেক পরিচয় আছে। তার একটা হলো, ভারতের নিয়মতান্ত্রিক ফেডারেল শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি।ছবি: রয়টার্স

আমাদের দেশে আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে অনত্যম হচ্ছে ভারত প্রসঙ্গ। কখনো মোদি-ইউনূস বৈঠক বা মোদির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অথবা স্থলপথ ব্যবহারে ভারতের বিধিনিষেধ কিংবা কখনো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ হবেই। এসব আলোচনার মধ্যে একটি বিষয় আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে মোদিই ভারত নন ও ভারতই মোদি নয়। ভারতের একটি শক্ত শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি রয়েছে, যা মোদির নীতি আওতার বাইরে।

মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ১৯৪৮ সালে মুসলমানদের জানমাল রক্ষার জন্য অনশন করেছিলেন। জওহরলাল নেহরু ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারত কেন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বতোভাবে সমর্থন, সহায়তা দিয়েছিলেন। ভারতের আরও অনেক নেতাই ছিলেন, যাঁদের মাধ্যমে আমাদের কাছে ভারতের পরিচয় উজ্জ্বলতর ছিল।

মাত্র কয় মাস আগে আমাদের পরিচয় ছিল ‘হাসিনার বাংলাদেশ’ বা বাংলাদেশই হাসিনা। গত ৫ আগস্ট, এক দিনে আমাদের এই পরিচয় উবে গেল। ছাত্র-জনগণের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের পরিচয়কে বদলাতে হলো। এখন চেষ্টা করছি আমাদের পরিচয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে যোগ করতে এবং একটা শক্ত শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি গড়তে।

ভারতে সরকার পরিবর্তনের জন্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রয়োজন হয় না। তারা প্রতি পাঁচ বছরে নির্বাচন করছে এবং অনেক নির্বাচনেই তারা সরকারে ক্ষমতাসীনদের হটিয়ে নতুনদের রাষ্ট্রভার দিয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ভারতের সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। সেই নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হটিয়ে বিরোধী দলের ক্ষমতায় আসার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বিরোধী পক্ষের মধ্যে নেতৃত্বের বিরোধ সেই সুযোগকে নষ্ট করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

মোদির সরকারি নীতি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈরিতা এবং কাশ্মীরে তাঁর নির্যাতননীতি আমাদের দেশের লোকদের দারুণভাবে আহত করেছে। তার ওপর কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলাকে ছুঁতো ধরে মোদি যেভাবে একটা প্রতিবেশী দেশকে শায়েস্তা করতে আক্রমণ চালান, তা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বেশ ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৪ সালের নির্বাচনে, ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মোদির দল বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন, একক সংখ্যা গরিষ্ঠের চেয়েও বেশ কম। অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটে বেঁধে মোদি প্রধানমন্ত্রিত্বে কোনোরকমে টিকে রয়েছেন। এই আঞ্চলিক দলগুলোর একটি হলো বিহারের জনতা দল (জেডি-ইউ), যার নেতা নীতীশ কুমার।

নীতীশ কুমার ছিলেন মোদিবিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ গঠনের একজন প্রধান কারিগর। কিন্তু নির্বাচনের অল্প কয় দিন আগে নীতীশ কুমার মোদির জোটে যোগ দেন। কারণ, প্রবীণতম নেতা হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন ইন্ডিয়া জোটের আহ্বায়ক হতে। কিন্তু কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এর বিরোধিতা করেছিলেন বলে আমরা জানি। যদি নীতীশ কুমার ইন্ডিয়া জোটে থেকে যেতেন, তা হলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত।

যেকোনো দেশে সরকার পরিচালনায় দুটি স্তর থাকে। নিচের স্তরটি হলো শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি। তার ওপরে পলিসি বা নীতিনির্ধারণ। ভিত্তি রাষ্ট্রের, আর পলিসি হলো যাঁরা সরকার গঠন করেছেন তাঁদের। গণতান্ত্রিক সরকারে, যেকোনো রাজনৈতিক দলকে তাদের পলিসি বা নীতি জনগণের কাছে গ্রহণীয় করে নির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত হতে হয়।

আরও পড়ুন

মোদির সরকারি নীতি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈরিতা এবং কাশ্মীরে তাঁর নির্যাতননীতি আমাদের দেশের লোকদের দারুণভাবে আহত করেছে। তার ওপর কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলাকে ছুঁতো ধরে মোদি যেভাবে একটা প্রতিবেশী দেশকে শায়েস্তা করতে আক্রমণ চালান, তা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বেশ ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের শাসকদের নীতি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো ছাড়াও ভারতের আরও অনেক পরিচয় আছে। তার একটা হলো, ভারতের নিয়মতান্ত্রিক ফেডারেল শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি।

১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ দুই ভাগ করল। ভারত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটা মজবুত গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক পথে এগিয়ে গেল। পাকিস্তান বেছে নিল প্রাসাদ রাজনীতি ও অনিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। আইয়ুব খান এসে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন।

একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর আমরা পাকিস্তানের পথই বেছে নিলাম। এতে যোগ করলাম নতুন উপাদান—খুনোখুনি ও ফ্যাসিবাদ। স্বাধীনতার পর আমাদের সুযোগ ছিল গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাওয়ার। আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিনি। এখন আবার সুযোগ এসেছে একটা নিয়মতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিতে এগিয়ে যাওয়ার। এই উদ্যোগে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতের সাংবিধানিক পদ্ধতিগুলো যাচাই করতে কোনো দোষ নেই।

আরও পড়ুন

মানি শংকর আয়ার ভারতের একজন সাবেক আমলা, বর্তমানে কংগ্রেস দলের নেতা। ভারতের গণতন্ত্র সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, ‘১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় ১৫০টি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তবে এত বড় আকার ও বৈচিত্র্যের দেশ হিসেবে ভারতই কেবল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তাই নয়; বরং ৭৮ বছর ধরে তা টিকিয়ে রেখেছে।’

ভারতে ২৮টি রাজ্য এবং ৮টা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। ভারতের মজবুত ফেডারেল সরকার ও রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন ২০০ ভাষাভাষীর এতগুলো রাজ্যকে একত্রে রাখতে সহায়তা করেছে। অবশ্য অনেক রাজ্যেই মাঝেমধ্যে ফেডারেশন থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছে। ভারত সরকার শক্ত হাতে তা প্রতিহত করেছে।

ভারতের ফেডারেল শাসনব্যবস্থার কিছু জিনিস আমাদের উপকারে লাগতে পারে। এগুলো পর্যালোচনা করতে অথবা এগুলোতে কোনো ভালো কিছু আছে কি না, তা বিবেচনা করতে আমাদের ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে হবে না বা তাদের কোনো শর্ত মানতে হবে না।

ভারতের নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হয়? তিনজনের একটি বাছাই কমিটিতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী, একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। তাঁরাই প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করেন তাঁদের বাছাই করা ছয়জন থেকে তিনজনকে চূড়ান্তভাবে বেছে নিতে। ৭৮ বছরের ঐতিহ্যই ভারতীয় নির্বাচনী পদ্ধতিকে রক্ষা করে রেখেছে। নির্বাচনের উত্তাপে, অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতিত্ব, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইত্যাদি বলে অভিযোগ করেন, কিন্তু নির্বাচনের পরে সবাই হার-জিত মেনে সংসদে আসন গ্রহণ করেন।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নির্বাচনেও যথেষ্ট সতর্কতা রয়েছে তাদের শাসনতন্ত্রে। একজন বিচারকের পদ খালি হলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কতগুলো নাম প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠান। এগুলো অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়। তারপর প্রধানমন্ত্রী একজনকে সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করেন।

সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হন। ভারতীয় বিচারে কখনো কখনো বিচারকের জাত, ধর্ম ও মনোভাব বিচার কার্যে প্রভাব ফেলে। একে বলা যায় ‘ব্যক্তিগত পক্ষপাত’। যদিও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কখনো হয়নি। ১৯৭৫ সালে কয় মাসের জন্য জরুরি শাসন ঘোষণা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় শাসনতন্ত্র ও সুপ্রিম কোর্টকে পরীক্ষায় ফেলেন। পরবর্তী সময় এ জন্য তাঁকে অনেক বড় শাস্তি পেতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন

শাসনতান্ত্রিক শৃঙ্খলা পুরো মাত্রায় সম্পূর্ণভাবে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে, আমাদের নতুন শুরুটাও খুব ভালো হচ্ছে না। কয় দিন আগে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে এড়িয়ে অবরোধ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা একটা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করিয়ে নিয়েছে। এর জন্য আর একটু ধৈর্য ধরে বিচার বিভাগের ওপর নির্ভর করা কি যেত না?

আরেকজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা মেয়র হওয়ার জন্য লোক জড়ো করে ঢাকা মিউনিসিপ্যালটিতে তালা লাগিয়ে দিলেন। তিনি কি পরের নির্বাচনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন না? দাবি করা দোষের কিছু নয়, তবে মব তৈরি করে চাপ সৃষ্টি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়।

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: [email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)