গরিব হরিজনদের ওপর সিটি করপোরেশনের এই আক্রোশ কেন

উচ্ছেদ না করতে হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুদের মিনতি। ১১ জুন, রাজধানীর বংশাল থানার আগা সাদেক রোডেছবি: সংগৃহীত

যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশে কেউ ঘরহীন থাকবেন না, সেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পুরান ঢাকার বংশালের আগা সাদেক রোডের মিরনজিল্লার সুইপার কলোনির একাংশের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করছে, তাঁদের বিকল্প কোনো আবাসানের ব্যবস্থা না করেই। এরা হরিজন নামে পরিচিত।  

ব্রিটিশ আমলে ভারতের তেলেগু এলাকা থেকে আসা এই হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন কয়েক শ বছর ধরে এই কলোনিতে বসবাস করে আসছেন। নগরবাসীর সেবার জন্য তাঁদের আনা হয়েছিল। তাঁরা স্বেচ্ছায় এসে ঢাকা শহরে গেঁড়ে বসেননি। কথায় বলে, কাজ নেই তো খই ভাঁজ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এ পর্যন্ত নগরবাসীকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কোনোটাই পূরণ করতে পারেননি। যানজট সমস্যায় সিটি করপারেশনেরও দায় আছে, সেই সমস্যা সমাধানে সংস্থাটি তেমন কিছুই করতে পারেনি। এক ঘন্টার বৃষ্টিতে ডুবে যায় দক্ষিণের বড় একটি অংশ। এর জন্য দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার করাটা জরুরি, সেটাও তারা করতে পারেনি। মশা ও ডেঙ্গুর হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে পারেনি।

এখন কাঁচাবাজার করার নামে হরিজনদের কলোনির একাংশ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। যারা ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাদের প্রতি এই নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ কেন? তাঁরা তো এই শহরেরই বাসিন্দা, সিটি করপোরেশনেরই ভোটার, এ দেশেরই নাগরিক।

মিরনজিল্লার সুইপার কলোনিতে প্রায় চার হাজার লোক বাস করেন। এখানে একটি মন্দির ও একটি বিদ্যালয় আছে। সিটি করপোরেশনের গতকালের অভিযানে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলো পাশের মন্দির, বিদ্যালয় ও  কমিউনিটি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই  সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছিন্নতা কর্মী হলেও কর্তৃপক্ষ তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। তারা বলছে, সাচিবিক আদেশে নিয়োগ পাওয়া স্থায়ী কর্মীরাই ঘর পাবেন। অস্থায়ী কর্মীদের ঘর দেওয়া হবে না। তাঁদের অবৈধ বলা হচ্ছে। স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৪০ জন। অথচ সেখানে প্রায় পাঁচ শ পরিবার বাস করে। যারা ঘর পেয়েছেন, তারা কেউ চাবি নেননি। তাদের দাবি, সবাইকে ঘর দিতে হবে। না হলে তারাও নতুন ঘরে উঠবে না। হরিজন বলে্ই তাদের মধ্যে এই সহমর্মিতা।

এই হরিজনেরা সমাজে ‘অচ্ছুত’। কেউ তাঁদের ঘরভাড়া দেয় না। এমনকি রেস্তোরাঁ–হোটেলেও তাঁদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আছে। আগে ভোরে ঢাকার রাস্তায় বের হলে একটি সাধারণ চিত্র দেখা যেত। প্রত্যেক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর হাতে ঝাড়ুর সঙ্গে একটি টিনের মগ থাকত। কেননা ভদ্রলোকদের হোটেল–রেস্তোরাঁয় তাঁদের বসতে দেওয়া হয় না। রেস্তোরাঁ থেকে চা এনে টিনের মগে খেতে হয় তাদের। এভাবেই আমরা ‘বর্ণবাদ’ টিকিয়ে রেখেছি।

বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না করে কাউকে উচ্ছেদ করা কেবল অমানবিক নয়, বেআইনিও। সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গরিব হরিজনদের উচ্ছেদ করেই উন্নয়ন করতে চায়। এমনকি শত শত বছর ধরে যাঁরা সেখানে আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করেন না।

যাঁরা এই দেড় কোটি জন–অধ্যুষিত ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, সেই মানুষগুলোর প্রতি কেন এই নিষ্ঠুর আচরণ?

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এর আগেও একাধিক সুইপার কলোনি ধ্বংস করে সেখানে বহুতল ভবন তৈরি করেছে। ভোটের সময় তাঁদের প্রয়োজন হয়, কিন্তু ভোট চলে গেলে তাঁদের খোঁজ রাখেন না কেউ। অথচ চিন্তা করুন, এই মানুষগুলো একদিন নগর পরিচ্ছন্নতার কাজ বন্ধ করলে কী দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।  

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গো ধরেছে, মিরনজিল্লা এলাকায় বহুতল কাঁচাবাজার করবে। বাজার মানে সিটি করপোরেশনের পোয়াবারো। তারা যত বেশি মার্কেট করতে চান করুন। কিন্তু হরিজনদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে কেন।

আরও পড়ুন

একজন হরিজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানতে পা্রলাম, স্থানীয় কাউন্সিলর, যাকে তারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, মার্কেট বানাতে তাঁর উৎসাহ বেশি।

হরিজন নেতারা চেয়েছিলেন, সিটি করপোরেশনে স্মারকলিপি দেওয়ার সময় তিনি যেন উপস্থিত থাকেন। কিন্তু কাউন্সিলর সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তাদের সঙ্গে যাবেন না। কেননা মার্কেট হলে তাঁর লাভ। তিনিও কমিশন পাবেন।

বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না করে কাউকে উচ্ছেদ করা কেবল অমানবিক নয়, বেআইনিও। সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গরিব হরিজনদের উচ্ছেদ করেই উন্নয়ন করতে চায়। এমনকি শত শত বছর ধরে যাঁরা সেখানে আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করেন না।

অন্যদের মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তও হরিজন নেতাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘সরকারি দল এবার যে নির্বাচনী ইশতেহার করেছে, সেখানে যেসব অঙ্গীকার তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, অনগ্রসর হরিজন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তাঁদের বাসস্থানের মতো বিষয়ের উন্নতিতে সরকার অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে। এটা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দিয়েছি। তাঁদের বলেছি, পুনর্বাসন না করে কাউকে উচ্ছেদ করা আইনবিরুদ্ধ। আপনারা তাঁদের আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এটাই প্রথম উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলার নামে গরিব মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা নয়।

এর আগে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএসসিসি ঢাকা মহানগরের যাত্রাবাড়ী এলাকার ধলপুরের তেলেগু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানেও হরিজনেরা প্রতিবাদ করেছেন। মানববন্ধন করেছেন। শেষ পর্যন্ত সাবেক রেলমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাঁরা সেখানে থাকতে পারছিলেন।

এবারে সিটি করপোরেশন কি গরিব হরিজনদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য করবে? যারা বিদ্যালয় বা মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা সেখানে কদিন থাকবেন। মন্দির বা বিদ্যালয় কোনোটিই বসবাস করার জন্য নয়।

সিটি করপোরেশনের এই তুঘলকী কাণ্ডে সাংবাদিক বন্ধু মনোজ দে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘জনগণের করের টাকায় কেনা এই বুলডোজার বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালনারেবল জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার মিরনজিল্লা এলাকায় তেলেগু ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের অবৈধ তকমা দিয়ে উচ্ছেদ করছে সিটি করপোরেশন। অথচ কয়েক প্রজন্ম ধরে এই মানুষগুলো এখানেই বসবাস করে আসছেন। এ রকম একটা ভালনারেবল আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেখানে অত্যাধুনিক কাঁচাবাজারের মতো কিছু বানানো হবে বলে। এর থেকে নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?’

কয়েক শ বছর ধরে যারা সেখানে বসবাস করে আসছেন, তাঁরা কেন অবৈধ হবেন। আর যারা সিটি করপোরেশনে উড়ে এসে বসলেন, তাঁরা সাধু বটে।

গরিব হরিজনদের ওপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এই আক্রোশ কেন?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি