মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেনের হ্যাটট্রিক স্বপ্ন সফল হবে কি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

বিষয়টি বেশ অদ্ভুত। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব যেভাবে কমছে, তাতে এককালে এই অঞ্চল থেকে ব্রিটিশদের পশ্চাদপসরণের কথা মনে পড়তে পারে। এ অঞ্চলের দেশগুলো একদা প্রবল দাপুটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে যেভাবে পরিত্যাগ করেছিল, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন ঘটতে চলেছে আবার।

বিশ্বের ক্ষমতাসীন সরকার ও কর্তৃত্ববাদী নেতারা ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে ‘স্বাধীন’ হতে চাইছেন। তাঁদের কেউ কেউ গণতান্ত্রিক পন্থা বেছে নিয়েছেন, আবার কেউ কেউ নতুন মিত্র খুঁজে নিয়েছেন। মহাক্ষমতাধর একক শক্তির বদলে বিশ্ব একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে।

আরও পড়ুন

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পরিচালনার দায়িত্বে থাকা নিষ্ঠুর রাজপরিবারগুলো তাদের জনগোষ্ঠীর ওপর একটি সমজাতীয় পরিচয় চাপিয়ে দিয়েছে। আর আর্থিক প্রভাব, তেল ও খেলা দিয়ে তারা বহির্বিশ্বে তাদের ক্ষমতা দেখাচ্ছে। কৌশলগত এই গুরুত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব তাদের রক্ষক—এ ধারণাকে তারা এখন প্রত্যাখ্যান করছে।

ইসরায়েলে কট্টরপন্থী ইহুদি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ চেহারা কী হবে, সে সম্পর্ক সুস্পষ্ট ঘোষণা চেয়ে বিরোধে লিপ্ত। তারা এই অঞ্চল নিয়ে ওয়াশিংটনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ প্রান্তে এসে এখানে যে সহিংসতা ঘটেছিল, তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে আবারও।

আরও পড়ুন

তুরস্কে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, যিনি কিনা একটি ক্ষয়প্রাপ্ত সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী, তিনি নিজেও পূর্বকে পশ্চিমের বিরুদ্ধে কিংবা উল্টো করে বলতে গেলে পশ্চিমকে পূর্বের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো, ইইউ, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সমানতালে খেলেও যাচ্ছেন।

আগামী বছর নির্বাচন সামনে রেখে বাইডেন প্রায় অসম্ভব একটা হ্যাটট্রিক করতে চাইছেন। প্রথমত, ইরানের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন, সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী কিছু করা।

আরও পড়ুন

প্রথমেই ধরা যাক ইরানের কথা। কাতারে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কারাবন্দী আমেরিকানদের মুক্তির বিনিময়ে ইরানের আটকে রাখা ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করার ব্যাপারে আলোচনা বেশ অনেক দূর এগিয়েছে। দুই পক্ষই রাশিয়ায় ইরানে তৈরি সামরিক ড্রোন বিক্রি বন্ধের ব্যাপারে আলোচনা করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। তেহরানের কথিত পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত করতে হলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে—ইরানের সবচেয়ে অজনপ্রিয়, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সরকারের দাবি হলো এ-ই। এ আলোচনাও এগোচ্ছে।

এরপরে আসে ইরানের পুরোনো শত্রু সৌদিদের কথা। চীনের পৌরোহিত্যে তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে মধ্যস্থতা এবং মস্কোর সঙ্গে সৌদি আরবের সখ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কার্যত প্রধান নেতা মোহাম্মদ বিন সালমানকে পাশে চায়। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র চায় আব্রাহাম-অ্যাকর্ডের মতো সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের একটা চুক্তি হোক।

আরও পড়ুন

এ চিন্তা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে ইরানের মতো একটি বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কর্মসূচিতে সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত; যদিও এ কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। জেরুজালেমের কপালে ভাঁজ পড়েছে এখনই। জো বাইডেন অবশ্য বলছেন, কোনো চিন্তা নেই। সৌদি ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে দুটি দেশই পাবে মার্কিন সহায়তার নিশ্চয়তা এবং অস্ত্র। এভাবে তিনি চীনকে এ অঞ্চলের রাজনীতির কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিতে চান।

২০১৮ সালে জামাল খাসোগি খুন হওয়ার পর বাইডেন সৌদি আরবকে একঘরে করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সৌদি–ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে নির্বাচনের আগেই বাইডেন বিজয়ের কিঞ্চিৎ স্বাদ পেতে পারেন। কারণ, এ স্তর থেকে তিনি তাঁর তৃতীয় পরিকল্পনা, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে পারবেন।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেকোনো উপায়ে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি করতে চান। সৌদি আরবও চায়; অন্তত কাগজে–কলমে। তবে তার বদলে তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একটা বাস্তব অগ্রগতি দেখতে চায়। নেতানিয়াহুর সরকারে দক্ষিণপন্থী অংশটি কোনো রকম ছাড় দিতে নারাজ। নেতানিয়াহু বাইডেনের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় বলেনই না। তার ওপর আবার এই অক্টোবরে চীনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

বাইডেনের হ্যাটট্রিক করার এই স্বপ্নকে বিভ্রম বললেও ভুল হয় না। স্থানীয় নানা নেতিবাচক বিষয়কে পাশে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, সময় তাঁর পক্ষে নেই এখন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আঞ্চলিক নেতাদের মনেও প্রশ্ন, তিনি আর কত দিন ক্ষমতায় আছেন, ট্রাম্প কি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন?

আরও পড়ুন

অন্যভাবে বলতে গেলে, কেন বিশ্বের কম শক্তিধর দেশগুলো প্রভাববলয় থেকে মুক্তি চাইবে না? কেন তারা তাদের মিত্র খুঁজে নিতে পারবে না? পরাশক্তির কাল এবং জাতির অপরিহার্যতার ধারণা শেষ হতে চলছে। বাইডেন হয়তো চাইবেন এই প্রভাব টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু ব্রিটেন যেমন সাম্রাজ্যবাদের যুগ হারিয়েছে, আমেরিকান শতকও ইতিহাস থেকে দ্রুত মুছতে শুরু করেছে।

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

সাইমন টিসডল গার্ডিয়ান–এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক