রাশিয়া ও ইরানের বাণিজ্য করিডর কতটা আলোর মুখ দেখবে?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে অনেক বিষয়ে মতৈক্য না থাকলেও পশ্চিমারা একঘরে করে দেওয়ার পর দেশ দুটি ‘নিষেধাজ্ঞার অক্ষ’ হিসেবে একসঙ্গে চলছে। এ উদ্দেশ্যে ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর বা আইএনএসটিসি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে তারা। আইএনএসটিসি হলো ভারত, ইরান, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপকে রেল ও সমুদ্রপথে একসূত্রে বেঁধে ফেলার প্রকল্প। ২০০০ সাল থেকে প্রকল্পটি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলেও সেটি কখনো বাস্তব রূপ পায়নি। পশ্চিমাদের কাছে একঘরে হয়ে পড়ার পর ইরান ও রাশিয়া আইএনএসটিসি প্রকল্পটি পুনর্জীবনের পথ খুঁজছে। প্রশ্ন হলো, এই করিডর কি আদৌ বাস্তবে রূপ পাবে।

আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য করিডর নির্মাণ করা রাশিয়া ও ইরান দুই পক্ষের কৌশলগত পরিকল্পনাকারীদের কাছেই সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। কেননা আজারবাইজানকে হুমকি মনে করে ইরান। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শিয়া অধ্যুষিত প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনাও বেড়েছে। বিশেষ করে আরাস নদীকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দুই দেশই সামরিক মহড়া প্রদর্শন করেছে। এই নদী আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া থেকে ইরানকে পৃথক করেছে।

বাস্তববাদীরাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেন, আইএনএসটিসি করিডর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। আর এ মাসে তুরস্কে একটি ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনে ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার মুহাম্মেদ বাকির কালিবাফ বলেন, ‘আজারবাইজানের সঙ্গে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি আছে...সম্প্রতি সেটা ঘুচে গেছে।’

ইরান যখন বলছে, আইএনএসটিসি করিডর থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে, সে সময়ে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট এলহাম আলিয়েভ জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের আজারবাইজান অংশের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। এটি চালু হলে আজারবাইজানের ভেতর দিয়ে ১৫-৩০ মিলিয়ন টনের কার্গো চলাচল সম্ভব হবে। এই করিডোর বাস্তব রূপ দিতে মস্কো ও তেহরান নিজেদের প্রচুর সম্পদ ব্যয় করছে। দুই দেশের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি আস্তারা-রাস্ত-কাজভিন রেলপথ নির্মাণ শেষ করার ব্যাপারে আলোচনা করেছে। এটি শেষ হলে রাশিয়া, আজারবাইজান ও ইরানের এখনকার রেলপথ আইএনএসটিসি করিডরের সঙ্গে যুক্ত হবে। মস্কো ও তেহরান আঞ্চলিক এই নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে।

বর্তমান ভূরাজনৈতিক যে বাস্তবতা, তাতে ইউরোপের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে ব্যবসার জন্য রাশিয়া ও ইরানকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করবে না। আবার একই সঙ্গে আইএনএসটিসি করিডরের সাফল্য এশিয়ার বড় শক্তির দেশ, যেমন ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে কতটা ব্যবসা–বাণিজ্যে আগ্রহী হয়, তার ওপরও নির্ভর করে।

এই প্রকল্পের আরও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এ মাসেই রাশিয়া ও ইরান কাস্পিয়ান সাগরে কার্গো জাহাজ চলাচলে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি ইঙ্গিত করছে, দুই দেশ শুধু স্থলপথে নয়, কাস্পিয়ান সাগর দিয়েও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চায়। ইরানের আব্বাস বন্দরে পরিবহন-সহায়ক উপকরণের একটি হাব তৈরির জন্যও দুই পক্ষে আলোচনা হয়েছে। এ সপ্তাহে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেও কাস্পিয়ান সাগরে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছিল।

ইরানের সঙ্গে রাশিয়া সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতেই বেশি আগ্রহী হবে। কেননা, প্রধান প্রধান সব সমুদ্রপথেই পশ্চিমাদের আধিপত্য রয়েছে, আর রাশিয়ার জাহাজের ওপর বিধিনিষেধও দিয়ে রেখেছে তারা।এরপরও ক্রেমলিন বিকল্প পথ খোলা রাখছে। এ মাসেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ‘জ্বালানি, পরিবহন ও লজিস্টিক খাতে যৌথ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন’ বলে ঐকমত্যে পৌঁছান।

আরও পড়ুন

আইএনএসটিসি যদি বাস্তব রূপ পায়, তাহলে পুবের বাজারে রাশিয়া ও ইরানের কোম্পানিগুলো আবার নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে। নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। কিন্তু সব পক্ষের নিশ্চয়তা না পেলে বাণিজ্য করিডর তৈরি করা হলে ভবিষ্যতে একগাদা প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হবে। প্রথমত, এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া কি নিজেদের অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? রাশিয়ান সরকার দাগিস্তানের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর খাসাভইয়র্ট ও ডেরবেন্টের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভে এই অঞ্চলটিতে অশান্ত হয়ে আছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যদি হেরে যায়, তাহলে দাগেস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই তীব্র হবে। নৃতাত্ত্বিকভাবে রাশিয়ান জনগোষ্ঠী সেখানে মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

দ্বিতীয়ত, বর্তমান ভূরাজনৈতিক যে বাস্তবতা, তাতে ইউরোপের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে ব্যবসার জন্য রাশিয়া ও ইরানকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করবে না। আবার একই সঙ্গে আইএনএসটিসি করিডরের সাফল্য এশিয়ার বড় শক্তির দেশ, যেমন ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে কতটা ব্যবসা–বাণিজ্যে আগ্রহী হয়, তার ওপরও নির্ভর করে।

আরও পড়ুন

তৃতীয়ত, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে বিশাল আকারের পরিবহন অবকাঠামো প্রয়োজন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বেকায়দায় পড়া মস্কোর সেই সামর্থ্য আছে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই যায়।

পরিশেষে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্ররা নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত কিংবা অন্য যেকোনো উপায়ে মস্কো ও তেহরানের এই যৌথ উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
এসব বিবেচনায় আইএনএসটিসি প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে ইরান ও রাশিয়াকে বিমান যোগাযোগের মধ্য দিয়েই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত। কেননা, আঞ্চলিক যোগাযোগ করিডর স্থাপন আঞ্চলিক আরও বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।

  • নিকোলা মিকোভিচ সার্বিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত