ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের বৈরিতা যেভাবে গত কয়দিনে তির্যক রূপ ধারণ করেছে, তা ভাবতেই অবাক লাগে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যেটিকে ‘ট্রাম্প-মাস্ক কোপ্রেসিডেন্সি’ বলা হচ্ছিল, তা এখন চরম শত্রুতায় রূপ নিয়েছে।
ছোট একটি বিষয় নিয়ে মতানৈক্যের শুরু। ট্রাম্পের নতুন বাজেট (যাকে ট্রাম্প তাঁর স্বভাব সিদ্ধ ভাষায় ‘অতি সুন্দর বাজেট’ বলে অবহিত করেছেন) নিয়ে মাস্ক তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বাজেট ‘জঘন্য ও ন্যক্কারজনক’।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ইলন মাস্ককে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি’ বা সংক্ষেপে ‘ডজ’ (বাংলায় বলা যেতে পারে—‘সরকারি দক্ষতা অর্জন বিভাগ’)-এর দায়িত্ব দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার জন্য মাস্ক যেসব পদক্ষেপ নেন তার মধ্যে ছিল ব্যাপক হারে ফেডারেল কর্মচারী ছাঁটাই এবং বিভিন্ন জনপ্রিয় কর্মসূচিতে কাটছাঁট। আর এর জন্য মাস্ককে অপ্রীতিকর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
মাস্ক মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে যথেষ্ট রাজনৈতিক কভার বা সহযোগিতা দেননি। তাঁর মতে, ট্রাম্প সরকারের খরচ কমানোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না এবং বিনা কারণে ট্রাম্প তাঁকে কাদায় নামিয়েছিলেন।
মাস্ক মনে করেন, নতুন বাজেটে ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকদের অহেতুক প্রজেক্টকে অন্তর্ভুক্ত করে খরচ বাড়িয়েছেন।
ট্রাম্পের ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি’-তে কাজ করতে গিয়ে মাস্ককে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। এতে তাঁর অনেক সময় ব্যয় হয়েছে এবং তাঁর টেসলার পরিচালনা কাজে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তাঁর প্রিয় গাড়ি কোম্পানি টেসলার লাভ গত কয় মাসে বেশ কমেছে।
কোম্পানিটি লভ্যাংশের ৭১ শতাংশ হারিয়ে ফেলেছে। গত বছরের তুলনায় বিক্রি কমেছে ১৩ শতাংশ। টেসলার শেয়ারের দামও দিন দিন কমে যাচ্ছিল। মাস্ক যখন ‘ডজ’ ও ট্রাম্প প্রশাসন থেকে বিযুক্ত হয়ে টেসলায় ফিরে যান, তখন তিনি ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তার ওপর বাজেটে খরচের বাড়াবাড়ি মাস্ককে আরও ক্রুদ্ধ করে।
মাস্ক ট্রাম্প সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি একজন অকৃতজ্ঞ লোক’। মাস্কের এই ধারণার কারণও রয়েছে। ২০২২ সালে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেন, তখন তাঁর চার পাশটায় কোনো বিশ্বস্ত নামকরা রাজনীতিবিদ বা বড় আর্থিক সাহায্যকারী কেউ ছিল না।
ট্রাম্পের বিষয়ে ধরে নেওয়া হয়েছিল ‘বুড়ো ঘোড়া’ যাঁর হোয়াইট হাউসে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রিপাবলিকান পার্টির নেতারা তাঁকে এড়িয়ে চলছিলেন; সিলিকন ভ্যালির পয়সাওয়ালারা তাঁকে পাত্তা দিচ্ছিলেন না।
সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোক ইলন মাস্ক এগিয়ে আসেন ট্রাম্পের সাহায্যে। তিনি আমেরিকা বা সারা বিশ্বে ট্রাম্পের চেয়েও কম পরিচিত ছিলেন না। আমেরিকার টেকনোক্র্যাট ও অর্থশালীদের কাছে তাঁর প্রভাব সব সময় ছিল অনেক উঁচুতে।
ট্রাম্পকে মাস্কের সমর্থন দেওয়ার পর অন্যান্য অর্থশালীরাও ট্রাম্পের জন্য তাঁদের অর্থের ভান্ডার খুলে দেন। রিপাবলিকানদের মধ্যে যাঁরা কট্টর ট্রাম্পবিরোধী ছিলেন, তাঁদের বলা হতো ‘নেভার ট্রাম্পি’। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নতুন সংগৃহীত অর্থ ঢেলে ‘নেভার ট্রাম্পিদের’ কয়জনকে রিপাবলিকান প্রাইমারি নির্বাচনে হারিয়ে দিলেন।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইরাক যুদ্ধখ্যাত প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে লিজ চেনি। অন্যান্য রিপাবলিকান নেতা যাঁরা ট্রাম্পকে এড়িয়ে চলতেন, তাঁরা ভয় পেয়ে ট্রাম্পের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলন মাস্ক ছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় অর্থদাতা। তিনি নিজে দিয়েছিলেন ২৯১.৫ মিলিয়ন ডলার। অন্য অনেকে মাস্কের প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসেন ট্রাম্পকে সাহায্য করতে।
প্রকৃতপক্ষে ইলন মাস্কই ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার নির্বাচনী ইঞ্জিন চালু করেছিলেন এবং তাঁর ‘কো-পাইলট’ ছিলেন। তাই মাস্ক যখন বলেন ‘অকৃতজ্ঞ’, তখন বোঝা যায়, তাঁর মধ্যে অনেক ক্ষোভ ও ব্যথা রয়েছে।
এক এক্স বার্তায় মাস্ক লিখেছেন, ‘আমাকে ছাড়া ট্রাম্প ২০২৪ নির্বাচনে হেরে যেতেন, এবং হাউস ও সিনেটেও রিপাবলিকানরা জয় পেতেন না।’ তাঁর এই কথায় সত্যতা আছে।
উদাহরণ স্বরূপ, পেন্টাগন স্টারলিংকের উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত ডেটা বা তথ্য দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষানীতি ও যুদ্ধজাহাজ অবস্থান পরিচালনা করে থেকে। আরেকটা উদাহরণ, নাসাকে উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট সরবরাহ করে একমাত্র ‘স্পেস এক্স’। ইলন মাস্কও জানেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনেক সংস্থা তার টেকনোলজি ছাড়া অচল। তাই তিনি ট্রাম্পের হুমকির মুখে বলেছেন, ‘তাঁর যা খুশি তাঁকে করতে দিন।’
এক সাংবাদিক মাস্ককে প্রশ্ন করেছিলেন, ট্রাম্পকে কি ‘ইমপিচ’ করে ‘শাস্তি দিয়ে প্রেসিডেন্সি থেকে বাদ’ দেওয়া উচিত? ইলন মাস্কের উত্তর ছিল, ‘হ্যাঁ’।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আর ইলন মাস্কের সঙ্গে কথা বলবেন না। তিনি হুমকি দিয়েছেন, মাস্কের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মার্কিন সরকারের সব চুক্তি তিনি বাতিল করে দেবেন। মাস্কের কোম্পানি ‘স্পেস এক্স’ পেন্টাগন ও নাসার বড় বড় প্রজেক্টগুলোর সঙ্গে জড়িত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন স্টার এক্সের এই সব চুক্তি বাতিল করা নাসা ও পেন্টাগনের পক্ষে অনেকটা অসম্ভব। কারণ মাস্কের বিভিন্ন টেকনোলজি এই দুই সংস্থার চালিকাশক্তি।
উদাহরণ স্বরূপ, পেন্টাগন স্টারলিংকের উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত ডেটা বা তথ্য দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষানীতি ও যুদ্ধজাহাজ অবস্থান পরিচালনা করে থেকে।
আরেকটা উদাহরণ, নাসাকে উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট সরবরাহ করে একমাত্র ‘স্পেস এক্স’। ইলন মাস্কও জানেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনেক সংস্থা তার টেকনোলজি ছাড়া অচল। তাই তিনি ট্রাম্পের হুমকির মুখে বলেছেন, ‘তাঁর যা খুশি তাঁকে করতে দিন।’
যাঁরা ভাববেন, ট্রাম্প-মাস্কের এই দ্বন্দ্বে পুরা রিপাবলিকান পার্টি ট্রাম্পের পক্ষে, তাঁরা ভুল করবেন। তাঁর অর্থনৈতিক রক্ষণশীল চিন্তাধারা ও নিপুণ কর্মদক্ষতার জন্য রিপাবলিকান দলে ইলন মাস্কের বিপুলসংখ্যক গুনগ্রাহী রয়েছেন। তাঁরা এখনো বুঝতে চেষ্টা করছেন, কেন এমন হলো এবং আর এর শেষ কোথায়?
রুপার্ট মারডকের ‘ফক্স নিউজ চ্যানেল’ হলো রিপাবলিকানদের অতি প্রিয় সংবাদ চ্যানেল। গত কয়দিন ধরে তাদের নামকরা পণ্ডিতেরাও বুঝতে পারছেন না, কীভাবে ট্রাম্প ও মাস্কের দ্বন্দ্ব তাঁরা ব্যাখ্যা করবেন তাঁদের দর্শকদের কাছে; কারণ এদের দুজনেই সমান প্রিয় তাঁদের কাছে।
তাঁদের প্রাইম টাইম হোস্ট গ্রেগ গার্টফিল্ড বলেছেন, ‘এটাকে মিটিয়ে নাও। নিজেদের ঝগড়াঝাঁটি বাড়িয়ে ট্রাম্পের এই স্বর্ণযুগটা নষ্ট করে দিয়ো না।’ সম্ভবত রিপাবলিকান দলের সব লোকই এইভাবে ভাবছে।
এদিকে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। নিউজ উইক সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, ইলন মাস্ক এক অনলাইন জরিপ শুরু করেছেন, যেখানে তিনি জনগণের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এখনই কি সময় একটা নতুন দল বানাবার?’
এই পর্যন্ত যত লোক ভোট দিয়েছে, তার ৮৩.৪% লোক নতুন দল গোড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আগেও তৃতীয় রাজনৈতিক দল গড়ার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। অবশ্য তখন ইলন মাস্ক ছিলেন না। আর মাস্ক এই পর্যন্ত কোনো প্রজেক্টে হার স্বীকার করেননি। তা ছাড়া ডেমোক্রেটিক পার্টির এখন যে দুরবস্থা, তাতে তারা ট্রাম্পকে কোনো কিছুতেই দমাতে পারছে না।
তাই ডেমোক্র্যাটস যাদের মূল লক্ষ্য ট্রাম্পকে বিরোধিতা করা, তারাও এগিয়ে আসবেন মাস্কের নতুন উদ্যোগের সমর্থনে।
তবে মাস্ক নতুন দল গড়লেও তিনি সেই দল থেকে কোনো দিন প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে পারবেন না। কারণ তিনি জন্মগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন। তবে তিনি কংগ্রেস ও সিনেটের নির্বাচিত সদস্যদের মাধ্যমে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তা ছাড়া আরও রয়েছে প্রক্সি প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা।
তবে এই সব অনেক দূরের ভাবনা। এখন সবাই উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে, এই দুই ক্ষমতাধরের যুদ্ধ কত দূর গড়াবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]