খালেদা জিয়া কথা রেখেছেন

খালেদা জিয়াফাইল ছবি

মানুষকে একসময় যেতে হয়। শুরু হয় নতুন এক যাত্রা। সীমাহীন সেই যাত্রায় শুধুই অনন্তকাল ধরে পথচলা। এর শুরু আছে। শেষ নেই। এই যাত্রা অনিবার্য। খালেদা জিয়াও মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে সেই অনিবার্য অনন্তের পথে যাত্রা করলেন। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ঘটনাবহুল সফরে কাটিয়ে গেলেন এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। সারা দেশের মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিলেন।

দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধের এক জীবন কাটিয়ে গেলেন খালেদা জিয়া। এই জীবনে আছে স্বামী–সন্তান হারানোর বেদনা। কঠিন লড়াই–সংগ্রামের গল্প। আবার সাফল্যের রসও তিনি আস্বাদন করেছেন। অথচ রাজনীতিতে তাঁর আসার কথা ছিল না।

দেশের এক ক্রান্তিকালে দলের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। গত শতকের আশির দশকের ঘটনা। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ সরিয়ে স্বামী জিয়াউর রহমান যখন দেশকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন, তখনই নেমে আসে দুর্দশার এক অমানিশা। একদল বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হয়। এরপর বিএনপিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিএনপির নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ।

আরও পড়ুন

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পরই বিএনপির নেতারা রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেন। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি বিএনপির সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এরপর জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়া অংশ নেন। একপর্যায়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একক নেতৃত্ব খালেদার হাতে চলে আসে। দেশজুড়ে আপসহীন নেত্রী হিসেবে তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে। জেনারেল এরশাদের সঙ্গে বিভিন্ন দলের প্রকাশ্য ও গোপন সমঝোতা গড়ে উঠলেও খালেদা জিয়ার অনমনীয় অবস্থানের কারণে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং সফল হয়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সব দল মিলে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি দল অংশ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে টলানো যায়নি। তিনিই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যান।

দেশের রাজনীতি এক শীর্ষস্থানীয় অনবদ্য চরিত্র খালেদা জিয়া। যিনি দলের কর্মী–সমর্থকদের বাইরের নিজস্ব ভাবমূর্তি গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে ক্ষমতার রাজনীতিতে এ দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে দুহাতে আগলে রেখেছে। রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া কোনো নির্বাচনেই হারেননি। কঠিন ও বিরোধী সমর্থনপুষ্ট আসন থেকেও তিনি জিতে এসেছেন।

মূলত খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থান, অনমনীয় মনোভাব শেষ পর্যন্ত লড়াই করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জনগণের পাশে থাকার কৌশলের কারণেই বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি জোট গঠন করে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি হেরে যায়। এরপর দলের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। দমন–পীড়নের শিকার হয় দলটি। ২০১৮ খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হয় মিথ্যা মামলায়।

নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪–এর আগস্ট বিপ্লব পর্যন্ত খালেদা জিয়া দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পথ অতিক্রম করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। জেলে গিয়েছেন দুবার। রাজনীতিতে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।

খালেদা জিয়ার রাজনীতির নিজস্ব একটি ধারা আছে। এই নেতৃত্বে আছে গাম্ভীর্য, প্রজ্ঞা ও কৌশলের মিশ্রণ। ৩৬ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুই কিশোর সন্তানকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন খালেদা জিয়া। এরপরের ৪৫ বছরে তিনি দেশের জন্য রাজনীতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজের নেতৃত্ব দিয়ে বহুধারায় বিভক্ত বিএনপিকে দুবার ব্যালটের রাজনীতিতে জয়ী করেছেন। একাধিকবার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ এসেছিল। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে যেতে রাজি হননি। নিশ্চিত জেল জেনেও তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন।

শেখ হাসিনা মিথ্যা মামলায় জেলে পুরে আত্মতৃপ্তি পেতে পারেন কিন্তু আজকে খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষের শোক ও ভালোবাসা নিশ্চয়ই পলাতক জীবন থেকে লক্ষ করছেন। এখানেই শেখ হাসিনাকে খালেদা জিয়া হারিয়ে দিয়েছেন।

২০০১ সালে পল্টন ময়দানে কৃষক দলের এক সমাবেশে খালেদা জিয়া
ফাইল ছবি

২.

শালীন রাজনীতিবোধ, মার্জিত আচরণ, অনমনীয়, আপসহীনতা, দূরদৃষ্টি ও আত্মত্যাগের মিশেলে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্র খালেদা জিয়া।

রাজনীতিবিদদের জীবনে দুই ধরনের পাঠই থাকে। সফলতা ও ব্যর্থতা। ফলে আলোচনা–সমালোচনা থাকেই। খালেদা জিয়াকে নিয়েও আলোচনা–সমালোচনা আছে। রাজনীতিবিদেরা কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তবে খালেদা জিয়াকে কোনোভাবেই সমালোচনার কাঠামোর ভেতরে আটকে রেখে অতিক্রম করা যায় না।

দেশের রাজনীতি এক শীর্ষস্থানীয় অনবদ্য চরিত্র খালেদা জিয়া। যিনি দলের কর্মী–সমর্থকদের বাইরের নিজস্ব ভাবমূর্তি গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে ক্ষমতার রাজনীতিতে এ দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে দুহাতে আগলে রেখেছে। রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া কোনো নির্বাচনেই হারেননি। কঠিন ও বিরোধী সমর্থনপুষ্ট আসন থেকেও তিনি জিতে এসেছেন।

রাজনীতির কণ্টকময় বন্ধুর পথ তিনি সফলতার সঙ্গে পার করে এসেছেন। মিথ্যা দুর্নীতির মামলা, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ছোট সন্তানের মৃত্যু, একাকী নিঃসঙ্গ জেলজীবন, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, শারীরিক অসুখসহ নিপীড়ন, নৃশংসতার শিকার হয়েও খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের কাছে মাথা নোয়াননি। রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়ার অর্জন বিশাল। কিন্তু কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু তাঁর গাম্ভীর্য কেড়ে নিতে পারেনি।

আরও পড়ুন

এ বছর খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছেন। সেখানে হিথ্রো বিমানবন্দরে বড় সন্তান তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা স্বাগত জানান।

এক ভিডিওতে দেখা যায়, অসুখের ভারে কাবু ও জর্জরিত খালেদা জিয়াকে বড় সন্তান তারেক রহমান জড়িয়ে ধরলে তিনি বলে ওঠেন, ‘ইনি কে?’ পাশ থেকে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান বলেন, ‘ভাইয়া, ভাইয়া।’ এটা শুনে খালেদা জিয়া আর্থরাইটিস আক্রান্ত হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে ধরতে আবেগে বলতে থাকেন, ‘আরে আরে’। ওদিকে তারেক রহমান শক্ত করে মাকে ধরে আছেন।

এই ছবি দিয়েই দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সম্পর্ক ও দায়িত্ববোধ ব্যাখ্যা করা যায়। ঠিক সন্তানের মতোই খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে শক্ত হাতে আজীবন আঁকড়ে ধরে ছিলেন। তাঁকে কখনোই বাংলাদেশের বিষয়ে টলানো যায়নি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিষয়ে তিনি কোনো ছাড় দেননি।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ছিল ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া, চাপ মোকাবিলার কৌশল, জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করা ক্যারিশমা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বগুণের পাশাপাশি উন্নয়ননীতি ও কৌশলও আলোচনার দাবি রাখে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুতই পুঁজির বিকাশ ঘটে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। তাঁর সময় নারীশিক্ষার প্রসার ঘটে। নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়।

২০১৮ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি জেলে যাওয়ার আগের দিন খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘কম বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। দেশের জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন। কারাগারে থাকতে আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমার ছোট সন্তানকে হারিয়েছি। বড় সন্তান দূরদেশে চিকিৎসাধীন। আমার স্বজনহীন জীবনে দেশবাসীই আমার স্বজন। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকব, দেশবাসীকে ছেড়ে যাব না।’ তিনি কথা রেখেছেন। খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে যাননি। নানা চাপ ও প্রলোভন মোকাবিলা করে দেশেই অবস্থান করেছেন।

খালেদা জিয়া অনন্তলোকে যাত্রা করলেও আমাদের ছেড়ে যাননি। নশ্বর পৃথিবীতে না থেকেও মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। খালেদা জিয়াও নিশ্চয়ই তাঁর নেতৃত্বগুণ ও কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

*মতামত লেখকের নিজস্ব