ট্রাম্প-পুতিনের ইউক্রেন ছকের বিরুদ্ধে কতক্ষণ টিকবে ইউরোপ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনফাইল ছবি: এএফপি

ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফের মধ্যে এই সপ্তাহে যে শান্তি আলোচনা হয়েছে, তা স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ইউক্রেন ইস্যুতে চলতে থাকা অচলাবস্থার আরেকটি উদাহরণ।

তবে যে পরিস্থিতিতে এ আলোচনা হয়েছে, তা এখন আরও স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। প্রক্রিয়াটি যে মার্কিন ও রুশ স্বার্থ দ্বারা চালিত, তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং মাঠের সংঘর্ষ আরও তীব্র হচ্ছে।

এই সপ্তাহে অগ্রগতি না হওয়ার অর্থ হলো খুব শিগগির যুদ্ধ বন্ধের আরেকটি চেষ্টা হবে। তারপর হয়তো আরও একটি চেষ্টা চালানো হবে। এভাবে একদিন এমন একটি মার্কিন-সমর্থিত সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে, যা মোটামুটি রাশিয়ার পক্ষেই যাবে।

এই প্রচেষ্টার পেছনে যে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কাজ করছে, তা এতটাই স্পষ্ট ও ধারাবাহিক যে একে উপেক্ষা করা যায় না।

জানুয়ারিতে ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফেরার পর থেকেই এটি বারবার দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি এক দিনেই যুদ্ধ শেষ করে দেবেন। বাস্তবে তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে (যেদিন ট্রাম্প প্রথমবার পুতিনের সঙ্গে সরাসরি ইউক্রেন নিয়ে কথা বলেন) তাঁর উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি একই আছে।

আরও পড়ুন

এখন তা বদলাবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং মঙ্গলবারের অচলাবস্থা হয়তো তাঁদের আরও একবার চেষ্টা করতে উৎসাহ দেবে।

এ অবস্থায় যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার ভেতরের যুক্তিও এখন সবার কাছে পরিচিত। ট্রাম্প ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে অস্বীকার করেছেন। এর বদলে তিনি পুতিনের সঙ্গে সরাসরি দ্বিপক্ষীয় একটি চুক্তির চেষ্টা করেছেন, যাতে ইউক্রেনের কিছু ভূখণ্ড হারানোর বিনিময়ে যুদ্ধ থামানো যায়।

রাশিয়া ইউক্রেনে বোমা হামলা চালায় এবং ধীরে ধীরে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করে। ইউক্রেন ও তার অন্য মিত্ররা রাশিয়াপন্থী চুক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে নিজের পরিকল্পনা কিছুটা বদলায়। এ নিয়ে আলোচনা হয়। পুতিন চুক্তিতে ‘না’ বলেন। যুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু কূটনৈতিক তৎপরতাও চলতে থাকে।

এই প্রক্রিয়া যখন বারবার চলতে থাকবে, তখন দুটি পরিণতির একটিই ঘটতে পারে। হয় এই প্রক্রিয়াকে একেবারে ব্যর্থ বলে মেনে নিয়ে চুক্তির উদ্যোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। নয়তো এর কোনো না কোনো দিক বদলানো হবে, যাতে কোনো ফল পাওয়া সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন

প্রথম বিকল্পটি, অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করা যদি সম্ভব হয়ও, তা হলেও তা ট্রাম্পের জন্য বড় অপমানের কারণ হবে। এর আরেকটি ফল হবে—যুদ্ধ আরও তীব্র, আরও প্রাণঘাতী, আরও ধ্বংসাত্মক, আরও অস্থির হয়ে উঠবে। তখন যুদ্ধ বন্ধের চাপ আবার বাড়বে। আর সেই চাপ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করবে।

দ্বিতীয় বিকল্পটি (অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়ার কোনো অংশ বদলে দেওয়া বা কিছুটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা) সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে ন্যাটো ও ইউরোপ সরাসরি মস্কোর, আর কিছুটা ওয়াশিংটনেরও নজরদারি ও চাপের মুখে পড়বে।

এ কারণেই গতকাল ক্রেমলিন ইঙ্গিত দিয়েছে, এখনো কিছু চুক্তি করা সম্ভব। অর্থাৎ এমন চুক্তি সম্ভব, যা হবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। কিন্তু তাতে ইউরোপ থাকবে না।
পুতিন খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছেন, তিনি ইউরোপকে ট্রাম্পের দুর্বল জায়গা হিসেবে দেখেন। এই সপ্তাহে উইটকফের সঙ্গে আলোচনার আগে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে দিচ্ছে না।’ কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, ‘তারা যুদ্ধের পক্ষে আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় না। কিন্তু ইউরোপ যদি শুরু করে, আমরা এখনই প্রস্তুত।’

এ কথার কিছু অংশ অর্থহীন। কিন্তু পুতিনের একটি মূল ধারণা ঠিক আছে। ইউরোপ (আরও নির্দিষ্ট করে বললে, যুক্তরাষ্ট্রবিহীন ন্যাটো) সত্যিই ট্রাম্পকে পুতিনের সঙ্গে নিজের পছন্দমতো চুক্তি করতে বাধা দিচ্ছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর এই ধারাবাহিক অবস্থান খুব একটা প্রকাশ্যে প্রশংসা পায়নি। কারণ, তারা ট্রাম্পকে খেপাতে চায় না। কিন্তু বিষয়টি স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ওভাল অফিসে জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্প ও জেডি ভ্যান্সের প্রকাশ্য অপমানের ঘটনার পর থেকেই এই প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। আর মোটামুটি তা সফলও হয়েছে।

এই তথাকথিত ‘ইচ্ছুক দেশগুলোর জোট’ বা ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরিকল্পনায় আঘাত করতে পারে। কিন্তু সে ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের হাতে নেই।

এই জোটে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ ও কানাডা রয়েছে। তারা সবাই যুদ্ধ-পরবর্তী ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও বাস্তব সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তাদের প্রচেষ্টা অনেকটাই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়েছে এবং আংশিকভাবে ন্যাটোর ভেতরেই সমন্বয় করা হয়েছে। যেমন ৩ ডিসেম্বর ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দপ্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্পষ্টভাবেই অনুপস্থিত ছিলেন।

যুদ্ধ–পরবর্তী পশ্চিমাদের ধারণা হয়তো মৃত নয়, কিন্তু এখন তা ‘ইনটেনসিভ কেয়ার’-এ আছে। ইউরোপীয় ও কিছু আমেরিকান বিশেষজ্ঞ তাঁদের সব দক্ষতা নিয়ে এটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। সত্যি কথা হলো, ট্রাম্প চাইলে এক দিনেই এটিকে শেষ করতে পারতেন।

যেভাবেই দেখা হোক, ইউক্রেনের পক্ষে ইউরোপের এই মরিয়া উদ্যোগ বারবার ট্রাম্প ও পুতিনের বিপক্ষে একটি দেয়াল তৈরি করেছে।

এ সপ্তাহে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে উইটকফের প্রস্তাবে যখন কিছু পরিবর্তন আনা হয়, তখন তা হয়েছে। ওভাল অফিসের ওই বিপর্যয়কর ঘটনার পর থেকেই জেলেনস্কির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া এই কৌশলের একটি বড় অংশ।
সব দেখে মনে হয়, মিত্রদেশগুলো জেলেনস্কির প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই ঘনিষ্ঠভাবে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিচ্ছে।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যদি কোনো দিন জেলেনস্কির বার্তা, নোট, বৈঠক ও সফরের একটি বিস্তারিত তথ্যভান্ডার প্রকাশ পায়, তাহলে সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েলের প্রভাবশালী ভূমিকা স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।

তবু এটি চিরকাল চলতে পারে না। ইউক্রেন ও ইউরোপের জন্য মূল সমস্যা হলো, ২১ শতকের ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের বিরুদ্ধে গেছে।

আরও পড়ুন

যুদ্ধ–পরবর্তী পশ্চিমাদের ধারণা হয়তো মৃত নয়, কিন্তু এখন তা ‘ইনটেনসিভ কেয়ার’-এ আছে। ইউরোপীয় ও কিছু আমেরিকান বিশেষজ্ঞ তাঁদের সব দক্ষতা নিয়ে এটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। সত্যি কথা হলো, ট্রাম্প চাইলে এক দিনেই এটিকে শেষ করতে পারতেন।

যদি সত্যিই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে রাশিয়ার সেনাদের লন্ডনের হোয়াইট হল পর্যন্ত পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের প্রধান সড়ক খ্রেশচাটিক অনেক বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। ট্রাম্প এটা ঠিকভাবে বোঝেন কি না বা বুঝলেও গুরুত্ব দেন কি না, তা বলা কঠিন।

জেলেনস্কি ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, ইউক্রেনে যদি একটি কার্যকর সরকার টিকে থাকে, তাহলে দেশটি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। তারা আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছ থেকে অর্থ ও সামরিক সহায়তা পেতেও পারে, যাতে যুদ্ধের পর নতুন করে গড়ে তোলা যায়। তবে এ সবকিছুর ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে এক বড় প্রশ্নের ওপর। সেটি হলো পশ্চিমা দেশগুলো যে ২৫৩ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করে রেখেছে, তা কি কিয়েভ পাবে, নাকি সে অর্থ আবার মস্কোতে ফিরে যাবে?

যা–ই হোক না কেন, তখন ন্যাটো আগামী দিনের হুমকি মোকাবিলায় হয়তো আর কার্যকর সংগঠন থাকবে না। এটি তখন হয়ে যেতে পারে ‘গতকালের সমাধান’। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর কাছে তখনো অস্ত্র ও সেনাবাহিনী থাকবে। তারা স্বাধীন ইউক্রেন এবং নিজেদের মূল্যবোধের পক্ষে থাকবে। লন্ডনের ইতিহাসবিদ জর্জিওস ভারুক্সাকিস যেমন বলেছেন, তাদের মধ্যে ‘নিজেদের ভুল স্বীকার ও সংশোধনের ক্ষমতা’ও থাকবে।

তবু সত্য হলো, যদি যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ইউরোপকে একাই হাতে বড় কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হবে। সেটা হবে খুবই কঠিন। এর মূল্য এত বেশি হতে পারে যে অনেক ইউরোপীয় দেশ ও তাদের নাগরিকেরা তা মেনে নিতে চাইবে না।

সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো ইতিহাস ইউরোপকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর বড় দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ইউরোপ সেই দায়িত্ব প্রয়োজনীয় মাত্রায় পালন করতে পারছে না।

  • মার্টিন কেটল দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক।
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ