শিশুর শরীর আপনার খেলনা নয়

শিশু দেখলেই আমাদের অনেকের হাত-পা নিশপিশ করে। কেউ শিশুটির এক গাল টিপে দিয়ে অন্য গালের দিকে হাত বাড়াই অথবা দুই হাতে দুই গাল টিপে দিয়ে শিশুর প্রতি আমাদের মহব্বত জাহির করতে থাকি। কেউ তাকে নিয়ে লোফালুফি শুরু করি। অনেকেই নিজের কেরামতি দেখানোর জন্য শিশুকে শূন্যে ছুড়ে আবার ধরে ফেলি সার্কাসের কায়দায়। কারও আবার অহেতুক চুমাচাটির ব্যারাম আছে। শিশুর শরীরের সব জায়গা যেন তার চেনা। চুমা দিয়ে শিশুকে অস্থির করে দেয় তারা।

শিশু মারিয়ানাকে নিয়ে বার্তা সংস্থা সিএনএনের প্রতিবেদনটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ‘সামান্য‘ চুমু কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। শুধু একটা আপাতনির্দোষ চুমু শিশু মারিয়ানাকে ১৮ দিনের বেশি বাঁচতে দেয়নি। এইচএসভি-১ নামের একটি ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল মারিয়ানা। দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। জন্মের কয়েক দিন পরই মারাত্মক সর্দি হয় মারিয়ানার। সেখান থেকে ভাইরাস আক্রমণ করে মস্তিষ্কের কোষে। এরপর মেরুদণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেহে। 

চিকিৎসক আর শিশুরোগবিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত, শিশুটি জন্ম নেওয়ার পরপরই তাকে দেখতে আসা কারও চুমু থেকেই ভাইরাসটি বাসা বেঁধেছিল ছোট্ট শরীরে। বিশেষজ্ঞরা শিশুটির মা-বাবাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাঁদের কারও শরীরে এইচএসভি-১ ভাইরাসটি ছিল না। বিশিষ্ট মার্কিন শিশুরোগ বিজ্ঞানী তানিয়া অল্টম্যান মনে করেন, কারও শরীরে এ ভাইরাস থাকলে শিশুর সংস্পর্শে এলে তা ছড়ানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষত, প্রথম দুই মাস বাচ্চাদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বেশি থাকে। শিশুটির ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। 

দেশের প্রখ্যাত শিশুস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান সব সময় বলতেন, নবজাতকের ক্ষেত্রে সংক্রমণ বেশি হয় অপরিষ্কার হাত থেকে। বাইরে থেকে এসে পরিষ্কার না হয়ে শিশুকে ধরলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। কারও হাঁচি-কাশি থাকলে তা শিশুর শরীরে ছড়িয়ে যায়। তাই এই বিষয়গুলোতে মা-বাবার একটু কড়া হওয়াই উচিত। আত্মীয়স্বজন বেজার হয় হোক, কোলে দিতে না চাইলে অনেকে গোস্‌সা করেন, রাগ হন, কিন্তু আপনার শিশুর নিরাপত্তাটা সবার আগে। 

আরও পড়ুন

একবার এক আলোচনা সভায় তিনি প্রায় অভিনয় করেই দেখিয়েছিলেন, কীভাবে বাইরে থেকে এসেই একজন আত্মীয়–পরিচিত অথবা কলিগ নবজাতককে অথবা ছোট শিশুটিকে কীভাবে কোলে নিতে চান। তিনি বলতেন, শিশুর জন্য মা-বাবার কোল বা স্পর্শ সবচেয়ে নিরাপদ। নবজাতককে যত কম নাড়াচাড়া করা যায়, তত ভালো। মা ও বাবাকেই সন্তানের পরিচর্যায় লক্ষ রাখতে হবে। 

অনেকেই শিশুকে হাতে পেলে দুই হাতে তাকে এদিক-ওদিক ঝাঁকাতে থাকেন। এ রকমের ঝাঁকুনি সরাসরি মস্তিষ্কের চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এটা হচ্ছে ‘শেকেন বেবি সিনড্রোম’। বিজ্ঞান বলছে, শিশুদের মস্তিষ্ক আনুপাতিক হারে তাদের দেহের চাইতেও বড় আকারের হয়ে থাকে। তখন তাদের ঘাড়ও থাকে নরম এবং ভঙ্গুর। তাদের পেশিও তখন একটু একটু করে গড়ে ওঠার পর্যায়ে থাকে, অবাঞ্ছিত ধাক্কা সামাল দেওয়ার মতো সুগঠিত থাকে না। এ অবস্থায় মাথা জোরে ঝাঁকুনি খেলে করোটির ভেতরে রক্তচাপ অনেক বেড়ে যায়। সেই চাপে রক্তবাহী নালি ফেটেও যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মস্তিষ্কের নানা ধরনের টিস্যু। ক্ষতির মাত্রা চিরস্থায়ী হতে পারে। 

শিশুদের শারীরিক সীমানা, ইচ্ছা ও মর্যাদাকে সম্মান করা এবং তাদের ক্ষতি বা অপমান করতে পারে, এমন কোনো কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা দরকার। আমরা যদি শিশুদের সঙ্গে বন্ধন বাড়াতে ও খেলতে চাই, তবে উভয়ের জন্য বিকল্প নিরাপদ, সম্মানজনক ও আনন্দদায়ক কার্যকলাপগুলোই বিবেচনায় নিতে হবে। আমি-আপনি আনন্দ পেলেই শিশু আনন্দ পাবে, এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। 

শিশুর শরীর নিয়ে বড়দের খেলার একটা জনপ্রিয় তরিকা হচ্ছে শিশুর নানা সংবেদনশীল অংশে সুড়সুড়ি বা কাতুকুতু দেওয়া। বড়রা বুঝতেই চান না যে এটা শিশুর ভালো না-ও লাগতে পারে। শিশু খুব ছোট বা নাজুক হলে সুড়সুড়ির বাড়াবাড়ি তাদের ত্বকের ওপর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া, জ্বালাপোড়া করা এবং আঘাতের কারণ হতে পারে। এটি শ্বাসকষ্টের সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে হাঁপানিতে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়ার ঝুঁকি বেশি। হাসতে হাসতে হেঁচকি ওঠা শুরু হয় অনেক সময়। এই হেঁচকি থেকে বড় ধরনের বিপত্তি ঘটতে পারে। এ ছাড়া একটি শিশুকে সুড়সুড়ি দেওয়া তাদের শরীর ও ব্যক্তিগত সীমানা সম্পর্কে মিশ্র সংকেত পাঠাতে পারে। 

দিল্লির প্রখ্যাত শিশুরোগবিশেষজ্ঞ সালেহা আগরওয়াল বলেন, ‘আপনার সন্তান বা যেকোনো শিশুর ওপর সুড়সুড়ির নামে আপনার পছন্দের শারীরিক স্পর্শ চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তার পছন্দকে গুরুত্ব দিন। সে কীভাবে খেলতে চায়, সেটা তাকেই ঠিক করার সুযোগ দিন।’

আরও পড়ুন

অনেকেই শিশুর গালে নিজের গাল ঘষে আনন্দ পান। যতই শেভ করা গাল আপনার হোক না কেন, শিশুর কাছে তা কাঁটা। শিশু আপনার এই আচরণে অনেক কষ্ট আর অস্বস্তিতে ভোগে। সে শুধু বলতে পারে না। যাঁরা পান খান, তাঁদের অনেকেই মুখের পান শিশুর মুখে বা ঠোঁটে ঘষে দেন ‘পরম স্নেহে’। এতে খুব সহজে আপনার মুখের লালা শিশুর মুখে চলে জেতে পারে। লালার মধ্য দিয়েও অনেক রোগ ছড়ায়।

শিশুদের শারীরিক সীমানা, ইচ্ছা ও মর্যাদাকে সম্মান করা এবং তাদের ক্ষতি বা অপমান করতে পারে, এমন কোনো কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা দরকার। আমরা যদি শিশুদের সঙ্গে বন্ধন বাড়াতে ও খেলতে চাই, তবে উভয়ের জন্য বিকল্প নিরাপদ, সম্মানজনক ও আনন্দদায়ক কার্যকলাপগুলোই বিবেচনায় নিতে হবে। আমি-আপনি আনন্দ পেলেই শিশু আনন্দ পাবে, এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক 

[email protected]