পদ ছাইড়া দ্যাও সোনার দেওরা রে...

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় পার্টির (জাপা) কাছে জাতির ঋণের কোনো কুলকিনারা নাই। যাত্রা পার্টির কায়দায় জাতিকে বহুদিন ধরে ঝুমুর ঝুমুর নাচ আর হাসি কান্নার মিশেলে অশ্রুসজল সামাজিক বিনোদন দিয়ে আসছে এই পার্টি।

একই লোকের পক্ষে একই ফুটবল খেলায় একই সঙ্গে স্ট্রাইকার আর গোলকিপার হওয়া যে কোনো ঘটনাই না, তা জাপা একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা আর সংসদে বিরোধী দলের চেয়ারে বসে ‘হাতেনাতে’ দেখিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

সংসদে প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’ আর তাঁর দলের নেতারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়ে একটি সত্যিকারের ‘জাতীয় সরকারের’ মডেল আমাদের উপহার দিয়েছিলেন।

‘সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা’র জন্য রাতারাতি খ্যাতি পাওয়া জাপা গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নানা পদের ভেলকি দেখিয়ে জাতিকে নির্মল বিনোদন দিয়েছিল। তখন থেকেই পাবলিক দলটিকে মুখে না বললেও মনে মনে বলে আসছে, ‘এমন অনেক কথাই বলো তুমি, মন থেকে যা বলো না/আবার অনেক তোমার সত্যি কথা, আমি ভাবি ছলনা।’

এখন নতুন নির্বাচনের আলাপ ঘন হয়েছে। জাপাও তার বিনোদনের বায়োস্কোপ ওপেন করেছে। আজ সেই বায়োস্কোপের মর্নিং শোতে সকাল বেলা দেখা গেছে, ‘এক ফুল, দো মালি’ ছবির মতো জাপাতেও ‘এক দল, দুই চেয়ারম্যান।’ তাঁদের একজন ভাবি (রওশন এরশাদ), আরেকজন দেবর (জিএম কাদের)।

গত ১৯ আগস্ট রওশন এরশাদ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন।
ছবি: বাসস

কিন্তু ইভিনিং শোতে সেই বায়োস্কোপের গল্প বদলে গেছে। সেই গল্পে দেখা যাচ্ছে, জাপার চেয়ারম্যান দুজন নাকি একজন তা আসলে এখনো ক্লিয়ার না। জিনিসটা ‘হতেও পারে, নাও হতে পারে’ টাইপের অবস্থায় আছে।

আসন্ন নির্বাচন ইস্যুতে দেশ গরম। এর মধ্যে গত ১৯ আগস্ট রওশন গণভবনে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। এরপর রওশন জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে তাঁর দলের কোনো আপত্তি নেই। এর পরের দিন ২০ আগস্ট জিএম কাদের দিল্লি যান

সিনেমা শুরুর আগে ‘এই গল্পের সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক, বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই’ বলে যে ঘোষণা দেওয়া হয়, অনেকটা সেই কিসিমের ঘোষণা দিয়ে জাপার পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি জিএম কাদেরের ‘ব্যক্তিগত সফর’, এই সফরের সঙ্গে দেশের নির্বাচন ইস্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।

আমরা ধরে নিয়েছি, দিল্লিতে রাজনীতি নিয়ে কোনো আলাপ আলোচনা হলেও সেটিকে ধরে নিতে হবে, ‘এটি কাকতালমাত্র। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই’।

জিএম কাদের ঢাকায় ফেরার আগেই একটা বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে এল। তাতে রওশন এরশাদের সই করা একটা ঘোষণা দেখা গেল
ছবি: সংগৃহীত

এর মধ্যেই ‘পরাবাস্তব’ ঘটনা ঘটল। জিএম কাদের ঢাকায় ফেরার আগেই একটা বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে এল। তাতে রওশন এরশাদের সই করা একটা ঘোষণা দেখা গেল।

তাতে দেখা গেল, রওশন বলছেন, আজ থেকে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। সারা দিন এই নিয়ে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হলো। এ নিয়ে রওশন নিজে কোনো কথা বললেন না।

পারমাণবিক বোমা আছে কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে ইসরায়েল যেমন করে হ্যাঁ-না কিছুই বলে না (কিন্তু সবার ধারণা ইসরায়েলের কাছে এই বোমা আছে), তেমনি বিবৃতিটি রওশনই দিয়েছেন, নাকি দেননি, তা নিয়ে কিছুই বলেননি। ফলে ‘যাত্রা পালাটি’ বেশ জমে উঠল।

গল্পটি আরও জমে উঠল জাপার মহাসচিব মুজিবুল হকের কথায়। তিনি বললেন, ‘জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত কিছু ব্যক্তি ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) নাম ব্যবহার করে এমন একটি ভুয়া খবর দিয়েছেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং ঘটার সুযোগও নেই।’ তিনি ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত না হতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন

অর্থাৎ ‘সকালে এক রকম, বিকেলে এক রকম’ চরিত্রের জাপা সম্পর্কে জনমনে যে ধারণা আছে, সেই ধারণাকে এই বিবৃতি নাটক আরেক কাঠি সরেস করল। আগামী পালায় নিশ্চয়ই জিএম কাদের নতুন গল্প ও নতুন কোনো সংলাপ জুড়ে দেবেন।

২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে দলের এরশাদের সকালে ‘আছি’, বিকেলে ‘নাই’ খেলা জাতিকে খুব আমোদ দিয়েছিল। তিনি যখন বলেছিলেন, তিনি নির্বাচনে যাবেনই না, তখন আচমকা তিনি ‘কাকতালীয়ভাবে অসুস্থ’ হলেন

সেই অসুস্থতার সঙ্গেও রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে আলোচনা আছে। তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হলো। কিন্তু রওশনের নেতৃত্বে জাপা ইলেকশনে যাওয়ার এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর কাকতালীয়ভাবে এরশাদ সুস্থ হলেন।

সেই নির্বাচনের ঠিক আগে এরশাদ অসুস্থ হলেও রওশন সুস্থ ছিলেন। আর কিছুদিন আগে অতি অসুস্থ হয়ে পড়া রওশন এই নির্বাচনের আগে আবার তুলনামূলকভাবে চাঙা হয়ে উঠেছেন।

তবে ২০১৯ সালে স্বামী এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে অসুস্থ জায়গায় গেছে, তা সুস্থ হওয়ার দাওয়াই তাদের দলের কারও কাছে বলে মনে হচ্ছে না।  

এই ভাবি-দেবরের রশি টানাটানি বিষয়ক যাত্রাপালা বেশ কিছুদিন চলতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]