যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হাত মেলানো এখনো সম্ভব

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টনি ব্লিঙ্কেনছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে বেইজিং সফর করে গেছেন। এ সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তাঁর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল বেশ বিতর্কিত।

যেমন ব্লিঙ্কেন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে চীনের সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন সামরিক উপকরণ ও প্রযুক্তি পাঠানো নিয়ে সি চিন পিংকে সতর্ক করেছেন। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একচেটিয়া মালিকানা দাবি এবং ফিলিপাইনকে (যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র) বেইজিংয়ের হয়রানি করার বিষয়ে তিনি আপত্তি তুলেছেন। তাঁদের আলোচনায় চীনের বাজারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও উঠে এসেছে।

ব্লিঙ্কেন-সি চিনের বৈঠক যখন চলছিল, তখন আমি বেইজিংয়ে ছিলাম। আমি তখন সেখানে একটি সাইনো-আমেরিকান ‘ট্র্যাক টু ডায়ালগ’ শীর্ষক সংলাপে চেয়ার হিসেবে ছিলাম। নাগরিকেরা তঁাদের নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ করতে পারেন এবং নিজেদের পক্ষে কথা বলতে পারেন, তার উপায় অন্বেষণ নিয়ে সংলাপটি আয়োজন করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

যেহেতু এই ধরনের আলোচনা সরকারের কোনো স্বীকৃত বিষয় নয়, সে কারণে এসব আলোচনায় বেশ খোলামেলা কথাবার্তা হয়ে থাকে। অনেকের ভাষ্য, সেখানে উপস্থিত হওয়া আমেরিকান প্রতিনিধিরা বিতর্কিত ইস্যুগুলোর বিষয়ে ব্লিঙ্কেনের দেওয়া বার্তাকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন এবং চীনারা তাদের নিজস্ব সরকারের অবস্থানের পুনরাবৃত্তি করেছেন।

তবে সংলাপে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাস্পেন স্ট্র্যাটেজি গ্রুপের প্রতিনিধিরা যখন আলোচনার এক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোর প্রতি আলোকপাত করা শুরু করলেন, তখন সংলাপটি অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

তাঁদের কথার সারমর্ম ছিল, চীনের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করার নীতি থেকে সরে এসে তার সঙ্গে বৃহৎ শক্তি প্রতিযোগিতার নামার যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে, তা বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। অর্থাৎ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি সহযোগিতার পথও খোলা থাকতে পারে। সংলাপে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্ভাব্য সহযোগিতার সাতটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছি।

আরও পড়ুন

প্রথম এবং সবচেয়ে স্পষ্ট ক্ষেত্র হলো জলবায়ু পরিবর্তন, যা উভয় দেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যদিও চীন এখনো কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে যাচ্ছে, তবে তারা দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের পথে হাঁটছে। চীন দাবি করে, তারা ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমন হ্রাসে শিখরে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিষ্ক্রিয়তায় পৌঁছাবে। আমরা এই লক্ষ্যমাত্রা আরও এগিয়ে আনার ব্যাপারে জোর দিয়েছি।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হলো বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এরপর মহামারি আসবে কি না, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই; বরং কখন আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে। আমরা সবাই একমত যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশই কোভিড মহামারি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে লেজে গোবরে অবস্থা করে ফেলেছি এবং তার কারণে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এ কারণে এ ওর গায়ে কাদা–ছোড়াছুড়ি না করে কীভাবে ভবিষ্যতে মহামারি মোকাবিলায় পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারি, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে।

তৃতীয় ক্ষেত্রটি হলো পরমাণু অস্ত্র। চীনের আলোচকেরা বলেছেন, আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকতর আধুনিকায়ন ও উন্নত সাবমেরিন ব্যবস্থা গড়ার বিষয়ে তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবেন। এ ছাড়া পরমাণু অস্ত্র মজুতও তাঁরা অব্যাহত রাখবেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সমান ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু অস্ত্র এখনো তাদের হাতে নেই। তবে তাঁরা পরমাণু আইনকানুন মানা এবং উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশকে পরমাণু অস্ত্র বিস্তারে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হতে চান। এ ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ইতিপূর্বে একসঙ্গে কাজ করেছে।

আরও পড়ুন

চতুর্থ ক্ষেত্র হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সান ফ্রান্সিসকোতে গত শরতে সি চিন পিং ও বাইডেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুরক্ষা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলোচনায় রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আর এগোয়নি। আমাদের সংলাপে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে, এআই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রুদ্ধদ্বার আলোচনা হতে পারে। বিশেষ করে প্রযুক্তির সামরিক ব্যবহার নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হতে পারে।

পঞ্চম ক্ষেত্র হলো, অর্থনীতি। আমাদের উভয় পক্ষ একমত হয়েছিল যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উভয়ের জন্য উপকারী হবে। অবশ্য চীনারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর আমদানিতে মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তার এই নীতিকে ন্যায্যতা দিলেও চীনারা এটিকে তাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ করার জন্য পরিকল্পিত একটি ছক হিসেবে দেখেন। এরপরও অন্যান্য খাতে দুই দেশের বাণিজ্য বাড়ানো সম্ভব বলে আমাদের দুটো পক্ষই এক হয়েছে।

ষষ্ঠ ক্ষেত্রটি হলো শিল্প খাতে চীনের ওভার ক্যাপাসিটি (চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য উৎপাদন)। চীন শিল্প খাতে অস্বাভাবিক ভর্তুকি দেওয়ার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমকে অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় ফেলেছে। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে বিশদ সংলাপ হতে পারে বলে সংলাপে মত দেওয়া হয়।

আমাদের সর্বশেষ আলোচ্য বিষয় ছিল, দুই দেশের জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ পুনঃস্থাপন। কোভিড মহামারি এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতির জেরে মার্কিন ও চীনা নাগরিকদের পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীনে এ মুহূর্তে এক হাজারের কম যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই লাখ ৮৯ হাজার চীনা শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এই যোগাযোগ বাড়াতেও দুই দেশের সহযোগিতার হাত বাড়ানোর সুযোগ আছে।

● জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ