এই লেখা যখন লিখছিলাম, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার শেষ জাহাজ ‘দ্য মেরিনেট’ ভূমধ্যসাগরে ভাসছে, ধীরে ধীরে গাজার কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে গাজার জলসীমায় প্রবেশের পর বাকি ৪৪টি জাহাজ ও তার যাত্রীরা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে।
গাজার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ‘দ্য মেরিনেট’। কিন্তু সেটির পরিণতিও অন্য জাহাজগুলোর মতো হয়।
সুমুদ নামের মধ্যে যে অটলতা লুকিয়ে আছে, তা-ই যেন বাস্তব হয়ে উঠল এবারের গাজার অবরোধ ভাঙতে ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া গ্লোবালি সুমুদ ফ্লোটিলার অভিযাত্রায়।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহর যাত্রা শুরু করেছিল গাজার ১৭ বছরের অবরোধ ভাঙতে খাদ্য, ওষুধ আর শিশুদের খেলনা নিয়ে। ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হাতে আটক দুই শতাধিক অ্যাকটিভিস্ট, যাঁদের মধ্যে আছেন সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মী, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ও সাংবাদিকেরা।
এ ঘটনা আবার ২০১০ সালের মাভি মারমারার রক্তাক্ত স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে, যখন ৯ জন তুর্কি নাগরিক ইসরায়েলি কমান্ডোদের হাতে নিহত হন। তবু ফ্লোটিলার যাত্রা থামেনি। কেননা আয়োজকদের মতে, এই অবরোধ শুধু গাজাকে নয়, মানবতাকেও বন্দী করেছে।
বাংলাদেশে এই ফ্লোটিলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তর্ক চলছে। বাংলাদেশ থেকে ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া একমাত্র সদস্য শহীদুল আলমকে ‘বীর’ বলছেন, কেউ বলছেন ‘পশ্চিমা প্রপাগান্ডা’।
তরুণ কবি মীর হাবীব আল মানজুর এই প্রচেষ্টাকে ঈর্ষণীয় বিচার করে একটি কবিতা পোস্ট করেছেন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে: ‘আমি যদি হইতাম শহিদুল আলম আমারও থাকত ভিসা,/ আমি তখন কেফায়া পরতাম,/ চুল দাড়ি ত আছেই আরব গেরিলাদের মতো,/ আমার রক্তের ভিতর ইয়ামানের সাহসও চনমন করে,/ আমি চলে যাইতাম ফ্লোটিলা জাহাজ বহরে।’
আবার কিছু অ্যাকটিভিস্ট একে দেখেছেন ‘ফ্লোটিলা নাটক’ হিসেবে, কেননা ‘এরা (অভিযাত্রীরা) খুব ভালো করে জানে ইসরাইল এদের কিছুই করবে না। মাঝখান দিয়ে দুনিয়ার মানুষের আবেগটা পকেটে ভরা যাবে।’ আবার কারও মতে, পশ্চিমা দেশগুলো এ ঘটনার মাধ্যমে ইসরায়েলের গণহত্যায় তাদের রঞ্জিত হাতকে ধুয়ে ফেলার একটা চেষ্টা করছে মাত্র।
গাজার মানুষ কী বলছে, সেটা কি আমাদের দেখা উচিত নয়? হামাস কেন একে স্বাগত জানাচ্ছে? আর আমাদের এই বুদ্ধিজীবীরা কেন হাজার মাইল দূর থেকে সর্বনাশের ভয় দেখাচ্ছেন? আমাদের উচিত, এই ব্যবধানের কারণ খুঁজে বের করা, তাহলেই আমরা ফ্লোটিলার শিকড়, শহীদুলের অটলতা ও আমাদের নিজের দায়িত্ব খুঁজে বের করতে পারব—যেন সত্যের কাছাকাছি যাই, গুজবের জালে না জড়িয়ে।
এ প্রসঙ্গে একটি আরবি প্রবাদ মনে পড়ল: সাহিবুল বাইতি আদরা বিমা ফিহি—ঘরের মালিকই ভালো জানে, ঘরে কী আছে। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের সংকট বুঝতে ফিলিস্তিনিদের কথা শোনাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়।
গাজার মানুষ কী বলছে, সেটা কি আমাদের দেখা উচিত নয়? হামাস কেন একে স্বাগত জানাচ্ছে? আর আমাদের এই বুদ্ধিজীবীরা কেন হাজার মাইল দূর থেকে সর্বনাশের ভয় দেখাচ্ছেন? আমাদের উচিত, এই ব্যবধানের কারণ খুঁজে বের করা, তাহলেই আমরা ফ্লোটিলার শিকড়, শহীদুলের অটলতা ও আমাদের নিজের দায়িত্ব খুঁজে বের করতে পারব—যেন সত্যের কাছাকাছি যাই, গুজবের জালে না জড়িয়ে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা দুই দিন পরপরের ঘটনা নয়, এটি ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ কোয়ালিশনের অংশ, যা ২০০৮ সাল থেকে গাজার অবরোধ ভাঙার জন্য লড়ছে। ২০১০ সালে মাভি মারমারা এভাবে তুরস্ক থেকে ত্রাণ নিয়ে যাত্রা করলে তাতে ইসরায়েলি বাহিনী নৃশংস হামলা চালায়। হামলায় ৯ জন তুর্কি নাগরিক নিহত হন, ডজনখানেক আহত হন ইসরায়েলি কমান্ডোর হাতে।
ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, জাতিসংঘ অবরোধের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এর পর থেকে ২০১১, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৮ ও ২০২৫ সালের উদ্যোগগুলো সবই ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা বাধাগ্রস্ত, হামলার শিকার বা দখল করা হয়।
২০২৪ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মাঝেমধ্যে সাইপ্রাস ও গাজার মধ্যে একটি সমুদ্র করিডর খোলা হয়েছিল সাহায্য পৌঁছানোর জন্য। ২০২৫ সালের মার্চে ইসরায়েল তিন মাসের জন্য গাজায় পূর্ণ অবরোধ ঘোষণা করে, যেখানে কোনো সরবরাহ ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ সময়ে মে মাসে একটি গাজার এক মৎস্যজীবী নারীর নামে নামকরণ করা ‘মাদলিন’ ফ্লোটিলা ড্রোন হামলার শিকার হয়, আর জুন ও জুলাইয়ে অন্য বহরগুলো ইসরায়েলি বাহিনী আটক করে।
সুমুদ ফ্লোটিলা ২০২৫ সালের আগস্টের শেষ দিকে ওত্রান্তো, জেনোয়া ও বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে। গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে কাতানিয়া, সিরোস ও তিউনিস থেকেও বহর রওনা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর ইতালীয় বহর সিসিলিতে পৌঁছায় ও তিউনিসিয়ার জাহাজগুলো তিউনিসে একত্র হয়। চার দিন পর স্প্যানিশ বহরের একটি অংশ উত্তর তিউনিসিয়ায় পৌঁছায়, যেখানে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরে একটি প্রধান জাহাজে আগুন ধরে যায়, যা ড্রোন হামলা বলে সন্দেহ করা হয়। পরের রাতেই আরেকটি জাহাজে দ্বিতীয় অগ্নিসংযোগ হামলা ঘটে।
১৯ সেপ্টেম্বর স্প্যানিশ ও তিউনিসিয়ান বহর একত্র হয়ে সিসিলি থেকে গ্রিসের উদ্দেশে রওনা দেয়। ২২ সেপ্টেম্বর গ্রিক বহর মিলোস থেকে ক্রিটের উদ্দেশে যাত্রা করে এবং পরদিন সেখানে পৌঁছায়। ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ১১টি জাহাজে ড্রোন হামলা চালানো হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর ক্রিটে বহরগুলো একত্র হয়ে গাজার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখে।
এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন এক ডজনেরও বেশি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ, ইতালির রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল, স্পেন ও পর্তুগালের সংসদ সদস্যরা, কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রানচেসকা আলবানেস।
এর বিপরীতে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির দাবি করেন অংশগ্রহণকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে কারারুদ্ধ করা উচিত। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ফ্লোটিলা থামানোর অঙ্গীকার করে।
ইসরায়েলের দাবি, তাদের হামাসের সঙ্গে যোগসাজশ আছে। কিন্তু ফ্লোটিলা নেতারা বলছেন, এটা একটা অহিংস মানবিক মিশন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলকে ‘অবৈধ আক্রমণ’ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
হামাস এটিকে ‘প্রতিরোধের প্রতীক’ বলে সাধুবাদ জানিয়েছে। গাজার একজন বাসিন্দা, আয়া আল-গুসাইন, ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই জাহাজ আমাদের আশা। আমরা অবরোধে মরছি, এরা আমাদের বাঁচাতে এসেছে।’ প্রবাসী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উৎসাহের ঢেউ। তুরস্কের বন্দরে তারা জড়ো হয়ে ফ্লোটিলার জন্য দোয়া করছেন।
এসব তথ্য সার্চ দিলেই অনলাইনে পাওয়া যায়। আবার লিখলাম এ জন্য যে যাঁরা ভাবেন সুমুদ ফ্লোটিলা মূলত একটা নির্ঝঞ্ঝাট প্রমোদতরি, তাঁরা যেন বুঝতে পারেন, এই লড়াইয়ের পেছনেও কতটা রক্ত ঝরেছে।
বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া শহীদুল আলম শুধু একজন প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার নন, নাগরিক প্রতিনিধি ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলে তিনি ১০১ দিন কারাবাস করেন। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশি নির্যাতনের মুখেও তিনি রাস্তায় ছিলেন।
ফিলিস্তিনের প্রতি শহীদুল আলমের সমর্থনও পুরোনো। ২০১০ সালের ফ্লোটিলায় হামলার পর তিনি লন্ডনের ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি’ ক্যাম্পেইনে যোগ দেন। তাঁর ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী ‘ক্রসফায়ার’ গাজার ধ্বংসলীলা তুলে ধরেছে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনি ফটোগ্রাফার তামাম আল-আক্কালের সঙ্গে তিনি কাজ করেন, যিনি গাজার শিশুদের গল্প ছবিতে ধরেন। শহীদুল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাকে শিখিয়েছে, সংগ্রামে একা থাকা যায় না। ফিলিস্তিন আমার লড়াইয়ের অংশ।’
এই ফ্লোটিলায় তিনি বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে গেছেন, জুলাইয়ের অগ্রণী শহীদ আবু সাঈদের প্রতিকৃতি অঙ্কিত টি–শার্ট গায়ে দিয়ে শুধু যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তা নয়; বরং এ দেশের বিপুল মানুষের কাছে ফিলিস্তিনের স্বপ্ন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছেন। ঢাকার প্যালেস্টাইন অ্যাম্বাসি তাঁর এই যাত্রাকে ‘বাংলাদেশের গর্ব’ বলেছে।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে আপনার মনে হতে পারে, তাঁরা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধী যোদ্ধা হামাসের চেয়েও অবরোধ ভাঙার কৌশল সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন। না হলে এই সংশয় কেন?
অনেকে না হয় পশ্চিমা প্রভাবের ভয়ে অন্ধ, অনেকে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে ফ্লোটিলার মানবিক মিশনকে প্রশ্ন করছেন। আর জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যুক্ত থাকায় শহীদুল ইসলাম তো পতিত শক্তির ‘ঘোর শত্রু’, ফলে তাঁদের সমালোচনার বিষয়টি না বোঝার কারণ নেই।
কিন্তু যাঁরা গাজার মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলনের পক্ষে, হামাসকেও সমর্থন করছেন, আর হামাস যখন বলছে, ‘এটি আমাদের প্রতিরোধের অংশ,’ এবং গাজার মানুষ যখন বন্দরে অপেক্ষা করছে, তখন তাঁরা কোন যুক্তিতে গাজাবাসীর কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন?
গাজার একজন মা, উম্মে আহমেদ, সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমার সন্তানেরা খিদেয় কাঁদছে। এই জাহাজ আমাদের জন্য যেন বাঁচার আশা হয়।’
তাঁদের এই কণ্ঠকে উপেক্ষা করে আমরা কীভাবে সংশয়ী হই?
আমি একবার তাবলিগে ছিলাম। সেই দলে হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুজন ফিলিস্তিনিও ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে ইয়াসির আরাফাতকে নিয়ে আমার বিরক্তি প্রকাশ করায় তাঁরা রেগে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আবু আম্মারকে (ইয়াসির আরাফাত) বাংলাদেশি নেতাদের সঙ্গে তুলনার চোখ দিয়ে দেখবেন না। তাঁর জিহাদ, আকসার প্রতি ভালোবাসা, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে তাঁর অবদানের জন্য প্রতিটি ফিলিস্তিনি তাঁর কাছে ঋণী।’
আমার মনে হয়, ফিলিস্তিনকে ফিলিস্তিনের চোখ দিয়ে দেখা উচিত। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাদের সাহিত্য, তাদের বক্তব্যই আমাদের সবচেয়ে বেশি সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। ফিলিস্তিনের সাহিত্য পড়ুন—দারবিশের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ বা এডওয়ার্ড সাঈদের ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’। তাদের সংগ্রাম বুঝুন। যেন ফিলিস্তিনের চোখ দিয়ে দেখি, তারপর বাংলাদেশের হৃদয় দিয়ে বুঝি। কারণ, যুদ্ধটা ফিলিস্তিনিরা করছেন; আপনি, আমি দর্শকমাত্র।
মনযূরুল হক লেখক ও সাংবাদিক