খালেদা জিয়া কেন বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না

‘খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুবিধা নিতে না দেওয়া জাতিসংঘের ঘোষণার বরখেলাপ।’

সম্প্রতি খালেদা জিয়া আবারও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব বেশি সুবিধার নয়। কমবেশি ঘন ঘনই হাসপাতালে যেতে হয় তাঁকে। বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় নিয়মিতই। অনেক দিন ধরেই বিএনপি খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। বরাবরই বিএনপির দাবি নাকচ করে দিয়েছে তারা।

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বিশ্বের কোনো দেশই প্রিজনারদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠায় না। আর আমরা তাঁকে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা দিচ্ছি।

আরও পড়ুন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভবত খালেদা জিয়ার রোগব্যাধির ভয়াবহতা ও কারাগারে আটকদের বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার তথ্য সম্পর্কে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নন। তাই তিনি হুট করে এমন মন্তব্য করে ফেলেছেন। প্রথমত, খালেদা জিয়া নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। আর্থ্রাইটিসের জটিলতা থেকে এখন তাঁর যকৃতের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। রক্তে শর্করার পরিমাণও বেশি হতে পারে। সব মিলিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রকৃতপক্ষেই জটিলা আকার ধারণ করেছে।

এ রকম শারীরিক অবস্থায় বাস্তবিক অর্থেই কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন খালেদা জিয়াকে দেশে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বা সম্ভব। আমাদের দেশের তুলনায় তিনি হয়তো ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন। কিন্তু জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সেরা চিকিৎসা নয়।

আরও পড়ুন

এ জন্যই খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার দাবি করেছে বিএনপি। কারণ, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য ওষুধ প্রয়োগ ও তার পরবর্তী জটিল সেবা প্রক্রিয়ার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা আমাদের কোনো হাসপাতালেই নেই। তাই বিএনপির দাবি, সরকারের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা যদি খালেদা জিয়ার সব কটি রোগে একসঙ্গে আক্রান্ত হন, তবে কি তাঁরাও দেশে চিকিৎসা নেবেন? দেশে কি পর্যাপ্ত চিকিৎসাসুবিধা আমাদের আছে? নাকি কেবল তাঁরাই বিদেশে যাবেন?

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বারবার একই যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, খালেদা জিয়া এখনো সাজা ভোগ করছেন। কিন্তু তিনি বাড়িতে আছেন বিশেষ বিবেচনায়। এ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই খালেদা জিয়ার। কিন্তু আমরা যদি একটু আশপাশে তাকাই তাহলে তাঁদের এই যুক্তি ধোপে টিকবে না। কারাগারে আটক অনেক ব্যক্তির বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের নজির বিভিন্ন দেশে আছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আটক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এটা তো খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বিবিসি বাংলার সংবাদ অনুসারে ২০০৮ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা জেল থেকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। এর আগে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনাকে আটক করে সাবজেলে নিয়ে যায় ওই সময়ের ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ১/১১ সরকার।

আমাদের দেশেও এ রকম উদাহরণ আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো ভুলে গেছেন। তিনি এতটা বিস্মৃত কীভাবে হলেন, তা রীতিমতো অবাক করার বিষয়। আব্দুল মোমেনের নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আটক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এটা তো খুব বেশি দিন আগের কথা নয়।

বিবিসি বাংলার সংবাদ অনুসারে ২০০৮ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা জেল থেকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। এর আগে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনাকে আটক করে সাবজেলে নিয়ে যায় ওই সময়ের ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ১/১১ সরকার। শেখ হাসিনাকে শ্রবণযন্ত্রের চিকিৎসা দেশের কোনো হাসপাতাল থেকেই নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ মনোনীত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দেন। এখন বিএনপি মনোনীত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা একই পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সরকার এই পরামর্শ মানছে না।

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনা ছাড়াও কারা অন্তরীণ জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব বিদেশে গিয়ে চিকিৎসকেরা সুবিধা পেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে অ স ম রবকে সরকারি উদ্যোগে জার্মানি পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য। ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে কারাগারে আ স ম রব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মে মাসে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাজা মওকুফ না করেই জার্মানিতে পাঠানো হয়েছিল।

ওই সময় সরকারি উদ্যোগে আ স ম আবদুর রবের পাসপোর্ট জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করে দেওয়া হয়। এমনকি জার্মানিতে পাঠানোর আগে হেলিকপ্টারে করে আ স ম রবকে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়ি ঘুরিয়ে আনা হয়। সেখানে তিনি দাদির কবর জিয়ারত করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, সাজাপ্রাপ্তদের বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর নজির আমাদের দেশেই আছে।

অন্যান্য দেশেও এ রকম উদাহরণ পাওয়া যাবে। এর জন্য আমাদের খুব বেশি দূর অতীতেও যেতে হবে না। সাইবেরিয়া থেকে মস্কো যাওয়ার পথে ২০২০ সালের ২০ আগস্ট বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালিন। সেখান থেকে তাঁকে মস্কোর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে বার্লিনে নিয়ে তাঁর চিকিৎসা করা হয়। ওই সময় নাভালিকের কারাদণ্ড স্থগিত অবস্থায় ছিল।

২০১৪ সালে অর্থ তছরুপের অভিযোগে কারাদণ্ড হয় নাভালিনের। মস্কোর একটি আদালত নাভালিনকে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনি ১০ মাস গৃহবন্দী ছিলেন বর্তমানে খালেদা জিয়ার মতোই। পরে তিনি প্যারোলে মুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালে অসুস্থ হাওয়ার সময় নাভালিন প্যারোলেই ছিলেন। খালেদা জিয়া ও নাভালিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ একই ধরনের। দুজনই আর্থিক বিষয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এবং দুজনই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রাজনীতির মাঠে আটকে দেওয়ার জন্য তাঁদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া ২০১৮ সালে চীন নোবেলজয়ী লেখক লুই জিয়াওবোর স্ত্রী লুই জিয়াওকে চিকিৎসার জন্য জার্মানি যাওয়ার সুযোগ করে দেন। লুই জিয়াও গৃহবন্দী ছিলেন। লেখক লুই জিয়াওবো জেলে যকৃৎ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে লুই জিয়াওকে চিকিৎসার জন্য যেতে দেয় চীনা সরকার।

সৌদি আরবের ভিন্নমতাবলম্বী লেখক ও ব্লগার রাইফ বাদাওইয়ির স্ত্রী ও সন্তানদের গৃহবন্দী অবস্থা থেকে কানাডায় চিকিৎসার জন্য যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। রাশিয়ার কারাগারে অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া ইউক্রেনের চলচ্চিত্র নির্মাতা ওলেগ সেন্টসভকে লিথুয়ানিয়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিল বলে শোনা যায়।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় কারা অন্তরীণ বা গৃহবন্দীদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের উচিত ভালো করে খোঁজ নিয়ে মন্তব্য করা। দেশে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকলে খালেদা জিয়া প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন। প্রয়োজনে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে পাঠানো যেতে যারে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করতে হবে।

খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুবিধা নিতে না দেওয়া জাতিসংঘের ঘোষণার বরখেলাপ। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে ১৪ ডিসেম্বরের সাধারণ অধিবেশনে সাজাপ্রাপ্তদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে একটি ঘোষণা গ্রহণ করে।

ওই ঘোষণায় বলা হয়েছে, কারা অন্তরীণদের চিকিৎসা দিতে সরকার বাধ্য। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে যদি পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকে তবে কী হবে। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকার আসামিদের ইচ্ছা অনুসারে চিকিৎসা গ্রহণের সুবিধা দিতে পারে। ওপরে যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি তাদের ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছে। কখনো সরকার নিজ উদ্যোগেই বিদেশে পাঠিয়েছে। আ স ম আবদুর রবের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ইচ্ছায় সরকার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়। যেমন শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন।

বিএনপির লোকজন অভিযোগ করছেন পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে খালেদা জিয়াকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার। বিএনপির এ অভিযোগে খণ্ডানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু কথার পিঠে কথা না বলে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে আটকে রাখা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ বিষয়টি সরকারকে মনে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা ও আ স ম রব যদি জেলে থাকা অবস্থায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন, তাহলে খালেদা জিয়া পাবেন না কেন?

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক