পরিবেশ রক্ষায় রিকশাচালক যেখানে বড় অবদান রাখছেন

মানবিক কারণে পায়ে চালানো রিকশা পৃথিবীর অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থায় এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।ফাইল ছবি

বাংলাদেশে বর্তমানে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড় তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল মাস ছিল ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। উচ্চ তাপমাত্রা এবং বায়ুর অত্যধিক আর্দ্রতা মিলে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে এ অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহের মূল কারণ মানুষের দ্বারা বায়ুমণ্ডলে অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন।

বাংলাদেশের মানুষেরা বায়ুমণ্ডলে অতি সামান্য পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বর্তমান তাপপ্রবাহ এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা, জীবন এবং জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আর্শট-রক) অনুসারে, তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশে মাঠে-ঘাটে ও রোদের মধ্যে কাজ করা মানুষের কর্মঘণ্টা প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ যদিও দেশের সব জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে, তবে দরিদ্র জনগণ, বিশেষ করে রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিকসহ শ্রমজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ, জীবিকার জন্য তাঁদের তীব্র দাবদাহের মধ্যে বের হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

মানবিক কারণে পায়ে চালানো রিকশা পৃথিবীর অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থায় এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করেন। গণপরিবহন ব্যবহার করেন ২৫ শতাংশ এবং রিকশা ব্যবহার করেন ৬০ শতাংশ। রিকশা ঢাকাবাসীর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিশেষ করে সরু রাস্তায় যেখানে মোটরচালিত গণপরিবহন চলাচল করতে পারে না, সেখানে রিকশা স্বচ্ছন্দে সেবা প্রদান করছে।

রিকশা চালানো একটি অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে রিকশাচালকেরা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং বায়ুদূষণ হ্রাসে দারুণভাবে সাহায্য করেন। এর মাধ্যমে দরিদ্র রিকশাচালকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বিশ্বজনীন সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখেন। রিকশাচালকেরা নিজেরা তো কার্বন নিঃসরণ করেনই না বরং তাঁদের শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে অন্যের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে অবদান রাখছেন।

ঢাকা শহরে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং পরিবহনের চাহিদাও সেভাবে বাড়ছে। কিন্তু ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। ঢাকার পরিবহনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত যানবাহনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। যেমন ২০১০ সালে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। এটা ২০২৩ সালে ৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। মোটরসাইকেল ৭ দশমিক ৫ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখে। কিন্তু বাসের সংখ্যা বেড়েছে অতি সামান্য।

সরকারের উচিত পরিবেশদূষণে দায়ী ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিকদের ওপর কার্বন ট্যাক্স আরোপ করে তা পরিবেশের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা। রিকশাচালকদের সাহায্যে উন্নত দেশগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, রিকশাচালকদের পরিবেশবান্ধব সেবার ফলে সারা বিশ্বের মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

গণপরিবহনের স্বল্পতা এবং ব্যক্তিগত যানবাহনের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে ঢাকার যানজট অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ৭৬ শতাংশ ব্যক্তিগত যানবাহনের দখলে থাকে। একটি ব্যক্তিগত গাড়ি চালকসহ পাঁচ থেকে আটজন যাত্রী বহন করতে পারে। এর ফলে যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং মোটরচালিত যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার নেমে এসেছে, যা রিকশার গতির চেয়েও কম। এর ফলে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় রিকশার অপরিহার্যতা রয়ে গেছে।

ব্যক্তিগত মোটরচালিত যানবাহনের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খাতে জ্বালানির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে শব্দদূষণ এবং রাস্তার তাপমাত্রা। একটি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জ্বালানি খরচ ছিল ৪২ মিলিয়ন মেট্রিক টন (তেলের সমতুল্য)। এই ৪২ মিলিয়ন মেট্রিক টনের মধ্যে পরিবহন খাতে ব্যবহার হয়েছে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন। এর ৮০ শতাংশ আসে পেট্রোলিয়াম পণ্য থেকে এবং বাকি ২০ শতাংশ আসে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, মূলত সিএনজি থেকে। অর্থাৎ পরিবহন খাতে জ্বালানি মূলত আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।

যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস ও ধোঁয়া বায়ুদূষণ এবং বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের একটি অন্যতম উৎস। একটি যানবাহন থেকে কী পরিমাণ দূষিত পদার্থ নির্গত হবে, তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এগুলো হচ্ছে, যানবাহনের ধরন, ইঞ্জিনের প্রকৃতি, জ্বালানির ধরন, যানবাহনের অবস্থা, রাস্তার অবস্থা এবং ট্রাফিকের অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ, এক গ্যালন পেট্রল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমন হয় ৮ হাজার ৮৮৭ গ্রাম এবং এক গ্যালন ডিজেল থেকে ১০ হাজার ১৮০ গ্রাম।

আরও পড়ুন

যুক্তরাজ্য সরকারের একটি সমীক্ষা অনুসারে, প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ যানবাহনের ধরনের ওপর নির্ভর করে। যেমন একজন যাত্রীপ্রতি কিলোমিটার ভ্রমণে ডিজেলচালিত ব্যক্তিগত গাড়ি ১৭১ গ্রাম, পেট্রলচালিত ব্যক্তিগত গাড়ি ১৭০ গ্রাম, মোটরসাইকেল ১৪৮ গ্রাম এবং লন্ডনের লোকাল বাস ৭৯ গ্রাম কার্বন নিঃসরণ করে।

বাংলাদেশে একজন যাত্রীপ্রতি কিলোমিটারে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে, তার সঠিক তথ্য নেই। তবে এটি স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে যন্ত্রচালিত যানবাহনে বাংলাদেশি একজন যাত্রীর প্রতি কিলোমিটারে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ যুক্তরাজ্যের একজন যাত্রীর চেয়ে বেশি হবে। কারণ, বাংলাদেশে যানবাহন এবং রাস্তা উভয়ের অবস্থাই যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক যানবাহন সরকারি  নির্গমনের মান (এমিশন স্ট্যান্ডার্ড) পূরণে ব্যর্থ। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ৭৮ শতাংশ মোটরসাইকেল এবং ৭৭ শতাংশ ডিজেলচালিত যানবাহন সরকারি নির্গমনের মান পূরণে ব্যর্থ।

বাংলাদেশের রিকশাচালকদের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পরিমাপের জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনের লোকাল বাসের প্রতি কিলোমিটারে একজন যাত্রীর কার্বন ফুটপ্রিন্ট ভিত্তি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। যদিও সঠিক তথ্য নেই, অনুমান করা হয় যে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ প্যাডেল রিকশা রয়েছে। শুধু ঢাকাতেই পাঁচ থেকে ছয় লাখ প্যাডেল রিকশা রয়েছে।

প্রতিবছর হাজার হাজার লোক নদ-নদীর ভাঙন বা প্রাকৃতিক ও সামজিক কারণে জমিজমা হারিয়ে জীবিকার তাগিদে শহরে এসে রিকশা চালাচ্ছেন। ২০১৭ সালে ঢাকা শহরে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, রিকশাচালকেরা দিনে গড়ে ১১ দশমিক ৫৬ ঘণ্টা কাজ করেন, গড়ে প্রতিদিন ২৩টি ট্রিপ দেন ও ৩০ জন যাত্রী পরিবহন করেন এবং দৈনিক গড়ে ৪৪ দশমিক ৯ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেন।

রিকশার বিকল্প হিসেবে লন্ডনে একটি লোকাল বাসের মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ব্যবহার করি (যা ৭৯ গ্রাম), ঢাকা শহরের একজন রিকশাচালক গড়ে প্রতিদিন ৩ হাজার ৫৪৭ গ্রাম কার্বন সাশ্রয় করে। ঢাকার ৫ লাখ রিকশাচালক গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন কার্বন সাশ্রয় করে। সাশ্রয়কৃত কার্বনের আর্থিকমূল্য নির্ধারণের চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

বিশ্ববাজারে প্রতি মেট্রিক টন কার্বনের দাম ওঠানামা করে এবং দেশভেদে তা ভিন্ন হতে পারে। যেমন সুইজারল্যান্ডে এক মেট্রিক টন কার্বনের দাম ১৩১ মার্কিন ডলার, সুইডেনে (ইইউ দেশ) তা ১২৬ মার্কিন ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল্যকে ভিত্তি হিসাবে ধরে নিয়ে, ঢাকা শহরের রিকশাচালকদের কার্বন সঞ্চয়ের আর্থিক মূল্য প্রতিদিন দাঁড়ায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৯৮ মার্কিন ডলার (প্রতিদিন ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার সমান)।

আমরা যদি বাংলাদেশের সব রিকশাচালকদের বিবেচনা করি, তাহলে প্রতিদিন কার্বন-সাশ্রয় দাঁড়ায় ৭০ হাজার ৯৪২ মেট্রিক টন, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রতিদিন প্রায় ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি ৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সমান)।

বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থায় প্যাডেল-রিকশা কার্বনমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহনসেবা প্রদানের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গুরুত্বর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তাদের এই সেবাকে আমরা প্রায়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি না বা যথাযথ মূল্য দিই না। যেমন আমাদের বিশ্লেষণ দেখায়, রিকশাচালকেরা পরিবহন সেক্টরে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এর মাধ্যেমে সমাজ, দেশ এবং সামগ্রিকভাবে পৃথিবী উপকৃত হচ্ছে।

কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ছাড়াও, প্যাডেল রিকশাচালকেরা শব্দদূষণ হ্রাস, বায়ুদূষণ হ্রাস এবং রাস্তার উত্তাপ হ্রাসসহ আরও নানাবিধ কাজ করে থাকেন। তাঁদের এ সব অবদানের স্বীকৃতি প্রদান ও এর যথাযথ মূল্যায়ন প্রয়োজন। সরকারের উচিত তাঁদের কাজের অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করা।

এ ব্যাপারে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করা, তাঁদের স্বাস্থ্যবিমা, চিকিৎসা–সুবিধা এবং বয়স্কভাতা প্রদান নিশ্চিত করা। সরকারের উচিত পরিবেশদূষণে দায়ী ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিকদের ওপর কার্বন ট্যাক্স আরোপ করে তা পরিবেশের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা। রিকশাচালকদের সাহায্যে উন্নত দেশগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, রিকশাচালকদের পরিবেশবান্ধব সেবার ফলে সারা বিশ্বের মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

গোলাম রসুল, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।