স্বাধীনতাযুদ্ধে জার্মানপ্রবাসীদের অবদানের অজানা কথা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরুর পরপরই ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার আবেদন জানিয়ে তৎকালীন জার্মানির রাষ্ট্রপতি গুস্তাফ হাইনম্যানকে এই টেলিগ্রাম করেছিলেন অনীল দাসগুপ্ত।ছবি সৌজন্য: অনীল দাসগুপ্ত

দূর প্রবাসে থাকলে স্বদেশের জন্য অন্তর আকুল হয়। কিন্তু ৯ মাস ধরে প্রিয় দেশের দুর্দশার কথা বহির্বিশ্বে নিয়মিত প্রচার ও বিদেশিদের সমর্থন আদায়ের কাজ করা সহজ নয়।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বজুড়ে প্রবাসী বাঙালি ও তাঁদের সুহৃদদের সাহায্য–সহযোগিতার কত কথাই এখনো অলিখিত রয়ে গেছে।

মাতৃভূমির স্বাধীনতা–সার্বভৌম আর মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য সুদূর জার্মানিতে বসে প্রবাসীদের মন কেঁদেছিল। প্রবাসজীবনে নিজেদের নিত্যদিনের ব্যস্ততার মধ্যে দেশমাতৃকার জন্য তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন

১৯৭১ সালে জার্মানির পূর্ব বা পশ্চিমে বাংলাদেশিদের অবস্থান ততটা ছিল না। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পশ্চিম জার্মানিতে বসবাসরত ছাত্র অনীল দাসগুপ্ত, ড. এস কে লাহিড়ী, প্রকৌশলী মালিক প্রমুখ প্রবাসী এইড বাংলাদেশ কমিটি ইউরোপ গঠন করে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।

সেই সময় ‘৯ সার্কুলার অ্যাভিনিউ, কলকাতা–১৭’ ঠিকানা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে নানা তথ্যসম্পন্ন কাগজপত্র ও গাইডলাইন জার্মানিতে পাঠানো হতো। পশ্চিম জার্মানিতে নাগরিক সমাজের মধ্য তা বিলি করা হতো বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা জানানোর জন্য।

প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে অনীল দাসগুপ্তকে সোয়ানফুর্ট শহরের ঠিকানায় চিঠি ও তথ্যাদি পাঠানো হতো। চিঠির বিষয়াদি ডুসেলডর্ফ শহরের কাছে বসবাসরত ড. এস কে লাহিড়ীকে অবহিত করার জন্য বলা হতো। ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট এম হোসেন আলী ও ২০ সেপ্টেম্বর ও ৬ নভেম্বর সায়েদুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিগুলোয় অনীল দাসগুপ্তকে লেখা হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা ঘটনা।

আরও পড়ুন

চিঠিগুলো পড়লে অবাক লাগে। সেই সময় অস্থায়ী সরকারের চালচুলা না থাকলেও তাদের দক্ষতা ও চাতুর্য দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। টাইপ করা চিঠিগুলোয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যৌক্তিকতা ও কীভাবে বিদেশে ক্যাম্পেইন করতে হবে, সেসব বিষয়ে বিস্তৃতভাবে অবহিত করা হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার সপক্ষে অন্য প্রবাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চিঠিগুলোয় সেই মুহূর্তে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে বাংলাদেশে জুলুম–নির্যাতন ও বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করছে, তা জানানো হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা অধিকৃত অঞ্চলে গিয়ে কীভাবে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, তা লেখা হয়।

চিঠিতে বাঙালি ছাত্র ও গবেষক, যাঁরা প্রবাসে আছেন, তাঁদের পাকিস্তানে ফিরতে নিষেধ করা হয়। চিঠিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন, সহযোগিতা ও সহানুভূতি আদায়ের লক্ষ্যে পশ্চিম জার্মানি পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য, পত্রিকার সম্পাদক, রেডিও ও টেলিভিশন সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।

পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের সপক্ষে কাজ করার পাশাপাশি এইড বাংলাদেশ কমিটি জার্মানি থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নানা রকম সাহায্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরগুলোয় পাঠাত।

আরও পড়ুন

অনীল দাসগুপ্ত ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে সেই সময়কার প্রভাবশালী মার্কিন রাজনীতিক ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিরীহ বাঙালিদের রক্ষা ও শরণার্থীশিবিরগুলোয় সাহায্য–সহায়তার দরকারের কথা লিখেছিলেন।

এই চিঠির জবাবে ২০ আগস্ট সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এ বিষয়ে তাঁর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সত্বর মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করবেন বলে জানান।

উল্লেখ্য, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

১৯৭১ সালে সংবাদ পান, ২ আগস্ট থেকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে পাকিস্তানের মুলতান শহরের জেলে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে। আর এই বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ সংবাদে অনীল দাসগুপ্ত বিচলিত হন। হাতে খুব কম সময়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, কিছু করতে হব। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট তৎকালীন জার্মানির প্রেসিডেন্ট গুস্তাফ হাইনম্যানকে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার আবেদন জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম করেন তিনি।

টেলিগ্রামে তিনি জার্মান ভাষায় লিখেছিলেন, “অনুগ্রহ করে শেখ মুজিবর রহমান কে সাহায্য করুন”।

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির লেখা চিঠি।
ছবি সৌজন্য: অনীল দাসগুপ্ত

পূর্ব জার্মানিতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালিদের আরেক সুহৃদ ছিলেন সুনীল দাসগুপ্ত ও বারবারা দাসগুপ্ত। অত্যন্ত সাদাসিধে নির্লোভ অমায়িক আর সবাইকে ভালোবাসতে পারা সুনীল দাসগুপ্ত ছিলেন জার্মানিতে বসবাসরত বাঙালিদের অতি কাছের ‘সুনীলদা’।

বার্লিনের উলান্ড স্ট্রাসের হিন্দুস্তান হাউসের প্রেক্ষাপটে লেখা সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ‘চাচা কাহিনী’ বইয়ের চাচা নলিনী গুপ্ত ছিলেন সুনীল দাসগুপ্তর আপন কাকা। নলিনী গুপ্ত ছিলেন হিন্দুস্তান হাউসের কর্ণধার। কাকার সূত্র ধরেই সেই ১৯৬১ সালে তাঁর পূর্ব বার্লিনে আসা।

ঝালকাঠির বেলদাখান গ্রামের সুনীল দাসগুপ্ত কলকাতার ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

পূর্ব জার্মানিতে এসেও যুক্ত হয়েছিলেন এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। তবে বুকে সব সময় লালিত ছিল জন্মভূমির অদৃশ্য এক টান।

১৯৭১ সালে মধ্য ইউরোপের দেশগুলোয় যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের ব্যাপারে ততটা জনমত গড়ে ওঠেনি, তখন একাত্তরের জুন মাসে নিজের কর্মস্থল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে জার্মান ও অন্যান্য বিদেশি অতিথির সহযোগিতায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনেই বা গেরিলা যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এই যুদ্ধ ছড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে কর্মরত বাঙালি কূটনৈতিক ও প্রবাসী বাঙালি মহলে। বহির্বিশ্বে বাঙালি কূটনীতিকদের সপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যোগদান তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মেজর আমিন আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চিকিৎসার জন্য পূর্ব বার্লিনের পাঙ্কোভ বুখ ক্লিনিকুম হাসপাতালে আসে।

বিদেশে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান সুনীল দাসগুপ্ত ও তাঁর জার্মান স্ত্রী বারবারা দাসগুপ্ত।

২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য প্রবাসী বন্ধুদের যে সম্মাননা দিয়েছে, তাতে জার্মানির চারজন—পূর্ব জার্মানের চ্যান্সেলর এরিখ হোনিকার, পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট এবং বার্লিনের সুনীল দাসগুপ্ত ও বারবারা দাসগুপ্ত—এ সম্মাননা পান।

৫৪ বছর আগে আজকের মতো বিশ্বজুড়ে এত বাঙালি ছিল না। তবু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বজুড়ে প্রবাসী বাঙালিরা একক্কাটা হয়ে দেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধের জন্য আলাদা ফ্রন্ট খুলেছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনেই বা গেরিলা যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এই যুদ্ধ ছড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে কর্মরত বাঙালি কূটনৈতিক ও প্রবাসী বাঙালি মহলে। বহির্বিশ্বে বাঙালি কূটনীতিকদের সপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যোগদান তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।

প্রবাসে বসবাসরত ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, গবেষক, শ্রমজীবী বাঙালিরাও তাঁদের সাধ্যমতো প্রবাসে স্বাধীনতার সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁদের অবদান ছিল অপরিসীম।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
    [email protected]