বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেন এই ‘বিবৃতি-প্রীতি’

ড. ইউনূসকে নিয়ে বিচারাধীন মামলা স্থগিতের দাবি জানিয়ে বিশ্বনেতা ও নোবেল বিজয়ীদের বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মানবন্ধন

রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়াও সাম্প্রতিক দেশের আনাচ–কানাচে বিভিন্ন পেশাজীবী-স্বেচ্ছাসেবীর নামে সংগঠন গড়ে উঠেছে। নিজ সম্প্রদায় রক্ষাকবচ হিসেবে জন্ম নেওয়া এসব সংগঠন নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায়ে সোচ্চার থাকছে।

ফলে দেশে যেখানে যখন কোনো ঘটনা ঘটে, সেই কমিউনিটির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে সংগঠনগুলো প্রতিবাদ-সমাবেশ, ধর্মঘট অবতারণার মধ্য দিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির প্রমাণ দিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে, সেভাবেই নিজেদের ক্ষমতার বলয় প্রদর্শন করতে পটু। কখনো কখনো আবার পত্রপত্রিকায় বিবৃতি পাঠিয়ে সংগঠনের অবস্থান জানাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘বিবৃতি’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘বিবৃতির’ আভিধানিক অর্থ সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির দ্বারা কোনো ঘটনা, ঘটনাক্রম বা অবস্থা সম্পর্কে সত্যতা বা প্রকাশ্য নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতে হয়। সেখানে কেবল নিজ সংগঠনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড কিংবা সদস্যদের স্বার্থে বিষয়টি জোরদার হওয়ার কথা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা পত্রপত্রিকা খুললে যা দেখি, তাতে সেইগুলোকে কখনোই ‘বিবৃতি’ মনে হবে না। রাজনৈতিক সংগঠন ব্যতীত স্বেচ্ছাসেবী কিংবা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক এসব সংগঠন বা কমিউনিটির বাইরে গিয়ে ‘অযাচিত’ বিবৃতি প্রকাশ নিয়ে কেউই বিব্রতবোধ করছে না। বরং সগর্বে এই কর্ম সম্প্রদান করে, নিজেদের কখনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অনুরাগ প্রকাশ করছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, ‘বিবৃতি’ দিতে না পারলে তাঁরা বিব্রতবোধ করেন।

আরও পড়ুন

এই যে ধরেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কথা। অরাজনৈতিক এই সংগঠনটি যতটা না একজন শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করে, তার চেয়ে বেশি জাতীয় ও বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে বিবৃতি প্রদান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

কখনো তাঁরা কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করছে (প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১০, ২০২২), কখনো কখনো পত্রিকায় ফটোকার্ডের সংশোধনী দেওয়ার পর সাংবাদিকের শাস্তি দাবি করে ওই পত্রিকার নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার অভিযোগ তুলছে (কালের কণ্ঠ, মার্চ ৩১, ২০২৩) তাঁরা। আবার কখনো কখনো অতি আবেগে জাতীয় শোক দিবসের বিবৃতি দিতে গিয়ে বানান ভুল, সমাসবদ্ধ শব্দের ভুল ব্যবহার, সন্ধি, সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ, অপব্যবহৃত রীতির প্রয়োগের অভিযোগ পত্রপত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে (সমকাল, আগস্ট ১৭, ২০২৩)।

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে নোবেল বিজয়ী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং সুশীল সমাজের সদস্যসহ বিশ্বের ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের শ্রম আইনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলা স্থগিত চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর যে চিঠি দিয়েছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (ঢাকা পোস্ট, আগস্ট ৩১, ২০২৩)। বিবৃতি দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, প্রতিবাদ–সমাবেশ ও মানববন্ধনও করেছে।

সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখলাম, শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে ইউনূসের নোবেল স্থগিতের দাবিও উঠেছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই শিক্ষকেরা দাবি জানালেই নরওয়ের নোবেল কমিটি কোনো ব্যক্তিকে নোবেল দেবেন আর দাবি তুললেই কেড়ে নেবেন। যেখানে নোবেল পাওয়ার জন্য সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বছরের পর বছর কঠোর গবেষণায় মগ্ন থাকেন, সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কার নোবেল থাকবে না থাকবে সেটি নির্ধারণে রাস্তায় নেমে গেছেন। এমন হাস্যকর দাবি একজন শিক্ষক কী করে তুলতে পারেন, এটা রীতিমতো বিস্ময়কর।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, ফেডারেশন কিংবা নেটওয়ার্ক নয়, আমাদের গণমাধ্যমের সাংবাদিক-সম্পাদক, অভিনয়শিল্পী–সংস্কৃতিকর্মী, কবি-সাহিত্যিকদের সংগঠনগুলোর লাগাম ছাড়া বিবৃতি কখনোই সুখকর বার্তা দেয় না। নিজ কমিউনিটির স্বার্থে নিজেদের প্রস্ফুটন না ঘটিয়ে তাদের এই ‘অপরিণামদর্শী’ বিবৃতি–বিবৃতির খেলায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও বিরক্ত। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠাট্টা–তামাশা বা ট্রলও দেখা যায়।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নয়, ড. ইউনূসের পক্ষে খোলাচিঠি দেওয়াতে আমাদের গণমাধ্যমের প্রায় দেশের ৫০ জন সম্পাদক সার্বভৌম দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে প্রতিবাদ জানানোর খবর জানিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বাসস (সেপ্টেম্বর ২, ২০২৩)।

ড. ইউনূসের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে নিয়ে দেশের মানুষের মতভেদ গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে নিয়ে আমরা যেমন কথা বলতে পারি না, তেমনি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভিনদেশিদের কথা বলা রোধ করা আমাদের সীমাবদ্ধতার বাইরে। যদিও এই বিবৃতিদাতাদের একটি বড় অংশ নোবেলজয়ী এবং তাঁরা তাঁদের কমিউনিটির সদস্যের পক্ষেই কথা বলেছেন। তবে তাঁরাও যে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারেন কিংবা সমীহ করতে পারেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মিয়ানমারের অং সান সু চি কিংবা ভারতের নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়ি উচ্ছেদে এমন বিবৃতি লক্ষ করার মতো ছিল না। তবে প্রশ্ন এখানে নয়, প্রশ্ন হচ্ছে, কারা কোন প্রসঙ্গে বিবৃতি দেওয়ার উপযুক্ত আর কারা নয়, সেটি নিয়ে আলোকপাত করা জরুরি বলে আমি মনে করি।

আরও পড়ুন

দেখুন, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির গঠনতন্ত্রের দিকে তাকান, তাহলে সেখানে সংগঠনগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেখবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বার্থোন্নয়ন, শিক্ষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজজীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি-সমঝোতার বিধান রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামগ্রিক অধিকার ও শিক্ষাগত স্বাধীনতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ও পবিত্রতা সংরক্ষণে কাজ করা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তির দিকে নজর দিলে দেখবেন যে তারা যতটা না স্বীয় কমিউনিটির স্বার্থে বিবৃতি-মানববন্ধন-সমাবেশ করছে, তার চেয়ে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে।

নিজ নিজ সংগঠনের গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে এসব বিবৃতি প্রদান করে নিজেদের ‘জাতীয় ইস্যুতে’ সোচ্চার ভূমিকার চিত্রায়ণ করার চেষ্টা করলেও বিষয়টি যে আদৌও নিয়মতান্ত্রিক হচ্ছে না, সমাজ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন মানুষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, তা তারা অনুধাবন করতে পারছে না।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির উচিত ছিল, প্রতিবছর বাজেটের আগে সরকার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বিবৃতি দেওয়া। এই শিক্ষক সমিতির কাজ ছিল, শিক্ষকদের আবাসন সমস্যা নিরসনে রাস্তায় মানববন্ধন করা। এই শিক্ষকদের বিবৃতি দেওয়া যৌক্তিক হতো যদি তাঁরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন বিভাগ খুলতে সরকার ও উপাচার্যকে অবহিত করা।

এই শিক্ষক সমিতিগুলোর কাজ নিজেদের মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে ন্যূনতম পিএইচডি-গবেষণাপত্রের দায়বদ্ধতার লড়াই করা। ভালো একটি গবেষণাগারের জন্য কাজ করা। বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জ্ঞানভিত্তিক কিংবা প্রযুক্তিগত সহায়তার চুক্তির দাবি তোলা কিংবা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত যুগোপযোগী সিলেবাস কিংবা শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের খাবারের মানোন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া।

আরও পড়ুন

এসব বিষয় বাদ দিয়ে, তাঁরা পড়ে আছেন সাংবাদিকের শাস্তি দাবি নিয়ে, ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার স্থগিতের দাবি নিয়ে নিয়ে! প্রাসঙ্গিকতা ছেড়ে, অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির কর্মকাণ্ড কখনোই নিখাদ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নয়’ বরং সেকেলে রাজনৈতিক কিংবা পরাভবতায় আচ্ছন্ন ভাবনাকেন্দ্রিক।

একটা সময় ছিল, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমাজ বা রাষ্ট্রের বিবেক মনে করা হতো। তাঁদের পরামর্শ কিংবা পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের এই প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের কর্মকাণ্ডে দেশবাসী দিগ্ভ্রান্ত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব না করে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে নিজেদের যে সুনাম কুড়ানোর মনোবাসনা তৈরি হয়েছে, সেখানে ক্ষতি ছাড়া লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, ফেডারেশন কিংবা নেটওয়ার্ক নয়, আমাদের গণমাধ্যমের সাংবাদিক-সম্পাদক, অভিনয়শিল্পী–সংস্কৃতিকর্মী, কবি-সাহিত্যিকদের সংগঠনগুলোর লাগাম ছাড়া বিবৃতি কখনোই সুখকর বার্তা দেয় না। নিজ কমিউনিটির স্বার্থে নিজেদের প্রস্ফুটন না ঘটিয়ে তাদের এই ‘অপরিণামদর্শী’ বিবৃতি–বিবৃতির খেলায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও বিরক্ত। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠাট্টা–তামাশা বা ট্রলও দেখা যায়।

দীর্ঘদিন বেতন-ভাতা না দিয়ে অসময়ে সাংবাদিক ছাঁটাইয়ে সম্পাদকদের প্রতিবাদ দেখি না, মানসম্মত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করার দাবিতে বিবৃতি পায় না, পাঠকদের আকৃষ্ট করতে গণগ্রন্থাগার কিংবা সাহিত্যের মানোন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও দাবি আদায়ে বিবৃতি চোখে ধরে না। মালিকপক্ষের ব্যক্তিস্বার্থে সংবাদপত্রের ব্যবহার রোধে সম্পাদকেরা একমত হোন না, বিবৃতিও দেন না কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ-রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার মানসপটে বিবৃতি অনাবৃত হয়।

আরও পড়ুন

যাঁর যা ভূমিকা বা কর্মকাণ্ড, তাকে সেটি করতে দেওয়া অবশ্যই কাম্য। কিন্তু আমরা পক্ষ-বিপক্ষের বাইরের সাধারণ মানুষেরা পক্ষপাতদুষ্ট বিবৃতির ফ্যাসাদে আসল ফোকাস থেকে দিগ্ভ্রান্ত হই।

দৃষ্টিকটু শব্দ ও বাক্য চয়নে, ভুল বানানে পক্ষপাতমূলক এসব বিবৃতি যেমন গ্রহণযোগ্যতা হারায়, তেমনি বিবৃতিদাতাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমতে থাকে। তাই আমাদের ঠিক করতে হবে, আমাদের সীমাবদ্ধতার সীমানাপ্রাচীর কোথায়। আমাদের কোথায় গিয়ে থামতে হবে, সেটি জানতে হবে। বাহন থাকলে যে কেবল চলতেই হয় না, থামতে জানা হলো ওই বাহনের নিয়ন্ত্রণ। তাই সভ্য সমাজ বিনির্মাণে আমাদের আরও বেশি নির্মোহ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সবকিছুতেই রাজনীতির মোয়া বানানো ঠিক নয়। তাই আমাদের বিবৃতিদাতাদের লাগাম থাকা চাই।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]