প্রতিবার গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলে বিশ্ব স্বল্পস্থায়ী এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু শান্তি কখনো আসে না। কারণটি খুব সহজ: ইসরায়েল কখনোই কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান চায়নি। যদি চাইত, তবে আলোচনার তালিকার শীর্ষে থাকত একটাই নাম—মারওয়ান বারঘুতি; বন্দী ফাতাহ নেতা, যার মুক্তি ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে এবং বহুদিন ধরে ন্যায়বিচার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত একটি জাতির কাছে বৈধতা ফিরিয়ে আনতে পারে।
১৯৫৯ সালে পশ্চিম তীরের কোবার গ্রামে জন্ম নেওয়া বারঘুতি ১৫ বছর বয়সে ফাতাহতে যোগ দেন। ইসরায়েলি দখলদারির বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ। বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হন তাঁর বাকপটুতা ও বাস্তববাদী নেতৃত্বের জন্য। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েল তাঁকে বহিষ্কার করে। কারণ, তারা ভয় পায় শৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তরুণদের সংগঠিত করার বারঘুতির ক্ষমতাকে।
বারঘুতির জীবন মূলত সংগ্রামেরই ইতিহাস। নির্বাসনে কাটানো বছরগুলো—বিশেষত জর্ডান ও তিউনিসিয়ায়—তাঁকে পিএলওর (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) সঙ্গে যুক্ত করে এবং কূটনীতির পাঠ শেখায়। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তিনি তাতে সতর্ক আশাবাদ নিয়ে সমর্থন করেছিলেন; মুক্তির পথে একটি সম্ভাব্য ধাপ হিসেবে, চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নয়। পশ্চিম তীরে ফিরে এসে ১৯৯৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনি আইনসভা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ফাতাহর ভেতরে তিনি হয়ে ওঠেন গণতান্ত্রিক সংস্কার, জবাবদিহি ও সাম্যের ভিত্তিতে টেকসই শান্তির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠগুলোর একটি।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বারঘুতির হতাশা বাড়তে থাকে। তিনি দেখলেন, অসলো পরিণত হচ্ছে স্থায়ী দখলদারির প্রক্রিয়ায়। ইসরায়েলি বসতি বাড়ছে, চেকপোস্ট বাড়ছে, আর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) ইসরায়েলি নিরাপত্তাব্যবস্থার উপঠিকাদার হয়ে পড়ছে। তিনি সতর্ক করেছিলেন, ‘দখলদারির মধ্যে শান্তি বেড়ে উঠতে পারে না।’ কিন্তু তখন কেউ তাঁর কথা শোনেনি।
বারঘুতির দীর্ঘ বন্দিত্ব ঘিরে আন্তর্জাতিক নীরবতা পশ্চিমা গণতন্ত্রচর্চার দ্বিচারিতা উন্মোচন করে। একই সঙ্গে এটি সেই সম্ভাবনাও প্রকাশ করে—বারঘুতির প্রত্যাবর্তন ফিলিস্তিনি নাগরিক সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, ন্যায়, মর্যাদা ও আইনের ভিত্তিতে এক নতুন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
২০০০ সালে আরিয়েল শ্যারন আল-আকসা মসজিদে তাঁর কুখ্যাত সফর করেন, যা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার জন্ম দেয়। তখন বারঘুতি কোনো প্রান্তিক যোদ্ধা নন, তিনি মূলধারার নেতা, যিনি বুঝেছিলেন যে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র—দুই ধরনের প্রতিরোধই এখন ইসরায়েলেকে মোকাবিলার একমাত্র ভাষা।
২০০২ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলি বাহিনী বারঘুতিকে রামাল্লাহ থেকে অপহরণ করে। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এবং ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য’ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। পুরো বিচার চলাকালে তিনি আদালতেরই বৈধতা স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। তাঁর ঘোষণা ছিল, ‘আমি সন্ত্রাসী নই, আমি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। প্রকৃত অপরাধ হলো দখলদারি।’ আদালত তাঁকে পাঁচবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
এই বিচার আন্তর্জাতিক মহলে ‘রাজনৈতিক নাটক’ হিসেবে নিন্দিত হয়। কিন্তু তাঁর বন্দিত্ব তাঁকে ফিলিস্তিনের ‘ম্যান্ডেলা’য় পরিণত করে, হয়ে ওঠেন প্রতিরোধের এক প্রতীক, নৈতিক দৃঢ়তা ও গণতান্ত্রিক নবজাগরণের প্রতীক।
কারাগার থেকেই বারঘুতি লিখে চলেছেন, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। তিনি ফাতাহ ও হামাসের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের অবসান এবং জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে তিনি গোষ্ঠীগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে এক নেতা হয়ে উঠেছেন।
২০০৬ সালে বারঘুতি ‘প্রিজনার্স ডকুমেন্ট ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন’-এর উদ্যোগ নেন, যা আন্তর্জাতিক আইন, দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ১৯৬৭ সালের সীমানার মধ্যে রাজধানী পূর্ব জেরুজালেমসহ এক স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে ঐক্যের রূপরেখা তৈরি করে।
ইসরায়েলি কারাগারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের স্বাক্ষরিত এই দলিল এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি ঐক্যের সবচেয়ে প্রামাণ্য নকশাগুলোর একটি। এটি সশস্ত্র বিভাজন বন্ধ, জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত একক জাতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব পুনঃনিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
বারঘুতির প্রভাবের বিশেষত্ব হলো তিনি সব দলের কাছ থেকেই সম্মান পান। মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এমনকি হামাসের নেতারাও তাঁকে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করে।
ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চের জরিপ অনুযায়ী, আজ যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, বারঘুতি সহজেই মাহমুদ আব্বাস এবং যেকোনো হামাস প্রার্থীর চেয়ে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হবেন।
ইসরায়েলের বারঘুতিকে মুক্তি না দেওয়ার কারণ তাঁর কথিত অপরাধ নয়, বরং তাঁর রাজনৈতিক সম্ভাবনা। তাঁরা তাঁকে ভয় পায়। ইসরায়েলি প্রশাসন সব সময় চেয়েছে বিভক্ত এক ফিলিস্তিন, গাজায় দুর্বল হামাস, রামাল্লাহতে অনুগত পিএ আর কোনো একক জাতীয় কণ্ঠস্বর নয়।
বারঘুতি সেই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেন। তাঁর মুক্তি ফাতাহ ও হামাসের পুনর্মিলন, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে আস্থা পুনরুদ্ধার এবং এমন এক রাজনৈতিক প্রতিনিধির আবির্ভাব ঘটাতে পারে, যাকে ইসরায়েল সহজে ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘অবৈধ’ বলে উড়িয়ে দিতে পারবে না।
এ কারণেই মাহমুদ আব্বাস নিজেও বারবার বন্দীমুক্তির দাবি জানালেও সচরাচর বারঘুতির নাম উচ্চারণ করেন না। কারণ, একবার বারঘুতি মুক্তি পেলে তিনি মুহূর্তেই পিএর দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবিশ্বস্ত পুরোনো নেতৃত্বকে ছাপিয়ে যাবেন।
ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা প্রায়ই দাবি করে, ‘শান্তির জন্য ফিলিস্তিনের কোনো অংশীদার নেই।’ কিন্তু আসলে প্রকৃত নেতৃত্বের সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের হত্যা বা বন্দী করে তারাই নিশ্চয়তা দিয়েছে, যেন এমন কোনো অংশীদার না থাকে। বারঘুতির রাজনৈতিক অনুপস্থিতিই এ বয়ানকে টিকিয়ে রাখে।
কারাগার থেকে লেখা বারঘুতির চিঠিগুলোয় প্রকাশিত তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিস্ময়করভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অগ্রগামী। তিনি অহিংস প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক আইনগত পদক্ষেপ এবং জনগণভিত্তিক আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অধিকারেও জোর দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, যেকোনো শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হতে হবে দখলদারত্বের অবসান, বসতি উচ্ছেদ, সব বন্দীর মুক্তি এবং জেরুজালেমের যৌথ সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে। এটি এক মুক্তির দৃষ্টি।
বারঘুতি সহাবস্থান প্রত্যাখ্যান করেন না; তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ন্যায়বিচারবিহীন জবরদস্তি শান্তিকে। তাঁর মুক্তির ধারণা নৈতিক ও নাগরিক—গোষ্ঠীগত নয়, প্রতিশোধপরায়ণও নয়। তাঁর কথায়, ‘আমাদের মানবতা হারালে আমাদের স্বাধীনতাও অসম্পূর্ণ থাকবে।’ এ ধরনের নেতৃত্বই ইসরায়েল সহ্য করতে পারে না, যে নেতৃত্ব ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে মানবিক করে তোলে এবং জাতি ও মতাদর্শের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সরকারগুলো নিয়মিত নেলসন ম্যান্ডেলাকে প্রশংসা করে। কিন্তু ফিলিস্তিনে তাঁর জীবিত প্রতিরূপকে স্বীকার করতে পারে না। বারঘুতির মুক্তির দাবি মানে হবে এই স্বীকারোক্তি—ফিলিস্তিনি সংগ্রাম ‘সন্ত্রাসবাদের’ নয়, বরং এটি ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও জাতীয় অধিকারের প্রশ্ন।
বারঘুতির দীর্ঘ বন্দিত্ব ঘিরে আন্তর্জাতিক নীরবতা পশ্চিমা গণতন্ত্রচর্চার দ্বিচারিতা উন্মোচন করে। একই সঙ্গে এটি সেই সম্ভাবনাও প্রকাশ করে—বারঘুতির প্রত্যাবর্তন ফিলিস্তিনি নাগরিক সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, ন্যায়, মর্যাদা ও আইনের ভিত্তিতে এক নতুন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
ইসরায়েলি কারাগারে দুই দশকের বেশি সময় কাটানোর পরও মারওয়ান বারঘুতি অবিচল। তিনি শুধু ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নন, ইসরায়েলি দখলদারত্বের নৈতিক আয়নাও। ইসরায়েল যদি সত্যিই শান্তি চাইত, তাহলে তাঁকে মুক্তি দিয়ে তাঁদের নিয়ে সংলাপ শুরু করত, যাঁরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন আলোচনা হওয়া উচিত বন্দী মারওয়ান বারঘুতি ও ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে, ব্লেয়ার বা কুশনারদের নিয়ে নয়, যারা ফিলিস্তিনিদের আরও নিঃস্ব করতে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত বলতে হয়: আজ প্রকৃত বন্দী শুধু বারঘুতি নন, বন্দী রয়েছে ন্যায় ও সাম্যের শান্তির ধারণা, যেগুলোকে ভয় করে কেউ কেউ ক্ষমতার শৃঙ্খল আঁকড়ে আছে। বারঘুতির মুক্তি হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে সংঘাতের অবসান ঘটাবে না। কিন্তু প্রমাণ করবে—ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শান্তি এখনো সম্ভব।
রঞ্জন সলোমন ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে কাজ করছেন।
মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনজুরুল ইসলাম