প্রায় দুই যুগেরও বেশি আগে। বিলেতে এসেছি মাস্টার্স করতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস। মধ্যে এক ঘণ্টা বিরতি। ওই এক ঘণ্টায় আমার সারা দিনের জমে থাকা সব কাজ শেষ করার একটা দারুণ চাপ থাকত। যেমন বিভিন্ন জায়গায় ফোন করা, ই–মেইল পড়া, লাইব্রেরি থেকে নতুন বই তোলা ইত্যাদি।
কয়েক দিন পর খেয়াল করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক ও গবেষকেরা ওই সময়ে একটা স্যান্ডউইচ বা এক কাপ কফি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের ছোট ছোট বাগানের বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকেন। আশপাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটেন। একা। কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে, এমনকি পরিচিত লোক পাশে বসে থাকলেও।
ইউরোপের প্রায় সব শহর তো বটেই, এমনকি এশিয়ার অনেক শহরেই অফিসপাড়ার ভেতরে আছে ছোট ছোট বাগান। সঙ্গে বসার জায়গা। তীব্র শীত বা বেশ রাতেও সেখানে নিয়মিত লোক বসে থাকতে দেখেছি।
এই চুপ করে বসে থাকাটা হলো মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়া। আমাদের দৈনন্দিন কাজের অধিকাংশ সময় জুড়েই থাকে অন্যের সঙ্গে কথা বলা, পড়া বা লেখা।
গবেষণা বলছে, প্রতিদিন কাজের ফাঁকে নিয়ম করে মস্তিষ্ককে কোনো ধরনের কাজে ব্যস্ত না রাখলে আমাদের কাজের গতি বেড়ে যায়, প্রখর হয় আমাদের চিন্তা আর স্মৃতি।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নিয়ম করে যাঁরা স্বল্প সময়ের জন্য কোনো কিছু চিন্তা করা থেকে বিরত থাকেন, তাঁদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামক স্থানে নতুন ধরনের কোষ তৈরি হয়। জটিল সমস্যার সমাধান, নতুন কিছু শেখা ও স্মৃতিশক্তির জন্য হিপোক্যাম্পাসের ভূমিকা অপরিসীম।
মস্তিষ্কের বিশ্রামের জন্য সব সময় যে নির্জন জায়গা বা প্রকৃতির কাছে যেতে হবে, এমনটা নয়। অফিসে কাজের ফাঁকে চেয়ারে বসেও হতে পারে। আসল কথা হলো, মনকে নৈঃশব্দ্যের কাছে নিয়ে যাওয়া।
কয়েক মিনিটের জন্য হলেও কোনো কিছু চিন্তা করা থেকে বিরত থাকা। মুঠোফোনকে দূরে রাখা।
২.
এরিখ আমার প্রায় ১৫ বছরের সহকর্মী। বার্লিনে থাকেন। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব বন থেকে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি নিয়ে পিএইচডি করেছেন। ষাটের কাছাকাছি বয়স। হঠাৎ একদিন এরিখ আমাকে বললেন, তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যাচ্ছেন।
ইউরোপে আমার অনেক সহকর্মী বয়স হওয়ার বেশ আগেই অবসর নিয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, ঘুরে বেড়ানো বা নিজের শখের কাজে সময় দেওয়াই এত দিন কারণ হিসেবে শুনে এসেছি। কিন্তু এরিখের কারণটা একদম আলাদা। তিনি নতুন কিছু শিখতে চান। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। আফ্রিকান সংগীতে মাস্টার্স করার জন্য বার্লিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
মস্তিষ্ককে স্বল্প সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া যেমন দরকার, ঠিক তেমনি প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে বা জানতে ব্যস্ত রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার একক হলো নিউরন। নতুন নতুন কিছু শিখতে, জানতে ও মনে রাখতে এসব নিউরন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে।
গবেষণা বলছে, আমরা যখন নতুন কিছু জানতে বা শিখতে শুরু করি, তখন মস্তিষ্ক নতুন নিউরনের জন্ম দেয়। নিউরনগুলো একে অন্যের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করে। এতে করে মস্তিষ্কের বার্ধক্য ঠেকানো যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে নিউরোলজির একাধিক নামকরা গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে জানা গেছে, ক্রমাগত শিখতে থাকলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বেড়ে যায়। কমে যায় আলজাইমারসের মতো স্নায়ুজনিত রোগ হওয়ার আশঙ্কা। আর হ্যাঁ, কাজের প্রয়োজনে টিকে থাকতে হলে আমাদের সবাইকেই প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে হবে। অন্তত ছয় ঘণ্টা। প্রতি সপ্তাহে।
শেখার বা জানার বিষয় যেকোনো কিছুই হতে পারে। সেলাই, রান্না, বাগান করা থেকে শুরু করে অঙ্ক কষা। নতুন কিছু শেখা বা জানার জন্য এখন তো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
ইউটিউবে বিনা মূল্যে বিচিত্র বিষয় শেখার কত আয়োজন রয়েছে। দরকার শুধু ইচ্ছাটার। এ সপ্তাহেই ইন্টারনেট ঘেঁটে আর্মেনিয়ানদের বাংলায় আসার ইতিহাসটা জানলাম। ঢাকায় আরমানিটোলা টিকে থাকলেও আর্মেনিয়ানরা দুই বাংলা থেকেই প্রায় মিলিয়ে গেছে জেনে মনটা বেশ খারাপ হলো।
৩.
কাজের প্রয়োজনে নিয়মিত আমাকে ভিনদেশে যেতে হয়। অন্য দেশ মানে হোটেলে থাকা। প্রাতরাশের টেবিলে বসে লোক দেখা আমার অত্যন্ত প্রিয় অভ্যাস। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন দেশ, অনুভূতির কত বিচিত্র প্রকাশ। প্রত্যেকের হোটেলে থাকার কারণও ভিন্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অচেনা সব মানুষের সঙ্গে আলাপ করা আর হয়ে ওঠে না। তবে দেখি অনেকেই করেন।
সম্প্রতি জানতে পারলাম একাধিক গবেষণা বলছে, নতুন লোকের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ভালো। এতে আমাদের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। অক্সিটোসিনকে বলা হয় ভালোবাসার হরমোন। ভালো লাগার অনুভূতি তৈরিতে এই হরমোনের ভূমিকা রয়েছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখা গেছে, অচেনা কারও সঙ্গে আলাপে আমাদের মস্তিষ্কের প্রি ফ্রন্টাল কটেক্স সক্রিয় হয়ে ওঠে। এতে সহনশীলতা, অন্যের মতামতকে বোঝার এবং অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতা বেড়ে যায়। বাড়ে স্মৃতিশক্তিও। বেশ কয়েক বছর আগে মরক্কোর এটলাস পাহাড়ের ওপর ছোট এক গ্রামে গিয়েছিলাম। রাস্তার পাশে একজন বয়স্ক লোক পাথরে খোদাই করা দারুণ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করছিলেন। বিকেলের দিকে। চার বা পাঁচটি কাজ পড়েছিল।
আমাদের সব কটিই পছন্দ হলো। কিনতে চাইলাম। ভদ্রলোক কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, একটার বেশি পাবে না। কারণটা শুনে অবাক হয়েছিলাম। বলেছিলেন, সব কটি আমাদের কাছে বিক্রি করলে ঘুরতে আসা ভিনদেশি নতুন কারও সঙ্গে তাঁর আর আলাপ হবে না।
নতুন বছরে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যে আর মননের স্বার্থে কিছুটা সময় দিন। ভালোই হবে। বিজ্ঞান তা–ই বলছে। ভালো থাকবেন।
সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]