আজ ৩ নভেম্বর তিনি ৯২ বছরের চৌকাঠ টপকালেন। জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালে। দীর্ঘ জীবন তাঁর—শুধু দীর্ঘ বললে অন্যায় হবে, একটি অনন্যসাধারণ, অভাবনীয়, বিস্ময়কর জীবন তাঁর। সে জীবনের তুলনা মেলা ভার কোন সৃষ্টিতে, প্রাপ্তিতে বা অবদানে। না, সেসব বিষয়ে আমি বলছি না—সেসব বিধৃত আছে নানান বিদগ্ধজনের লেখায়, আলাপচারিতায়, তাঁর ওপরে তৈরি জীবনচিত্রে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের অতুলনীয় কীর্তির কথা সারা বিশ্ব জানে।
আমি শুধু ভাবি আমার অভাবনীয় সৌভাগ্যের কথা। প্রায় তিন দশক সময়ে কাজের সূত্রে শতবার দেখা হয়েছে, একত্রে কাজ করেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে নিউইয়র্কে, বোস্টনে, কেমব্রিজে নানান বিষয়ের আলোচনায়, বিতর্কে। আমাদের সময়কার এক বিস্ময়কর প্রতিভার খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে আমার।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে—যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর যে বইটি প্রথম আমার হাতে আসে, তার নাম ছিল ‘চয়েস অব টেকনিক’। খুব সম্ভবত তাঁর স্নাতক-উত্তর অভিসন্দর্ভের ওপরে ভিত্তি করে লেখা। সে বইয়ের বেশির ভাগই বুঝিনি—বোঝার কথাও নয় অর্থনীতির প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থীর। কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণের ধার এবং তাঁর যুক্তির শাণিত ভাষা বুঝতে পেরেছিলাম।
তারপর আমার ছাত্রজীবনে, বিদেশে উচ্চশিক্ষাকালে এবং আমার শিক্ষকতা জীবনে আমাদের প্রজন্মের আরও অনেকের মতো আমাকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে তাঁর গবেষণা এবং বিদ্যায়তনিক লেখার কাছে। আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাঁর মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনা; ব্যক্তিমানুষ এবং মানবগোষ্ঠীর সক্ষমতা, সুযোগ এবং তাঁর চয়ন ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রয়াস; অর্থনীতিকে দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ; এবং সমতা, বৈষম্য এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর তীক্ষ্ণ লেখা।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে ড. মাহবুব উল হকের ঘরে যখন আমি জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরে যোগদান করি। অধ্যাপক সেন, মাহবুব উল হক এবং অধ্যাপক রেহমান সোবহান সতীর্থ বন্ধু ছিলেন কেমব্রিজে। তারপর দীর্ঘ এক যুগ তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা মানব উন্নয়ন বিষয়ে। কাজ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আর তর্কবিতর্কের বৈঠক বসত মূলত মাহবুব উল হকের ঘরে। কখনো কখনো অধ্যাপক সেন আমার ঘরে চলে আসতেন গল্প করতে বা আমার বাংলা বইয়ের পাতা ওলটাতে।
আমার কেন যেন মনে হতো, তিনি বাংলায় গল্প করতে চাইতেন। তিনি গল্প করতেন কালোর চায়ের দোকানের কথা, সাইকেলে শান্তিনিকেতনে টই টই করে ঘোরা, পৌষ মেলার কথা, শান্তিনিকেতনে তাঁর পৈতৃক নিবাস ‘প্রতীচীর’ কথা। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে তাঁর বন্ধু মীনাক্ষী দত্ত (বুদ্ধদেব বসুর কন্যা) একবার তাঁকে তুলনা করেছিলেন ‘খাঁটি জিলেট ব্লেডের মতো ধারালো বলে’ এবং বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপক সেনকে দেখা যেত গোটানো হাতা আর জামার পাশের পকেটে গোল করে মোড়ানো দু-নম্বরি খাতা নিয়ে।
হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধার্ঘ্য ঢেলে দিয়ে তাঁকে আমি বলি, ‘শুভ জন্মদিন, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। আপনি শুধু আমাদের বাতিঘর নন, আপনি আমাদের ধ্রুবতারা। আপনি জ্বল জ্বল করতে থাকুন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পথ দেখানোর জন্য, দিকনির্দেশ করার জন্য।’
নব্বইয়ের দশকে অধ্যাপক সেন যখন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার হলেন, তখন আমাদের অনেক বৈঠক বসত মাস্টারস লজে। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ড. হক, আমি এবং অন্যরা বাড়ির পেছনের বাগানে বেড়াতাম। মনে আছে, একবার এমা (অধ্যাপক এমা রথসচাইল্ড, অধ্যাপক সেনের স্ত্রী) এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ইতিহাসবিদ এমা জানিয়েছিলেন যে ওই বাড়িটি একসময় রঙ্গমঞ্চ ছিল।
বাগানের দেয়ালে দেয়ালে তার ছাপ। আমি অনেক সময় এমার অফিসে বসেও কাজ করেছি। মনে আছে, প্রথমবার যখন মাস্টার্স লজে যাই, তখনো সেন পরিবার সেখানে ওঠেনি। আমি সেখানে এক রাত ছিলাম। স্বল্প আলো, নিউটনের চেয়ার, দেয়ালের ছায়া সব মিলে এক রহস্যময় ভৌতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। সে রাতের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না।
১৯৯৮ সালে মাহবুব হক প্রয়াত হলেন। তার বছর তিনেক পরে আমি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বিভাগের পরিচালক পদে বৃত হলাম। অধ্যাপক সেনের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের যোগসূত্রটি একটু ক্ষীণ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের অন্য সম্পর্কগুলো রইল অটুট।
১৯৯৮ সালে অধ্যাপক সেন যখন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর পেলেন, তখন তিনি নিউইয়র্কে। সকালেই তিনি চলে এলেন আমার ঘরে—কী উত্তেজনা, কী উন্মাদনা আমাদের সবার। সেদিনকার সব অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের সহকর্মীরাই করল। অধ্যাপক সেনের কাজের ওপরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিল আমার তাঁর সহকর্মী হিসেবে। সে বছরেই জাতিসংঘ আয়োজিত ড. হকের স্মরণসভায় অপূর্ব একটি বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন বন্ধুর স্মৃতিতে।
বেণু (রাশেদা সেলিম, আমার প্রয়াত প্রথম স্ত্রী) এসেছিল সে অনুষ্ঠানে। কী যে খুশি হয়েছিলেন তিনি বেণুকে দেখে। অনেক মমতায় আদর করেছিলেন ওকে। বেণু বলেছিল যে ও মাছের ঝোল রেঁধে তাঁকে খাওয়াবে। কী যে উত্তেজিত হয়েছিলেন তিনি। বারবার বলেছিলেন যে বরফ দেওয়া মাছ হলে চলবে না, তাঁর তাজা মাছ চাই। না, সেটা আর হয়ে ওঠেনি কোনো দিন। বেণু চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে অধ্যাপক সেন নিউইয়র্কে এলে বেণুকে দেখতে চেয়েছিলেন—আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমাদের মধ্যাহ্নভোজে।
জাতিসংঘের কাছে ‘পাম’ রেস্তোরাঁয় আমরা কাটিয়েছিলাম বেশ কটি ঘণ্টা। চলে যাওয়ার আগে নিজে বলে ছবি তুলেছিলেন বেণুর সঙ্গে, ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বেণুর এবং আমার কারও চোখ তখন শুকনো ছিল না। বেণুর প্রয়াণের পরে অধ্যাপক সেন আমাকে দীর্ঘ একটি হৃদয়স্পর্শী ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে কৈশোরে তাঁর প্রাণঘাতী অসুস্থতা এবং কলকাতা নীলরতন হাসপাতালে সে যুগের চিকিৎসার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
তার কিছুদিন পরে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বারবার আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে ঢাকায় তিনি ‘বেণুর মেয়েকে’ দেখতে চান। মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক) উদ্যোগে তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যেও অধ্যাপক সেন আনিয়ে নিয়েছিলেন সদ্য মা-হারা আমাদের জ্যেষ্ঠ কন্যা রোদেলাকে। রোদেলা এখনো বড় মমতার সঙ্গে তাঁর স্নেহ-আদরের কথা বলে। তারও বছর বারো আগে আমাদের কনিষ্ঠ কন্যা মেখলা এসেছিল নিউইয়র্কে তাঁর এক বক্তৃতায়। আমি পরিচয় করিয়ে দিতেই কী যে খুশি হয়েছিলেন তিনি! মেখলার সঙ্গেও ছবি আছে ওঁর।
আমার শ্বশ্রুপিতা, বেণুর বাবা, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে তাঁর। তাঁদের দুজনার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ ছিল অত্যন্ত বেশি। অধ্যাপক চৌধুরীর সম্ভবত ৮০তম জন্মবার্ষিকীর একটি স্মরণিকার জন্য অধ্যাপক অমর্ত্য সেন একটি শুভেচ্ছাবাণী দিয়েছিলেন বাংলায়। সেটার পরিমার্জন, পরিশোধন এবং পরিশীলনে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যে কতখানি সময় ও শ্রম দিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের অনুধাবনের অগম্য। সেটার একটা খসড়া আমার কাছে আছে।
একটা হাসির কথা মনে পড়ল। জাতিসংঘে আমার পদবি কী, আমি যে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত, তার সবটাই অধ্যাপক চৌধুরীর জানা। কিন্তু সাহিত্যের লোক বলে তাঁর হয়তো ঠিক পরিষ্কার ধারণা নেই যে তাঁর জামাতা আসলেই কী করে, কী তার কাজ। হার্ভার্ডে এক সভায় দুজনেই মঞ্চোপবিষ্ট—আমার শ্বশ্রুপতা সভাপতি, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন প্রধান অতিথি। কিছুক্ষণ পরে সভাপতি প্রধান অতিথিকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, আমার জামাইটি ঠিক কী করে?’ ততোধিক নিচুস্বরে প্রধান অতিথি জবাব দেন, ‘সেলিম? ও যে কী করে তা আমি জানি না।’ সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘সেলিম যে কী করে, তা কেউ জানে বলে মনে হয় না। ‘ঘটনাটি জেনে সবার যে কী হাসি!
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মা শ্রীমতী অমিতা সেনকে আমি একবারই দেখেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য—সম্ভবত অধ্যাপক সেনের নোবেল প্রাপ্তির পরে। ভারী ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা, যাঁর সামনে মাথা নুয়ে আসে। আমি তাঁর পিতা ক্ষিতিমোহন সেনের বই কবীর পড়েছি জেনে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। তিনি খুব গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন যে তিনি আশ্রমকন্যা এবং তাঁর পুত্র আশ্রম-বালক। কী এক কথায় ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে শান্তিনিকেতনে অমিতা সেন (খুকু) নামে দুজন আছেন—তাঁর একজন গায়িকা আর একজন তিনি। তিনি হচ্ছেন আদি আশ্রমকন্যা অমিতা সেন (খুকু)। আমরা হেসে উঠেছিলাম।
গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের কর্ণধারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে প্রতিবেদনের কাজ উপলক্ষে প্রায়ই অধ্যাপক সেনের সঙ্গে দেখা করতে হার্ভার্ডে যেতাম। আলোচনা করতাম, বিতর্কও হতো, তাঁর মতামত ও উপদেশ আমার কাছে অমূল্য। প্রায়ই তিনিও ডেকে পাঠাতেন বিশেষত সপ্তাহ-অন্তে। হয়তো তাঁর একা একা লাগত শনি-রোববারে (বিশেষত এমা বোস্টনে না থাকলে) কিংবা আমি নিঃসঙ্গ আছি ভেবে তিনি হয়তো পীড়িত হতেন।
আমাদের কথোপকথনের জায়গা ছিল তিনটি—হার্ভার্ড স্কয়ারের তাঁর প্রিয় ইতালীয় রেস্তোরাঁর ফরাসি জানালার পাশের টেবিলটি অথবা হার্ভার্ড ক্লাবের কৌণিক সোফাটি কিংবা লিটার হলে তাঁর আপিস কক্ষে পুস্তকারণ্যের মধ্যে কোনোমতে দুটো চেয়ার পেতে। আমাদের কাজের আলোচনা প্রায়ই নানান পথে বাঁক নিত—তিনি তাঁর বাবার কথা বলতেন, ঢাকার কথা উঠত, খুব মমতাভরে বেণুকে স্মরণ করতেন।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের বাবা অধ্যাপক আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক। ১৯৪৭ সাল এবং তার ঠিক পরবর্তী সময় নিয়ে তাঁর লেখা বেশ কিছু চিঠির কপি ছিল পুত্র অমর্ত্য সেনের কাছে। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, অধ্যাপক আশুতোষ সেনের মূল চিঠিগুলো অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্তের কন্যা ও অধ্যাপক স্যার পার্থ দাশগুপ্তের ভগ্নি অলকানন্দা দাশগুপ্তের (পরবর্তী সময়ে অলকানন্দা প্যাটেলকে) কাছে লেখা। সেসব চিঠিতে উল্লিখিত ঢাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি আমার কাছে বিভিন্ন কথা জানতে চাইতেন। আমি আমার সীমিত জ্ঞানে যতটুকু জানি, তাঁকে বলতাম। তিনি খুব আগ্রহভরে শুনতেন।
অভ্রান্তভাবে ওয়ারির কথা উঠত, উঠত তাদের বাড়ির কথা। ঢাকায় তাঁর স্কুলের কথা বলতেন। আমার কাছে জানতে চাইতেন বরিশালের কথা, আমার স্কুল-কলেজের কথা, আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। বেণুর কথা বলতেন প্রায়ই—একদিন হঠাৎ করে বলে বসলেন, ‘আমার মনে হয়, তুমি বেণুকে খুব মিস করো।’ হঠাৎ এমন কথায় আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তাৎক্ষণিকভাবে আমার মুখে কথা জোগায়নি। কিন্তু তাঁর মতো অতিসংবেদনশীল মানুষ সবকিছুই দেখতে পেতেন ও বুঝতে পারতেন।
আমি খুব নমিত হই এটা দেখে যে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের একাধিক বইয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে আমার নাম দেখে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সর্বদা উল্লেখ করেন যে আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় তিনি ঋদ্ধ হয়েছেন। তাঁর চিন্তাচেতনায় আমারও একটা ভূমিকা আছে। তাঁর বেশ কয়েকটি বই তিনি স্বাক্ষরসহ আমাকে উপহার দিয়েছেন। সব বইতেই স্বাক্ষরের ওপরে লিখে দিয়েছেন কয়েকটি হৃদয়গ্রাহী কথা, যা আমাকে নিত্য আপ্লুত করে। এ বছরের বইমেলায় আমার প্রকাশিত বাংলাদেশ: কনটেমপোরারি ডেভেলপমেন্ট ইস্যুজ বইটি আমি উৎসর্গ করেছি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও ড. মাহবুবুল হককে। তাঁদের দুজনের কাছেই ঋণ স্বীকার করার জন্য হয়তো ওটুকু যোগ্যতাই আমার আছে।
একটি চিরকুটের কাহিনি দিয়ে লেখাটি শেষ করি। একবার যখন হার্ভার্ডে অধ্যাপক সেনের ওখানে গেছি, তখন পড়ে সবে শেষ করেছি কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের আড়ভাবুকের কড়চা। জানতাম, অলোকরঞ্জন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু, যৌবনে দুজনে মিলে স্ফুলিঙ্গ বলে একটা পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। আমার জানা ছিল যে সম্পাদক দুজন, কিন্তু অলোকরঞ্জন লিখেছেন, ‘অমর্ত্য, মধুসূদন ও আমি মিলে পত্রিকাটি সম্পাদনা করতাম।’ কৌতূহলবশত আমি জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, মধুসূদন করও ছিল।’
কথা বলতে বলতে মনে পড়ল, একদিন তিনি বলেছিলেন যে প্রথম যৌবনে তিনি ছড়া লিখতেন। মিমিদি (মীনাক্ষী দত্ত) তাঁর এক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে যদি ছড়া লেখায় মনোনিবেশ করতেন, তাহলে অধ্যাপক সেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ না হয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ছড়াকার হতেন। আমাদের আলাপ আবার ভিন্ন খাতে চলে গেল।
এর দু–তিন দিন পরে হঠাৎ আমার অফিস কক্ষে একজন যুবক এসে উপস্থিত। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। অতি যত্নে সে আমার হাতে তুলে দিল একটি চিরকুট। তাতে হাতে লেখা ‘মধুসূদন কুণ্ডু, সহসম্পাদক’। বুঝলাম, সেদিন ‘মধুসূদন কর’ বলে যে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন, আজ তা শুধরে নিলেন। এর জন্য কতটা তাঁকে খাটতে হয়েছে, তা আমার জানা নেই, কিন্তু বোঝা গেল যে একজন মানুষের সামান্য কৌতূহলও তাঁর কাছে অতি মূল্যবান।
ঘটনার অবশ্য এখানেই শেষ নয়। সেদিন রাতে শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ বাড়ির ফোনের ঝংকার। অত রাতে ফোন এলে শঙ্কিত হই। ফোন তুলতেই পরিচিত গলা, ‘অমর্ত্য বলছি। শোনো, সহসম্পাদক যেটা লিখেছি, তা আসলে বোঝাচ্ছে...’; ‘তা আসলে বোঝাচ্ছে,’ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘আপনারা যৌথভাবে পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন, সহসম্পাদক মানে সহকারী সম্পাদক বোঝাচ্চ্ছে না।’ ‘একদম তাই’, তিনি খুশি হয়ে যান। তারপরই ফোন কেটে যায়।
ফোন ছেড়ে দিয়ে আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। আমি ভাবতে থাকলাম, বিশুদ্ধতার প্রতি কতখানি নিষ্ঠা এবং কতখানি সৎ থাকলে পরে একটি মানুষ এমনটা করতে পারে। ভাবলাম, সততা শুধু অর্থের নয়, চরিত্রের নয়, আমাদের বক্তব্যেরও, আমাদের কথারও। যে মানুষ এইগুলো ধারণ করেন, তাঁর সামনে নমিত হওয়া ছাড়া আর কীই–বা করার থাকে? বক্তব্যের বিশুদ্ধতা, তথ্যের নির্ভুলতা ও উপাত্তের সঠিকতার প্রতি তাঁর আপসহীন নিষ্ঠা, অবিচল বিশ্বস্ততা এবং অখণ্ড সততা কিংবদন্তি পর্যায়ের। এ নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও সততা, যা কিনা তাঁর কাছে প্রায় উপাসনার সমতুল্য, তাই তাঁকে অনন্যসাধারণ করেছে।
আমি তাঁর কাছাকাছি আসার ও তাঁর সঙ্গে একত্রে কাজ করার দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করেছি। এ আমার পরম প্রাপ্তি। তাই হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধার্ঘ্য ঢেলে দিয়ে তাঁকে আমি বলি, ‘শুভ জন্মদিন, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। আপনি শুধু আমাদের বাতিঘর নন, আপনি আমাদের ধ্রুবতারা। আপনি জ্বল জ্বল করতে থাকুন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পথ দেখানোর জন্য, দিকনির্দেশ করার জন্য।’
ড. সেলিম জাহান জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক