আধুনিক ভারতের ক্ষমাহীন ইতিহাস

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক ক্ষমতা জনকল্যাণে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের দাম্ভিকতা, ক্ষমতালিপ্সা, একনায়কত্ব, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে জনকল্যাণের পরিবর্তে তাঁরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ক্ষমতায় থাকাকালে আত্মপ্রচার ও স্তাবকদের ডামাডোলে রাজনীতিবিদদের অপকর্ম ক্ষণিকের জন্য আড়াল হলেও ক্ষমাহীন ইতিহাস তা বিলম্বে হলেও জনসমক্ষে তুলে ধরে। এই কথাগুলো মনে হলো সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত অশোকা মোদির লেখা ইন্ডিয়া ইজ ব্রোকেন: আ পিপল বিট্রেয়েড, ১৯৪৭ টু টুডে (ভারত ভেঙে পড়েছে: এক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস, ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত) বইটি পড়ে। বইটির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছে জাগারনাট বুকস।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ অশোকা এবং আমি দুজন একই সময়ে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করেছি। অশোকা মোদি কোনো হালকা ওজনের বা দলকানা বুদ্ধিজীবী নয়। ভারতের আইআইটি মাদ্রাজের কারিগরি বিষয়ে স্নাতক অশোকা বেল ল্যাব, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাকরি শেষে এখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর।

বইটি পড়ে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা আবার অনুভব করেছি। আমাদের প্রজন্মের দলকানা ও স্তাবক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে এ ধরনের নির্মোহ, তথ্যভিত্তিক বই আশা করা বাতুলতামাত্র। তবে আশা করব যে আগামী প্রজন্ম অত্যন্ত জরুরি এই কাজ করতে এগিয়ে আসবে।

বইটির ভূমিকায় অশোকা বইটি লেখার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, ‘আমি ভারতে জন্মেছি ও বড় হয়েছি। কিন্তু প্রায় চার দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও কাজ করছি। বেশ কয়েক বছর আগে আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করি।

সে সময় আমার বেদনাসিক্ত ও আবেগাপ্লুত মনের অবস্থা জানিয়ে আমার বাবাকে ফোন করলে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেন, “তুমি সব সময়ই হৃদয়ে ভারতীয়ই থাকবে।” বইয়ের পরবর্তী পাতাগুলোতে পাঠক সেই হৃদয়ে ভারতীয়কেই শুনতে পাবে।’

বইয়ের শিরোনাম ‘ভারত ভেঙে পড়েছে’ বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বইয়ের শুরুতেই। ‘ভারতে ২০২০ সালে হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি, লজ্জাজনক আর্থিক বৈষম্য, শহরের দুস্থদের গ্রামে প্রত্যাবর্তন, মুম্বাইয়ের জনাকীর্ণ ধারাবি বস্তির সাত মাইল দূরে মুকেশ আম্বানির বিলাসবহুল ২৭ তলা অট্টালিকা প্রমাণ করে, গত দশকগুলোতে উন্নয়ন সত্ত্বেও লাখোকোটি মানুষের জন্য ভারত ভেঙে পড়েছে’, অশোকা তার বইতে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছে।

আরও পড়ুন

যার যা প্রাপ্য, বুঝিয়ে দেওয়া

ভূমিকার পর বইয়ের শুরু হয়েছে আগস্ট ১৯৪৭-এ জওহরলাল নেহেরু ও সরদার প্যাটেলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে, যাতে নেহরু বিজয়ী হয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। প্যাটেল নেহরুর মন্ত্রিসভায় উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। গান্ধীর ভাষায়, নেহরু ছিলেন চিন্তাবিদ এবং প্যাটেল ছিলেন কর্মযোগী।

নেহরু ছিলেন নিখাদ গণতন্ত্রী। ১৯৫৭ সালে কমিউনিস্ট-শাসিত কেরালায় রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করার কথা উঠলে তিনি বলেন, ‘আমি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো সরকার পতনের ইচ্ছা, আশা বা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি না।’ দ্য হিন্দুর সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি তাদের কীভাবে হটাব? তুমি কী বোঝাতে চাইছ? তাদের জনগণ নির্বাচিত করেছেন।’ কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৫৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি করার কথা উঠলে তিনি বিড়বিড় করে বলেন, তিনি কোনোক্রমেই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করাকে উৎসাহিত করতে চান না।

গণতন্ত্রী নেহরু অর্থনীতি পরিচালনায় ছিলেন নিদারুণভাবে ব্যর্থ। তাঁর সমাজতন্ত্রের বুলি ছিল ভুয়া। বৃহৎ শিল্প ও পরিকল্পনানির্ভরতা ভারতের উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ভূমি সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নগর উন্নয়ন ও বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হয় উপেক্ষিত।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতার ফলে ভারতকে বারবার আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়। অশোকার বইয়ের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, যাঁর যা প্রাপ্য, তাঁকে তা বুঝিয়ে দিয়ে সে ইতিহাসের দায় মিটিয়েছে এবং সব ক্ষেত্রেই তা করেছে দলিল ও উপাত্ত দিয়ে।

নেহরুর বিপরীত ছিলেন তাঁর কন্যা ইন্দিরা। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক। তিনি জরুরি অবস্থা, নিবর্তনমূলক আইন মিসা প্রবর্তন, আদালতের এখতিয়ার সীমিত ও সংবাদপত্রের সেন্সরশিপ চালু করেছিলেন। উল্লেখ্য, মিসা পরবর্তী সময়ে ‘মেইনটেন্যান্স অব ইন্দিরা অ্যান্ড সঞ্জয় অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত হয়। পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর দুর্নীতিতে তিনি আশকারা দিয়েছিলেন।

তাঁকে অর্থ সরবরাহের জন্য ব্যাংক জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি রাজনীতিতে কালোটাকা ও পেশিশক্তিকে প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্দিরার সময়েই ধিরুভাই আম্বানির উত্থান ঘটে। তাঁর উত্থানে সহযোগিতা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। প্রণবের আনুকূল্যে সরকারের নীতি নির্ধারণে ধিরুভাই একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করেন।

ইন্দিরার একনায়কত্বের উদাহরণ আছে বইয়ে। ১৯৭১ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনের ইস্যু কী, জানতে চাইলে ইন্দিরা নিউজউইক-এর সাংবাদিককে বলেন, ‘আমিই নির্বাচনের ইস্যু।’

আরও পড়ুন

প্রতিপক্ষ জনসংঘ নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ীর বক্তব্যেও এর সমর্থন মেলে। তিনি বলেছিলেন, ‘বিরোধী দল সারা দেশে ২ হাজার ৭০০ প্রার্থী দিলেও কংগ্রেস প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় মিসেস গান্ধীকে নিয়ে নির্বাচন করেছে।’ বইটিতে ইন্দিরার শাসন আমল পড়তে গিয়ে মনে হয়, ভিডিও ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করছি।

ইন্দিরার পর রাজীব গান্ধী ‘মিস্টার ক্লিন’ ইমেজ নিয়ে আবির্ভূত হন। বই থেকে জানা যায়, তিনি পাইলট হিসেবে বিমানে নিজেকে গান্ধী নন, বরং ক্যাপ্টেন রাজীব হিসেবে ঘোষণা দিতেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাঁর সময় ছড়িয়ে পড়ে। বাবরি মসজিদে হিন্দু উগ্রবাদীদের প্রবেশে তাঁর সায় ছিল বলে জানা যায়। হিন্দুত্বের প্রবর্তক সাভারকারের অনুসারীরা তাঁর সময় সক্রিয় হয়। (উল্লেখ্য, সাভারকার বলেছিলেন, হিন্দুত্বের সঙ্গে হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই।) প্রথমে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার করলেও পরে রাজীব বোফর্স কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন।

বইয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। একইভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার ও ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিমুক্ত থাকার কারণে মনমোহন সিংয়ের শাসনকালকে ‘সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ন্যায়নিষ্ঠতার মুহূর্ত’ বলেছেন অশোকা।

উন্নয়নের দৌড়ে ভারত পিছিয়ে পড়ল কেন

ভ্রান্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ, রাজনীতিতে একনায়কত্ব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, কালোটাকা, পেশিশক্তির প্রভাবের কারণে ভারত বারবার উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে যায়। প্রথমে দৌড় শুরু হয়েছিল জাপানের সঙ্গে, আশা জাগিয়েও ভারত পিছিয়ে যায়। একে একে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব এশীয় দেশগুলো এবং সবশেষে গণচীন ভারতকে ছাড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

বইটিতে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ইন্দিরা গান্ধীর সাফল্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রভাবশালী সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্টকে উদ্ধৃত করা বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তান এখন খর্বকায় দেশে পরিণত এবং বাংলাদেশ দৃশ্যমান ভবিষ্যৎ পর্যন্ত ভারতের “মক্কেল” দেশ হয়ে থাকবে।’ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি, শ্রমঘন পণ্য রপ্তানি ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সাফল্যের কথাও এসেছে, এসব ক্ষেত্রে ভারতের ব্যর্থতার বিপরীত দৃষ্টান্ত হিসেবে।

বইটি পড়ে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা আবার অনুভব করেছি। আমাদের প্রজন্মের দলকানা ও স্তাবক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে এ ধরনের নির্মোহ, তথ্যভিত্তিক বই আশা করা বাতুলতামাত্র। তবে আশা করব যে আগামী প্রজন্ম অত্যন্ত জরুরি এই কাজ করতে এগিয়ে আসবে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব