এ শহরে আগুনে পুড়ে মানুষ মরে, আমাদের কোনো অনুভূতি নেই

ছবি নিয়ে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজ। মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুর রূপনগরের শিয়ালবাড়িতেছবি: সাজিদ হোসেন

গতকাল মঙ্গলবার ‘জাদুর শহর’ রাজধানী ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে একটি ভবনে আগুন লাগে। বেলা সাড়ে এগারোটার ঘটনা। আগুন নেভানো ও উদ্ধার তৎপরতার জন্য ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যায়। জড়ো হন সংবাদমাধ্যমকর্মীরাও।

সংবাদমাধ্যমে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা আসতে থাকল। কিন্তু সে খবর আমাদের আর দেখা হয় না, সে খবরে কোনো ক্লিক নেই, ফলে ভাইরাল হয় না। এতগুলো মানুষের মৃত্যু নিয়ে কোনো আলোচনাই হলো না। যেন এটি খুবই সাধারণ কোনো ঘটনা!

যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা তো এ শহরেরই বাসিন্দা। গোটা দেশবাসীর কথা না হয় থাক, এ শহরের মানুষের কাছে মনোযোগই পেলেন না তাঁরা। কারণ খুব সোজা। আগুনটা কোনো রেস্তোরাঁ ভবন, বড় মার্কেট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অভিজাত এলাকায় লাগেনি। লেগেছে গার্মেন্টস কারখানায়।

আরও পড়ুন

আর, সমাজের উপরতলার, সুবিধাভোগী শ্রেণি বা মধ্যবিত্ত ও লুটেরা শ্রেণির কেউ মারা যায়নি, মারা গেছে আসলে গরিব শ্রমিক। তাও অন্তত পঞ্চাশ–এক শ জন মারা গেলে না হয় কথা ছিল। সেটাও হয়নি। গরিবের মৃত্যুতে শোকের জন্য লাশের সংখ্যা কত বেশি হতে হয়? আমরা দেখি না নাগরিক সমাজের কোনো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কিংবা ক্ষোভ। রক্ত বা অ্যাম্বুলেন্স লাগবে কি না, তা নিয়েও কোথাও কোনো আকুতি দেখা গেল না।

না, বলছি না সরকারের উপদেষ্টা, রাজনৈতিক নেতারা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিড় বাড়াক। উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত করুক। বলছিলাম, উপদেষ্টাদের নির্বিকারত্ব ও আমাদের অনুভূতিহীনতার কথা।

গতকাল তো বড় কোনো ঘটনা বলতে এই একটাই ঘটনা ছিল, কিন্তু সেটি বড় কোনো ইস্যুই হতে পারল না। অনেকে বলে থাকেন, ঢাকায় কিছু না ঘটলে সেটি নিয়ে মাতামাতি হয় না। কিন্তু সেখানেও যে ‘শুভংকরের ফাঁকি’ আছে, তা দেখাই গেল। এই শুভংকরের ফাঁকিটা হলো শ্রেণিবৈষম্য। গরিব মরলে কার কী?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি মরল কারা? শ্রমিকেরাই তো। কিন্তু দেখেন রাষ্ট্র সংস্কারের নামে যে ‘মজমা’ বসেছে রাষ্ট্রীয় রংমহলে, সেখানে শ্রমিকেরাই অচ্ছুত।

স্বজনের শোকে পাথর এ নারী।
ছবি: প্রথম আলো

গরিবদের গল্প খুব একটা আকর্ষণীয় হওয়ার কথা না। এরপরেও আশা করি ‘পভার্টি পর্ন’ হিসেবে গতকাল মারা যাওয়া মানুষগুলোর কিছু গল্প উল্লেখ করা যেতেই পারে।

এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর আলো ও জয়ের গায়েহলুদের একটি ছবি নিশ্চয়ই অনেকের এখন দেখা হয়ে গেছে। কারোরই বয়স বিশও পার হয়নি। দুজনই চাচাতো ভাই-বোন। গত ঈদুল আজহার দুই দিন পর তাঁদের বিয়ে হলো। বিয়ের পরে এ কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। কারখানার পাশেই একটা বস্তিতে থাকতেন। বাবার কাছে ফোন করে আলোর শেষ কথা ছিল: ‘কারখানায় আগুন লেগেছে। আমরা আটকে গেছি, বের হতে পারছি না।’

বস্তিতে জয়-আলোর পাশের ঘরে থাকতেন মুন্নী আক্তার। মাত্র ষোলো বছর বয়স। তাঁরও বিয়ে হয় মাত্র ছয় মাস আগে। মিষ্টির দোকানে স্বামী নাঈমের চাকরির আয়ে সংসার চলে না। মাত্র সাত হাজার টাকায় গার্মেন্টসে গাজ নিয়েছিলেন মুন্নী। তাঁরও খোঁজ নেই। স্বামী নাঈম বউটার খোঁজে পাগলপারা।

একটা প্রশ্ন: এ শহরে সারা দিন কাজ করে একটা মানুষ মাত্র সাত হাজার টাকা বেতন পায়, কীভাবে সম্ভব! তাও আবার কারখানায় পুড়ে মরতে হয়।

আলো, মুন্নী, নার্গিসেরা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসের কারখানায় পুড়ে কয়লা হওয়া শিশুশ্রমিকদের। কিন্তু কয়দিন না যেতেই আমরা তাদের কথা ভুলে যাই। ভুলে যেতে যেতে এমন অবস্থা হলো, একই শহরে আগুনে পড়ে মরার খবরও এখন আমরা রাখি না।

যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে আমাদের পোশাক ব্যবসায়ীদের, আমাদের নাগরিক সমাজের উদ্বেগের শেষ নেই। পোশাক খাত না বাঁচলে দেশের অর্থনীতি বাঁচবে না। ব্যবসা বাঁচবে না। ব্যবসায়ীরা পথে বসবে। কিন্তু যে পোশাকশ্রমিকেরা সামান্য টাকার মজুরিতে গোটা খাতকে টিকিয়ে রেখেছেন, দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করে রেখেছেন, তাঁরা যখন কারখানায় গিয়ে পুড়ে কয়লা হন, লাশটাও চেনা যায় না, তাঁদের জন্য আমাদের একটু ‘মায়াও’ হয় না!

আচ্ছা বলুন তো, একজন মা সারা জীবন কীভাবে নিজেকে বুঝ দেবে যে মেয়েকে তিনি বাসায় বসে সেলাই কাজ শিখিয়েছিলেন, সুতার কারুকাজের দীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই মেয়ে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে কারখানায় চাকরি নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাবে। নার্গিস নামে মেয়েটা এসএসসি পরীক্ষা শেষে ঘরে বসে না থেকে নিজেই খোঁজ করে কাজ নিয়েছিলেন। নিজেকে, পরিবারকে এগিয়ে নিতে। সেই মেয়ের আর কলেজে ওঠা হলো না, নানা সংগ্রাম পেরিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া হলো না।

মাহিরা নামে আরেক শ্রমিকের মায়ের কথাও ভাবুন তো। হাসপাতালের মর্গে মেয়ের লাশের সামনে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। বাবা ছাড়া বড় হওয়া ১৪ বছর বয়সী মেয়েটাও মাত্র ১৫ দিন আগে কারখানাটিতে কাজ নিয়েছিলেন। তাও মাত্র সাড়ে সাত হাজার টাকায়।

মুনা আক্তার নামের ১৬ বছরের মেয়েটিরও ছয় মাস আগে বিয়ে হলো। এরপর ঢাকায় আসল গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে। গায়ের জামা দেখে তাঁর লাশ চিনতে পারল বোন চম্পা আক্তার। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বললেন, ‘মাত্র তিন দিন হলো ও কাজে ঢুকেছে। বলেছিল, এবার ওর জীবনটা গুছিয়ে নেবে। কে জানত, জীবন গড়ার সুযোগ এভাবেই ছাই হয়ে যাবে!’

কারখানা ভবনটি চারতলা হলেও অবৈধভাবে টিনশেড দিয়ে আরও একতলা বাড়ানো হয়েছে। এই ভবন এবং টিনশেডের রাসায়নিক গুদামে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না।
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

এতক্ষণে অনেকে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন এটি জানতে যে, কারখানাটিতে আগুন লাগল কেন? কেন শ্রমিকেরা বের হতে পারলেন না?

উত্তরগুলো আসলে আপনাদের জানাই আছে। এর আগে অসংখ্য ঘটনায় যেভাবে শ্রমিকেরা পুড়ে মরেছেন এখানেও তার ধারাবাহিকতাই অক্ষুণ্ন থেকেছে! কারখানা ভবনটি চারতলা হলেও অবৈধভাবে টিনশেড দিয়ে আরও একতলা বাড়ানো হয়েছে। এই ভবন এবং টিনশেডের রাসায়নিক গুদামে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ভবন ও গুদাম কোনোটিরই ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা লাইসেন্স ছিল না। যথারীতি কারখানার ছাদের দরজাও বন্ধ ছিল। ফলে সবাই ভেতরে আটকে পড়ে মরেছে।

ভবনটির দোতলায় স্মার্ট প্রিন্টিং নামের একটি কারখানায় টি-শার্ট প্রিন্ট করা হয়। আর তিন ও চারতলায় আর এন ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানা আছে। চারতলার ছাদে টিনশেড দিয়ে বিসমিল্লাহ ফ্যাশন নামের আরও একটি প্রিন্টিং কারখানা রয়েছে। আইন–নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটা ভবনে কতগুলো কারখানা গড়ে উঠল!

গতকালের আগুন আজকে সকালেও পুরোপুরি নেভেনি। শুধু তাই নয়, যে ভবন ও গুদামে গতকাল আগুন লাগে, তার আশপাশের কয়েকটি পোশাক কারখানা আজ সকালে খোলা হয়েছিল। গুদাম থেকে বের হওয়া বিষাক্ত ধোঁয়ায় কয়েকজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সে কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বোঝেন, গতকাল কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেখানে।

আরও পড়ুন
মর্গে অভাগা মানুষগুলোর লাশের সারি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: প্রথম আলো

আলো, মুন্নী, নার্গিসেরা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসের কারখানায় পুড়ে কয়লা হওয়া শিশুশ্রমিকদের। কিন্তু কয়দিন না যেতেই আমরা তাদের কথা ভুলে যাই। ভুলে যেতে যেতে এমন অবস্থা হলো, একই শহরে আগুনে পড়ে মরার খবরও এখন আমরা রাখি না। আমাদের রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা, শ্রমিকনেতা, বুদ্ধিজীবী মহল, নাগরিক সমাজের কাছে মানে আমাদের সবার কাছে তাঁদের মৃত্যু স্পর্শও করে না। কিংবা আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এভাবেই তো কারখানায় মানুষ মরে। এ আর নতুন কী!

আমরা জানি না, আর কত মানুষ মরলে অনুমোদনহীন ভবনে কারখানা বন্ধ হবে। আর কত শ্রমিক মরলে কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। কারখানার মেইন গেট বা ছাদের দরজা খোলা রাখা হবে? আর কত মৃত্যু হলে শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া বন্ধ হবে? কত মানুষ মরলে কোনো মালিকের শাস্তি হবে? দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পার পাবে না? কত বেশি মানুষ মরলে আমাদের অনুভূতি ধাক্কা খাবে? তখন আমরা মানে মিডলক্লাস পিপলের কাছে জনপ্রিয় বব ডিলানের একটি গানের কথাই মনে পড়ে—কতটা মৃত্যু হলে আমরা জানব বহু মানুষ মরে গেছে? উত্তরটা ভেসে বেড়ায় বাতাসে।

হাউ মেনি ডেথস উইল ইট টেইক টিল হি নোস

দ্যাট টু মেনি পিপল হ্যাভ ডাইড?

দ্য আনসার, মাই ফ্রেন্ড, ইজ ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড

দ্য আনসার ইজ ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ইমেইল: [email protected]

[১৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে লেখাটি শ্রমিকের সস্তা প্রাণ ও আমাদের ‘স্বাভাবিক’ অনুভূতি—এ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে]