অযোধ্যায় আমন্ত্রণ: দোলাচল কাটিয়ে স্বধর্মে কংগ্রেস

ভারতে বিরোধীদের নিয়ে জোট গড়তে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে কংগ্রেসছবি: রয়টার্স

মোটাদাগটা টেনে দেওয়া হয়েছে। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে সেই দাগের এক পাশে দাঁড়িয়ে বিজেপি-আরএসএস ঘোষণা করেছে, ‘হয় তুমি হিন্দুত্বের পক্ষে, নয় বিপক্ষে।’ রামমন্দির এখনো নির্মীয়মাণ। শেষ হতে অন্তত বছর দুয়েক লাগবে। কিন্তু তাতে কী? দেশের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে বীরদর্পে প্রচার চলছে, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েও যাঁরা প্রত্যাখ্যান করছেন, তাঁরা সনাতন ধর্মের বিরোধী। প্রচারের লক্ষ৵ অবশ্যই কংগ্রেস, বামপন্থীসহ সেই সব দল, যারা এই অনুষ্ঠানকে ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ ঘোষণা করে জানিয়েছে, নির্বাচনে ফায়দা লুটতে আরএসএস ও বিজেপি ধর্মকে হাতিয়ার করেছে।

কংগ্রেস সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেছে, ‘দেশের লক্ষকোটি মানুষ ভগবান রামচন্দ্রের আরাধনা করেন। ধর্ম একান্তই প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। নিজস্ব বিশ্বাস। অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএস ও বিজেপির রাজনৈতিক প্রকল্প। ভোটের দিকে তাকিয়ে তাই এই অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধনের ছক।’ কংগ্রেস জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিকীকরণের কারণে তারা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করছে।

কংগ্রেস সভাপতি ও রাজ্যসভার বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, সংসদীয় দলের নেতা সোনিয়া গান্ধী ও লোকসভার বিরোধী নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে মন্দির কর্তৃপক্ষ ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিল।

আরও পড়ুন

কংগ্রেসের রাজ্য পর্যায়ের নেতারা বলছেন, তাঁরা সুবিধামতো সময়ে অবশ্যই অযোধ্যায় যাবেন। কেউ যাবেন মকর–সংক্রান্তি উপলক্ষে। কেউ নিজের সুবিধামতো। কেউ কেউ মন্দির শেষ হলে। কংগ্রেস যে যাবে না, বিজেপি তা বিলক্ষণ জানত, তবু আমন্ত্রণ। কারণ, এটা তাদের ‘দোধারি তলোয়ার’। কংগ্রেস গেলেও তাদের লাভ, না গেলে আরও বেশি। গেলে ‘মোদি-কিরণে’ তারা ম্রিয়মাণ হয়ে যেত, যেভাবে সূর্যের কিরণে ঢাকা পড়ে মিটমিটে তারা। আর না গেলে তাদের ‘হিন্দুবিরোধী’ ও ‘দেশবিরোধী’ বলে সহজেই দাগিয়ে দেওয়া যাবে। সেই প্রচেষ্টা অনেক দিন আগে থেকেই তারা শুরু করেছে।

আমন্ত্রণপত্র পাঠানো পর্যন্ত মোদি–অনুগত ‘গোদি মিডিয়া’ সমস্বরে গান্ধী ও খাড়গেদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। জানতে চেয়েছে, কী করবেন তাঁরা? অযোধ্যায় গিয়ে মোদির সাফল্যের সাক্ষী থাকবেন, নাকি না গিয়ে দেশবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করবেন? এমনকি এ কথাও জানতে চাওয়া হয়, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সেখানেও তাঁরা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন কি না? যেদিন থেকে কংগ্রেস বলেছে তারা যাবে না, তার আগে থেকেই ‘গোদি মিডিয়ার’ চোখে কংগ্রেস ‘সনাতন ধর্মের বিরোধী’।

উগ্র হিন্দুত্ববাদ নাকি উদারবাদ, কোনটা হবে ভারতের পরিচিতি, সেই নির্ণায়ক লড়াই এই মুহূর্তে কঠিন হতে পারে। কিন্তু সেটাই ছিল ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনা। বিজেপির মন্দিরসর্বস্ব রাজনীতির মোকাবিলায় কংগ্রেস আদর্শগত দীর্ঘ লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছে। যাত্রাপথ কঠিন, কিন্তু বিচ্যুতি না ঘটলে ভবিষ্যৎ ভারতের পক্ষে ফলদায়ী।

মজার বিষয়, কংগ্রেসের মতো একই সিদ্ধান্ত শংকরাচার্যরাও নিয়েছেন। তাঁরা মোদিবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন! অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্‌ঘাটনের পেছনে ‘রাজনীতি’ দেখেছেন। বলেছেন, মোদি–বন্দনার কোরাসে গলা মিলিয়ে হাততালি দিতে তাঁরা অযোধ্যায় যাবেন না। বিজেপি নেতৃত্ব এবং ‘গোদি মিডিয়া’ কিন্তু শংকরাচার্যদের শাপশাপান্ত করছে না! ভাবখানা এমন, যেন ওটা কোনো খবরই নয়! মূলধারার মিডিয়া এখন এমনই। বিলকিস বানুর ধর্ষকদের মুক্তি খারিজ হলো সুপ্রিম কোর্টে। গুজরাট সরকার তথ্য গোপন ও কারচুপির জন্য ভর্ৎসিত হলো। মোদি–অনুগত মিডিয়ায় তা নিয়ে হইচই নেই!

২২ জানুয়ারির গোটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে ‘মোদিময়’। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু মোদি আর মোদি। প্রাণ প্রতিষ্ঠাসহ দিনভর সেদিন অযোধ্যায় যা কিছু হবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়া সেখানে অন্য সবাই এলেবেলে। মোদি নিজেই সেই সুর ভেঁজে রেখেছেন। মোদি বলেছেন, ভগবান রাম এই কাজের জন্যই তাঁকে ধরাধামে পাঠিয়েছেন। মহা প্রচারের ওয়ার্মআপও শুরু হয়ে গেছে।

নাসিকের এক মন্দিরে গিয়ে মোদি ঝাড়ু দিয়েছেন। সেই ছবিতে মিডিয়া সয়লাব। প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন, প্রাণ প্রতিষ্ঠার মতো সন্ধিক্ষণে নিজেকে শুদ্ধ রাখতে টানা ১১ দিন ব্রত পালন করবেন। বিশেষ ধরনের নিয়ম–আচার মানবেন। কৃচ্ছ্রসাধন করবেন। বিজেপি বলেছে, এই ১১ দিন মোদি কার্যত ‘উপবাস’ করবেন। সামান্য কিছু না খেলে নয়, তাই যৎসামান্য ‘সাত্ত্বিক’ আহার করবেন। মন শান্ত রাখতে ‘জপ তপ’ করবেন। ‘মৌনব্রত’ পালনের চেষ্টা করবেন। মাটিতে ‘শোবেন’।

কংগ্রেস প্রকাশ্যে জানতে চেয়েছে, যাবতীয় ধর্মীয় কর্মসূচি এবং ২২ জানুয়ারি ‘রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ হিন্দুধর্মের কোন শাস্ত্রমতে ও কোন পঞ্জিকা অনুযায়ী হতে চলেছে। বিজেপি তা আমলেই নিচ্ছে না। এই জমানায় গণমাধ্যমে সেটাই খবর, যেটা তারা প্রচার করে। যেখানে প্রচারই নেই, সেখানে জবাবদিহির প্রয়োজনই–বা কী? স্বীকার করা ভালো, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশেল বিজেপি অনেক দিন আগেই রপ্ত করেছে। এখন সেটা তারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ বছর লোকসভা ভোটের আগে রামমন্দিরের উদ্বোধন ও ‘রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ হতে চলেছে তাদের তুরুপের তাস। এর মোকাবিলা কংগ্রেস কীভাবে করবে, অনেক দিন সে হদিস তারা পায়নি। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বের জবাবে ‘হিন্দুত্ববাদ’ নাকি গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল-আজাদ অনুসৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, কোন নীতি আঁকড়ে ধরবে, সেই দোলাচলে কংগ্রেস বারবার বিদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন

এই টানাপোড়েনে রাজীব গান্ধী শাহ বানু মামলায় পিছু হটেছেন। অযোধ্যার রামমন্দিরের তালা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শিলান্যাস করাতে বাধ্য হয়েছেন। সেই দোলাচলে নরসীমা রাও নির্বাক দর্শক থেকেছেন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার দিন। রাহুলসহ শীর্ষ নেতারা প্রতিটি ভোটের আগে মন্দির পরিক্রমার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বের জবাবে নরম হিন্দুত্বের নামাবলি গায়ে চড়িয়েছে কংগ্রেস। লাভ হয়নি বিন্দুমাত্র।

বরং দোলাচলের দরুন ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে ‘হিন্দুত্ববাদী’ বিজেপির কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কংগ্রেস জমি খুইয়েছে। আজ বিজেপির প্রচারে কংগ্রেস ‘মুসলমানদের দল’। দর্পের সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্ব ঘোষণা করে, মুসলমানদের ভোট তাদের প্রয়োজন নেই। বলতে পারে, লড়াই যখন ৮০ বনাম ২০-এর, তখন তারা ৮০ শতাংশের সমর্থন নিয়েই সন্তুষ্ট। ওই নির্ঘোষ অবশ্যই বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া নয়, সমাজ ও গণতন্ত্রের পীঠস্থানে হিন্দুত্ববাদ আজ কতটা প্রোথিত, তার প্রমাণ সংসদে বিজেপির একজনও মুসলমান সদস্য না থাকা!

রামমন্দির নিয়ে কংগ্রেসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর স্বামী বিবেকানন্দের জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে রাহুল গান্ধী আগামী দিনের লড়াইয়ের আঙ্গিক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বিবেকানন্দের বিচারধারা স্মরণ করিয়ে তিনিও এক দাগ টেনেছেন। বলেছেন, স্বপ্নের ভারতের পরিচিতি কী হবে, যুবসমাজকে তা ঠিক করতে হবে। আবেগ, না জীবনযাত্রার প্রকৃত উন্নতি? উত্তেজক স্লোগান নাকি রোজগার? বিদ্বেষ, না ভালোবাসা? ধর্মীয় আবেগ, না বাস্তব সমস্যার সমাধান? মানুষই ঠিক করুক, তারা দাগের কোন দিকে।

উগ্র হিন্দুত্ববাদ নাকি উদারবাদ, কোনটা হবে ভারতের পরিচিতি, সেই নির্ণায়ক লড়াই এই মুহূর্তে কঠিন হতে পারে। কিন্তু সেটাই ছিল ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনা। বিজেপির মন্দিরসর্বস্ব রাজনীতির মোকাবিলায় কংগ্রেস আদর্শগত দীর্ঘ লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছে। যাত্রাপথ কঠিন, কিন্তু বিচ্যুতি না ঘটলে ভবিষ্যৎ ভারতের পক্ষে ফলদায়ী। ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সংকল্প। কংগ্রেসের আদর্শ ও বিশ্বাসের ধ্রুবতারা ছিল তা। সেটাই কংগ্রেসের ‘স্বধর্ম’। হিন্দুত্ববাদী দোলাচল তার পথ নয়। সেটা ‘পরধর্ম’। কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণে শ্রীকৃষ্ণ বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে সে কথাটুকুই মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ।’

● সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি