বিশ্লেষণ
বিএনপির সম্ভাব্য জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা কেন ঝুঁকিপূর্ণ
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অনেক নতুন মুখ উঠে এসেছে, যাঁরা এখন নতুন রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে চান। এই প্রেক্ষাপটে পুরোনো ও বড় দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি একটি বড় পরীক্ষার মুখে পড়েছে: তারা কি নিজেদের আদর্শ ও সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখবে, নাকি দ্রুত নির্বাচনী জোটে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ঝুঁকিতে ফেলবে? বিএনপি ও এনসিপির সম্ভাব্য জোট ও আসন সমঝোতা নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার
সম্ভাব্য আসন সমঝোতা প্রশ্নে আপাতত বিএনপির দিকেই বেশি ঝুঁকছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা বা যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
যদিও এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলটি অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতার বিষয়ে কোনো আলোচনায় যায়নি।
বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতিতে জোট বা আসন সমঝোতা নতুন কিছু নয়; কিন্তু চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর রাজনীতি এখন ভিন্ন পর্যায়ে গেছে। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অনেক নতুন মুখ উঠে এসেছে, যাঁরা এখন নতুন রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে চান।
এই প্রেক্ষাপটে পুরোনো ও বড় দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি একটি বড় পরীক্ষার মুখে পড়েছে—তারা কি নিজেদের আদর্শ ও সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখবে, নাকি দ্রুত নির্বাচনী জোটে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ঝুঁকিতে ফেলবে?
আধুনিক সমাজে রাজনীতি শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি পরিচয়েরও প্রশ্ন। সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডেনস তাঁর মডার্নিটি অ্যান্ড সেলফ-আইডেনটিটি বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি কী করব, কীভাবে চলব, আমি কে’— এই প্রশ্নগুলোই আজকের যুগে ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জোটের রাজনীতি যে তুলনামূলকভাবে জটিল, সেটি নিকট প্রতিবেশী দেশের একটি উদাহরণ থেকে দেখা যায়। ভারতের পুরোনো রাজনৈতিক দর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ২০১৪ সালের পর আঞ্চলিক জোটের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করে নিজের ঐতিহাসিক প্রভাব হারায়। এর বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসেসহ অন্যান্য আঞ্চলিক দল অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতির ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করেছে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, গণ–অভ্যুত্থানের পর জোট বা আসন সমঝোতা করে বিএনপির পরিণতি কী হবে? জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের বদলে দলটি কি ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার পথে হাটতে চাচ্ছে? জাতীয় রাজনীতির ন্যারেটিভ অন্য কোন দলের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে? এভাবে কি রাজনীতিতে বিএনপির স্বাতন্ত্র৵ বজায় থাকবে?
নীতি বনাম কৃতজ্ঞতা
অনেকে বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানের ফসল’ বিএনপির পক্ষে গেছে; কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার —বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি কখনো ব্যক্তিগত লাভ বা অনুগ্রহের রাজনীতি ছিল না। তিনি নিজের রাজনৈতিক পথ নিজেই নির্ধারণ করেছেন এবং বারবার বলেছেন, তিনি কোনো স্বৈরাচারের কাছে মাথা নত করবেন না।
এই নৈতিক দৃঢ়তাই খালেদা জিয়ার রাজনীতির ভিত্তি। তাই ‘গণ–অভ্যুত্থানের ফসল’ কথাটা অন্তত তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, স্বৈরাচারী শাসনামলে ব্যক্তিগত সুবিধা বা নিজের কারামুক্তির জন্য তিনি কখনো আপস করেননি। এ কারণে বারবার তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
এ রকম প্রেক্ষাপটে বিএনপি যদি মনে করে যে গণ–অভ্যুত্থানের ‘ঋণ শোধ’ করতে হবে এবং সেই কৃতজ্ঞতা দেখাতেই এনসিপির সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা করতে হবে। তবে সেটি হবে দলটির নিজস্ব নীতি থেকে অনুগ্রহের রাজনীতিতে অবনমনের মতো বিষয়। এতে দলের স্বাধীন সিদ্ধান্ত ও জবাবদিহি দুর্বল হবে আর জনমনে প্রশ্ন উঠবে, ‘এই জোট নীতির জন্য, নাকি কৃতজ্ঞতার জন্য?’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারবার্ট কিটশেল্ট তাঁর লিংকেজেস বিটুইন সিটিজেনস অ্যান্ড পলিটিশিয়ানস ইন ডেমোক্রেটিক পলিটিকস বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, যখন কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের সঙ্গে নীতি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে সম্পর্ক না গড়ে, ব্যক্তিগত সুবিধা বা অনুগ্রহের বিনিময়ে সমর্থন নেয়, তখন সেটি হয়ে যায় ‘অনুগ্রহনির্ভর রাজনীতি’। এতে দলীয় নীতি ও জবাবদিহি দুর্বল হয়; আর জনগণের আস্থা ক্ষয়ে যায়।
অন্যদিকে ইতালীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিওভান্নি স্যার্তোরি তাঁর বিখ্যাত বই পার্টিস অ্যান্ড পার্টি সিস্টেমস: এ ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যানালাইসিস -এ বলেছেন, যখন দলগুলো আদর্শ হারিয়ে ক্ষমতার সমীকরণ বা সুবিধাভিত্তিক জোটের পথে হাঁটে, তখন তাদের দলীয় পরিচয় ক্ষয় (আইডেন্টিটি ডাইলিউশন) হয়। অর্থাৎ তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও নৈতিক ভিত্তি হারায়। উদাহরণ হিসেবে ইতালির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে অনুগ্রহনির্ভর রাজনীতিতে জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়।
ভুল পাঠ
চব্বিশের জুলাই–আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর এনসিপি কিন্তু একই রাজনৈতিক শক্তি নয়। বিএনপি যদি এই দুই সংগঠনকে একই শক্তি বলে ধারণা করে থাকে, তাহলে দলটি একটি বড় কৌশলগত ভুল করছে।
এনসিপি যদিও গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত হয়েছে এবং আন্দোলনের প্রথম সারির অনেক ছাত্রনেতা এর সঙ্গে যুক্ত, তবুও তারা গণ-অভ্যুত্থানের প্রকৃত সামাজিক শক্তি নয়। মাঠের নেতৃত্ব ও তৃণমূল অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে এনসিপির নেতৃত্বের সামাজিক দূরত্ব স্পষ্ট।
ফলে বিএনপি যদি ধরে নেয়, এনসিপি গণ-অভ্যুত্থানের ধারক বা প্রতিনিধি, তাহলে সেটি হবে একটি ভুল রাজনৈতিক পাঠ। কারণ, এতে দলটি আন্দোলনের আসল শক্তির সঙ্গে নয়; বরং আন্দোলনের ‘পরবর্তী দাবিদার’দের (পোস্ট-ফ্যাক্ট ক্লাইম্যান্টস) সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করছে।
এই পরিস্থিতি চার্লস টিলি ও সিডনি টারোর ‘সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক সুযোগ’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যা তাঁরা তাঁদের বই কনটেনশাস পলিটিকস ও পাওয়ার ইন মুভমেন্ট -এ ব্যাখ্যা করেছেন।
এনসিপির নেতৃত্বে এমন একদল বিদেশফেরত ও তাত্ত্বিক মানুষ আছে, যারা মাঠের বাস্তব রাজনীতিতে অভ্যস্ত নয়। তারা প্রায়ই অনলাইন ও ইউটিউবভিত্তিক চিন্তাচক্রের প্রভাবে কাজ করে, যা ম্যানুয়েল ক্যাসেলসের ‘নেটওয়ার্ক সোসাইটি’ তত্ত্বে বর্ণিত ‘ডিজিটাল প্রভাব রাজনীতি’র উদাহরণ; যেখানে বাস্তব সংগঠন নয়; বরং ক্ষণস্থায়ী অনলাইন নেটওয়ার্কই রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা তৈরি করে। এর ফলে এনসিপি এখনো মতাদর্শিকভাবে বিভক্ত এবং বাহ্যিক প্রভাবনির্ভর।
এসব বইয়ে বলা হয়েছে, গণ–আন্দোলন শেষে প্রায়ই এমন কিছু সংগঠন জন্ম নেয়, যারা আন্দোলনের নাম ব্যবহার করে; কিন্তু তার সামাজিক ভিত্তি ধরে রাখতে পারে না।
লাতিন আমেরিকার চিলি ও আর্জেন্টিনার মতো দেশেও ১৯৮০-এর দশকে এমন বহু দল গঠিত হয়েছিল, যারা আন্দোলনের দাবিদার বলে নিজেদের তুলে ধরেছিল; কিন্তু জনগণের নৈতিক শক্তি ধরে রাখতে না পারায় দলগুলো দ্রুত ভেঙে পড়ে।
এনসিপি এখনো নতুন এবং একটি অনির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠন। দলটির মধ্যে সাংগঠনিক দৃঢ়তা, রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ ও আদর্শিক স্থিতি—তিনটিই দুর্বল।
এনসিপির নেতৃত্বে এমন একদল বিদেশফেরত ও তাত্ত্বিক মানুষ আছে, যারা মাঠের বাস্তব রাজনীতিতে অভ্যস্ত নয়। তারা প্রায়ই অনলাইন ও ইউটিউবভিত্তিক চিন্তাচক্রের প্রভাবে কাজ করে, যা ম্যানুয়েল ক্যাসেলসের ‘নেটওয়ার্ক সোসাইটি’ তত্ত্বে বর্ণিত ‘ডিজিটাল প্রভাব রাজনীতি’র উদাহরণ; যেখানে বাস্তব সংগঠন নয়; বরং ক্ষণস্থায়ী অনলাইন নেটওয়ার্কই রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা তৈরি করে। এর ফলে এনসিপি এখনো মতাদর্শিকভাবে বিভক্ত এবং বাহ্যিক প্রভাবনির্ভর।
এ পরিস্থিতি স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের বিখ্যাত বই পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেঞ্জিং সোসাইটিস –এ বর্ণিত ‘রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ’ ধারণাটি মনে করিয়ে দেয়, যেখানে বলা হয়েছে অনভিজ্ঞ নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো প্রতিষ্ঠিত দলের সঙ্গে জোটে গেলে তা প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতি দুর্বল করে এবং ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’ তৈরি করে।
একইভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হুয়ান লিঞ্জ তাঁর দ্য ব্রেকডাউন অব ডেমোক্রেটিক রেজিমস বইয়ে অ্যান্টিসিস্টেম পার্টি ধারণায় দেখিয়েছেন, যে দলগুলো মূলধারার রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে; কিন্তু বিকল্প পথ দিতে পারে না, তারা শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।
এ রকম অবস্থায় বিএনপি যদি এনসিপিকে গণ–অভ্যুত্থানের ‘আসল’ প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় যায়, তাহলে সেটি বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত নয়, বরং দুর্বলতার লক্ষণ হবে।
ভাবধারা বিশ্লেষণ ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাজনীতি শুধু ‘ঘোষণাপত্র নয়’—ভাষা, প্রতীক, দেহভঙ্গি ও সাংগঠনিক সংস্কৃতিও বটে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার, পিয়েরে বর্দিয়ু ও জ্যাক দেরিদার ভাবধারা অনুসারে যদি এনসিপিকে দেখা হয়, তবে তাদের রাজনৈতিক ভাষা ও আচরণে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রভাব স্পষ্ট।
তারা মুখে মধ্যপন্থার দাবি করলেও তাদের ব্যবহৃত ভাষা–শব্দ, সাংগাঠনিক ও ব্যবহারিক আচার–আচরণে ধর্মীয় রাজনৈতিক ভাবধারার প্রতিফলন দেখা যায়। এই বিশ্লেষণ বর্দিয়ু ‘সিম্বলিক পাওয়ার’ ও দেরিদার ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ ধারণার সঙ্গেও মেলে—যেখানে প্রতীকী ভাষার আড়ালে লুকানো মতাদর্শ উন্মোচিত হয়।
বিএনপির জন্য প্রশ্ন এখন স্পষ্ট—দলটি কি নিজেদের বাংলাদেশপন্থী জাতীয়তাবাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পথে থাকবে, নাকি জামায়াতপ্রভাবিত ভাবধারার এনসিপির সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা করবে?
ম্যাক্স ওয়েবারের ‘ভ্যালু রাশনালিটি’ ধারণা অনুযায়ী, নীতি ও আদর্শের জায়গায় কৌশলগত লাভকে অগ্রাধিকার দিলে দলীয় চরিত্র দুর্বল হয়। বিএনপি যদি জামায়াত থেকে দূরে থেকে, আবারও সেই একই ভাবধারার দলের সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করে, তবে সেটি হবে আদর্শগত দ্বিচারিতা।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বিএনপি-জামায়াত জোটে বিএনপির রাজনৈতিক লাভ হয়নি; বরং এতে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় দুর্বল হয়েছে।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে এনসিপি কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে; এরকম হলে একদল মূল নেতৃত্বের সাথে থাকবে, একদল সেকুলার বা উদার ধারায় যাবে এবং আরেক দল ধর্মীয় বা কট্টর জাতীয়তাবাদী পথে যাবে। ইতিহাসের ধারায় এটা নতুন কিছু নয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
জাসদ একসময় কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল। ১৯৯০-এর দশকে জাসদের কিছু নেতা প্রথমে বিএনপির ঘনিষ্ঠ হয়েছিল; কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। জাসদ পরে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে যায় এবং ইতিহাসের অনেক দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপায়। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তব চিত্র—ক্ষমতা পাল্টালে বয়ানও পাল্টে যায়।
একইভাবে ভবিষ্যতে এনসিপির কোনো অংশ যদি আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে যায়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই; আওয়ামী লীগ তাদের গ্রহণ করবে, এই উদ্দেশ্যে যে একসময় তাদের মুখ দিয়েই বলাবে, ‘এই আন্দোলন ছিল সরকার উৎখাতের একটি চক্রান্ত।’ অর্থাৎ ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হতে পারে। বিএনপি যদি আজ এই বাস্তবতা না বোঝে, তবে ভবিষ্যতের দায় তাদের নিজের কাঁধেই নিতে হবে।
‘অন্তর্ভুক্তিহীন’ ঐকমত্য
বিএনপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। অনেকেই এটাকে রাজনৈতিক বাস্তবতার চাপে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। তবে জাতীয় ঐকমত্যের প্রতি অঙ্গীকার থেকেও দলটি এ কাজ করেছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে ঐকমত্যের প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা দেখানো জরুরি মনে করে বিএনপি হয়তো এনসিপিসহ নতুন কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্ভাব্য জোট বা সমঝোতা নিয়ে আলোচনা করছে। জোট বা সমঝোতার কথা বলা হলেও এ প্রক্রিয়া কোনোভাবেই পূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বিএনপি এমন কোন প্রক্রিয়ায় কেন যুক্ত হবে, যেখানে গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ—দুটিই অনুপস্থিত। রাজনৈতিক চাপ বা জোটের সম্ভাব্য সুবিধার কথা বিবেবচনায় নিলেও এটি বিএনপির নীতিগত অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়।
এখানেই বিএনপির জন্য আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরি হয়। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে তাদের দায়িত্ব ছিল অন্তর্ভুক্তির সীমাবদ্ধতাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং আরও প্রতিনিধিত্বশীল আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া। অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো ঐকমত্যই টেকসই হয় না; বরং ভবিষ্যতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা জনগণের কাছ থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব