বাজারের আগুনে পকেট পোড়ে, মন জ্বলে কীসে?

‘ভাই, আপনারা যে বাজারদর লেখেন, মনে হয় না বাজারে গিয়ে যাচাই করেন!’—কথাগুলোয় আগুনের হলকা অনুভূত হলো! একই ভবনের ফ্ল্যাটের ভাড়াটে, সেই সূত্রে পরিচয়, কিছুটা সখ্যও। সংবাদপত্রে কাজ করি বলে কথাগুলো আমাকে লক্ষ্য করে বলা। শুরুতে একে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মনে হলো বটে, তবে ভদ্রলোকের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বলার পর বোঝা গেল, আসলে কথাগুলোর উল্টো পিঠে আছে একজন মানুষের অসহায়ত্বের প্রকাশ।

না, এমন নয় যে দিন আনি দিন খাই অবস্থা ভদ্রলোকের; একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যম সারির কর্মকর্তা। দুটি সন্তানের একটি নামকরা এক বিদ্যালয়ে ইংরেজি সংস্করণে পড়ে, ছোটটির অবশ্য বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়নি এখনো। মোটামুটি সচ্ছল, মধ্যবিত্ত বলতে যা বোঝায় তিনি সেই শ্রেণিভুক্ত। কারও কাছে হাত পাততে হয় না, ঋণ নেই কারও কাছে। এমন ‘নির্ভার’ জীবনের মানুষটিও যেন তলিয়ে যাচ্ছেন। বললেন, আজ (১৮ নভেম্বর) আপনারা লিখেছেন, ‘মানুষের কষ্ট আরও বাড়ল’। এতে নিত্যপণ্যের যে দর লেখা হয়েছে, বাজারে গিয়ে দেখুন তো ওই দামে পাওয়া যায় কি না? পাবেন না! তার চেয়েও পাঁচ-সাত-দশ টাকা করে বেশি লাগছে। নিত্যপণ্যের বাইরে আরও যে অনেক জিনিস লাগে সংসারে, সেগুলোর দামেও হাত পুড়ে যাওয়ার দশা।

উদাহরণ টেনে বললেন, গত আড়াই-তিন মাসে সাবান-শ্যাম্পু, টুথপেস্ট ইত্যাদি যা কিনেছেন, প্রতিবারই আগের চেয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা করে বেশি লেগেছে। একই কোম্পানির একই পণ্য, নতুন করে বাজারে আসছে, আর গায়ে থাকছে দামের নতুন ‘সিল’। কিন্তু এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। এক কেজি আটার দাম ৭১ টাকা—বিশ্বাসই হয় না!

একটু দম নিলেন ভদ্রলোক। দুই হাতের দুটো ব্যাগ নিচে রেখে একটু ম্লান হেসে বললেন, ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না! কাকে আর বলব, বলেন? নালিশ জানানোর কি কোনো জায়গা আছে আমাদের?’ হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ ছুঁয়ে বললাম, ‘ভাড়াটে ভাড়াটে ভাই ভাই; মন খুলে বলেন ভাই!’ ছন্দে ছন্দে জবাবটা শুনে হাসলেন একচোট। বললেন, জানেন, মায়ের জন্য রক্তচাপের ওষুধসহ আরও কিছু ওষুধ নিয়মিত কিনতে হয়। নিজেরও লাগে। প্রতিটি ওষুধের দাম বেড়েছে পাতায় ২০ থেকে ৪০ টাকা। ইসবগুলের ভুসি লাগে। দুই মাস আগেও দাম ছিল সাড়ে ৯০০ থেকে হাজার টাকা কেজি; এখন ১ হাজার ২০০ টাকা। চিয়া বীজ এক মাস আগেও ছিল সাড়ে পাঁচ-ছয় শ, পরশু দিন কিনলাম সাড়ে নয় শ করে। অসুস্থ, বয়স্ক মানুষদের জন্য এগুলো কিন্তু ‘নিত্যপণ্য’ই। অথচ আড়ালে আড়ালে এগুলোর দাম বাড়ছে ফি-সপ্তাহে!

যে পণ্য পাঁচ-ছয় মাস বা তারও আগে আমদানি করা, সেগুলোরও দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বলতে পারেন, পণ্যের দাম যেন লাগামছুট ঘোড়া; কিন্তু কার টেনে ধরার কথা এই লাগামের? উত্তর নেই! তাই কষ্ট যে কতটা ‘বাড়ল’, তার ‘পরিমাপ’ করারও কেউ নেই, পরিত্রাণেরও উপায় নেই! কী বলব আর! খাদ্য অধিদপ্তরের খোলা বাজারে (ওএমএস) পণ্য বিক্রির লাইনেও দাঁড়াতে পারি না, আবার এদিকে বাজারে গিয়েও পেরে উঠছি না!

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, অনেক পণ্যের আমদানি বন্ধ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ডলারের ঘাটতি আরও কত কারণের কথা বলা হচ্ছে বাজারের অস্থিরতার জন্য। কিন্তু আপনি বাজারে গিয়ে দেখুন, কোনো পণ্যের ঘাটতি কিন্তু নেই। যে পণ্য পাঁচ-ছয় মাস বা তারও আগে আমদানি করা, সেগুলোরও দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বলতে পারেন, পণ্যের দাম যেন লাগামছুট ঘোড়া; কিন্তু কার টেনে ধরার কথা এই লাগামের? উত্তর নেই! তাই কষ্ট যে কতটা ‘বাড়ল’, তার ‘পরিমাপ’ করারও কেউ নেই, পরিত্রাণেরও উপায় নেই! কী বলব আর! খাদ্য অধিদপ্তরের খোলা বাজারে (ওএমএস) পণ্য বিক্রির লাইনেও দাঁড়াতে পারি না, আবার এদিকে বাজারে গিয়েও পেরে উঠছি না!

আর ভাই, আপনি নিজেও তো ভুক্তভোগী, গ্যাস সংযোগ থাকার পরও আলাদা করে সিলিন্ডার কিনতে হয়—এটা মগের মুলুক নাকি? ঢাকার জিগাতলার এই হাজি আফসার উদ্দিন লেনের বাইরে আর কোন কোন এলাকার এ দশা, জানি না, কিন্তু বছরের পর বছর এখানে এই পরিস্থিতি চলছে। প্রতি মাসে সরকার নির্ধারিত দুই চুলার জন্য ১ হাজার ৮০ টাকা বিল দিতে হচ্ছে, উপরন্তু সিলিন্ডারের জন্য পকেট থেকে টাকা খসছে। দিনের বেশির ভাগ সময় লাইনে গ্যাস থাকে না। গরমকালে তাও একটু-আধটু চলে যায়, শীতকালে যেন লাইন শুকিয়ে যায়! আর তা-ও নাহয় আফসোস, একটু কম হতো যদি সরকারের ঠিক করা দামে সিলিন্ডারটাও পাওয়া যেত! এ মাসের (নভেম্বর) জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ১২ কেজির সিলিন্ডারের এলপিজির দাম নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ২৫১ টাকা। এ মাসে এখনো কিনতে হয়নি, কিন্তু গত মাসে কিনেছি ১ হাজার ৪০০ টাকায়। অথচ ওই মাসে বিইআরসির বেঁধে দেওয়া দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। এই গলির (হাজি আফসার উদ্দিন লেন) মাথায় একজন বিক্রি করেন, তাঁর এককথা, ‘এক দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা। নিলে ন্যান, না নিলে যান।’ মনটা যতটা না খারাপ হলো, তার চেয়ে বেশি রাগ হলো! গেলাম একটু দূরে ট্যানারি মোড়ে, সেখানেও একই দাম। সেখান থেকে মিতালি রোডের এক দোকানে গিয়েও শুনলাম বিক্রেতার মুখে সেই এক বুলি—‘নিলে ন্যান, না নিলে ফোটেন, দামাদামি নাই।’ দোকানিদের দাবি, ‘আমরাই নির্ধারিত দামে পাই না, আপনাদের দিমু ক্যামনে?’

আরও পড়ুন

ভাই, তাহলে আপনিই বলেন, কেমন করে মাথা ঠিক রাখা যায়?—এই বলে নিচে রাখা ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। এক পা বাড়িয়েও আবার থামলেন। বললেন, আপনাকে যখন এত কথা বলেই ফেললাম, আরেকটু কথা বলি। বাচ্চাদের কাগজপত্র-কলম-পেনসিলের দাম কতটা বেড়েছে, খেয়াল করেছেন? যে খাতা ছিল ৩০ টাকা, সেটা এখন ৫০-৬০ টাকা।

দেখা-সাক্ষাৎ হলেই যিনি হাসিমুখে কুশল বিনিময় করতেন, আজ তিনি যেন ‘অন্য মানুষ’। সময়টা এখন এমন যে মোটামুটি মধ্যম আয়ের একজন শিক্ষিত সফল ব্যক্তিও নিজে অসহায় বোধ করছেন; স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না নিজের অবস্থানে, তাঁর পা টলে যাচ্ছে! আর সে কথাগুলোই শহুরে সহবতের ‘দূরত্ব’ ঘুচিয়ে আপনজনের মতো একজন সংবাদকর্মীর সামনে উগরে দিলেন। তিনি হয়তো জানেন না, এতে তেমন কোনো ইতরবিশেষ হবে না। সংবাদকর্মী কথাগুলো লিখতে পারেন, ব্যক্তিগতভাবে ব্যথিত বোধ করতে পারেন, কিন্তু কিছু করার ‘ক্ষমতা’ রাখেন না। যাঁরা করার মালিক তাদের তো কোনো কিছুই গায়ে লাগে বলে মনে হয় না।

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
    [email protected]