কোনো নির্বাচনে এরদোয়ান হারেননি, কিন্তু এবার পাহাড়সম চাপ নিয়ে নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে তাঁকে।
ছবি: এএফপি

দুই দশক ধরেই ইরান ও তুরস্কে নির্বাচনের আগে পশ্চিমা গণমাধ্যম বলতে শুরু করে, ক্ষমতাসীনেরা হেরে যাবে। বিরোধী পক্ষের পালে জোর হাওয়া লেগেছে বলে প্রচার–প্রচারণা শুরু করে। কিন্তু ইরান ও তুরস্কে ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এবারও তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনার পারদ চরমে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো যথারীতি বলছে, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আমলের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। কম–বেশি সব কটি পশ্চিমা গণমাধ্যমের আভাস হচ্ছে, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির এরদোয়ানকে হারিয়ে দিতে পারেন রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা কামাল কিলিচদারোগলু।

এরদোয়ানের পরাজয় বা ক্ষমতা থেকে নির্বাসন পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। তবে এর আগে কোনো নির্বাচনে এরদোয়ান হারেননি, কিন্তু এবার পাহাড়সম চাপ নিয়ে নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে তাঁকে। তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ। মূল্যস্ফীতি ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে। কোথাও কোথাও শতভাগ। সাম্প্রতিক ভূমিকম্প অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে আরও নাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে ভোটারদের মধ্যে এরদোয়ানের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

কামাল আতাতুর্ক নাকি এরদোয়ানের তুরস্ককে নেবে তুর্কিরা

২০ বছর আগে ক্ষমতায় এসে এরদোয়ান যেভাবে তুরস্কের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন, গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০১৩ সালের পর, তা আর ধরে রাখতে পারেননি। দ্রব্যমূল্যের উচ্চগতি শহুরে নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে।

এই অনাস্থা, অসন্তোষকে পুঁজি করেই কামাল কিলিচদারোগলু অন্য বিরোধীদের নিয়ে একাট্টা হয়ে এবারের নির্বাচনে মাঠে নেমেছেন। বিরোধীদের প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় অর্থনৈতিক দুরাবস্থার বিবরণ দেওয়া হচ্ছে। কিলিচদারোগলুর সঙ্গে নির্বাচনী জোটে আছে আরও পাঁচটি দল। এই জোটে ফেতুল্লা গুলেনের বামপন্থী সমর্থকেরা যেমন আছেন, আছে এরদোয়ানের গুরু নেজমুদ্দিন এরবাকানের দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইসলামপন্থী সাদত পার্টি। আরও আছে এরদোয়ানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাউদওলুর ফিউচার পার্টি, সাবেক অর্থমন্ত্রী আহমেদ বাবাজানের দেবা পার্টি, বামপন্থী ডেমোক্রেটিক পার্টি। এ ছাড়া অঘোষিতভাবে এই জোটে রয়েছে কুর্দিশ রাজনৈদিক দল হেদেপে।

বিভিন্ন মত ও পথের দল এরদোয়ানকে হারাতে জোট গঠন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উদারপন্থী হিসেবে পশ্চিমাদের সমর্থন পেলেও এই জোট গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী দল সাদত পার্টি। মূলত সাদত পার্টির নেতা তেমেল কারামোল্লাউলু এই জোট গঠনের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সাদত পার্টির অফিস থেকেই এরদোয়ানবিরোধী জোট গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

এরদোয়ান কি এবার হারবেন?

১৪ মের নির্বাচনে এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভাগ্য নতুন করে লেখা হবে। জিতলে তুরস্কের ইতিহাসে নতুন উচ্চতায় চলে যাবেন আর হারলে কারাবাস, মৃত্যুদণ্ড—অনেক কিছুই হতে পারে। বিভিন্ন জরিপে কামালের জয়ের পাল্লা বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এখনই আশা ছাড়ছেন না এরদোয়ানের সমর্থকেরা। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে বেরিয়ে আসবেন বলে এরদোয়ানের সমর্থক, ভক্তরা প্রত্যাশা করছেন।

বিপরীতে এরদোয়ান জাতীয়তাবাদী, ইসলামপন্থী, মধ্যপন্থী ও কুর্দিশদের একাংশ নিয়ে জোট গঠন করেছেন। গত রোববার ইস্তাম্বুলে ১৭ লাখ মানুষের সমাবেশ করেছেন এরদোয়ান। এই সমাবেশকে গত ১০০ বছরের মধ্যে তুরস্কের সব থেকে বড় সমাবেশ বলা হচ্ছে। ৩৯টি প্রদেশ থেকে ১০ হাজার বাসে করে তপ্ত গরমের মধ্যে এরদোয়ানের সমর্থকেরা সমাবেশে যোগ দেন।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিশাল জনসমাবেশ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। জনসমাগমের পাশাপাশি এরদোয়ান চেষ্টা করেছেন অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে বিভিন্ন সুবিধা বাড়িয়ে ভোটারদের কাছে টানতে। গত দুই বছরে চারবার বেতন বাড়ানো হয়েছে। অবসরপ্রাপ্তদের ভাতা ও সুবিধা বাড়িয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তার পরিধি আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই মনে করছেন, ভূমিকম্পের আঘাতও সামলে নিয়েছেন এরদোয়ান।

এবারের নির্বাচনে মূলত প্রবীণ ও মধ্যবয়স্কদের সঙ্গে তরুণ ভোটারদের মধ্যে লড়াই হবে। প্রবীণ ও মধ্যবয়স্কদের মধ্যে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা বেশি। ওদিকে তরুণেরা ভিড়ছেন কামাল কিলিচদারোগলুর ডেরায়। আবার নারী ভোটদের মধ্যে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা বেশি। কামালপন্থীরা স্বীকার করেছেন, ১১ মিলিয়ন নারী ভোটার নির্বাচনে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন। এই নারী ভোটাররা কামালের জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারেন। এ ছাড়া গ্রামীণ রক্ষণশীল সমাজে এরদোয়ানের শক্ত অবস্থান রয়েছে।

আরও পড়ুন

যে কারণে এরদোয়ান জিতলেও হারতে বাধ্য

কিন্তু বিভিন্ন জরিপের আভাস হচ্ছে, এরদোয়ানের শক্ত অবস্থান ভেঙে এবার কামাল বেরিয়ে আসতে পারেন। শেষ মুহূর্তে রিপাবলিকান পিপলস পার্টির গতবারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুহাররেম ইনচের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে সুবিধা পেতে পারেন কামাল। কিন্তু ইনচের ভোটররা কামালকে ভোট না–ও দিতে পারেন। কারণ, কামালের সঙ্গে কুর্দিশ রাজনৈতিক পিকেকের সঙ্গে সখ্য রয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে কুর্দি দল হেদেপে কামালের জোটেই রয়েছে। পিকেকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে এই দলের প্রধান সালাউদ্দিন দেমিরতেস জেলে আছেন।

এরদোয়ান ক্ষমতায় থাকলে দেমিরতেসের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই পিকেকের সমর্থকেরা কামালকে ভোট দিতে পারেন। আবার কামাল পিকেকের ভোট পাচ্ছেন বা পিকেকের সঙ্গে সখ্য রয়েছে, তা প্রমাণ করতে পারলে তুর্কিরা খেপে যাবেন। ইনচে নিজেই কুর্দি বা পিকেকেবিরোধী বলে পরিচিত। ফলে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও কামাল ইনচের সব সমর্থকের ভোট পাবেন না। এরদোয়ানও এর সুযোগ নিচ্ছেন। প্রতিটি সমাবেশেই কামালের সঙ্গে পিকেকের সখ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এর পাশাপাশি এরদোয়ান রক্ষণশীলদের ভোট কবজা করতে চাইছেন কামালের একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে।

এরদোয়ান অভিযোগ করছেন, কামাল জিতে গেলে তুরস্কের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। তরুণেরা রাস্তায় বসে মদ পান করবে। কারণ, কামাল নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে বলেছেন, তিনি তরুণদের ইউরোপের জীবন দিতে চান। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা রাস্তায় যা করতে চাও, তা–ই করতে পারবে।’

গত রোববার ইস্তাম্বুলে ১৭ লাখ মানুষের সমাবেশ করেছেন এরদোয়ান। এই সমাবেশকে গত ১০০ বছরের মধ্যে তুরস্কের সব থেকে বড় সমাবেশ বলা হচ্ছে।
ছবি: এএফপি

কামাল কিলিচদারোগলুর নেতৃত্বাধীন জোটকে পশ্চিমা গণমাধ্যম উদার ও আধুনিক জোট বলে প্রচার করলেও এই জোটের বিরুদ্ধে জোনোফোবিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। খোদ কামাল কিলিচদারোগলুর প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, তিনি জিতলে দুই বছরের মধ্যে সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠাবেন। তাঁর ঘোষণার কারণে শুধু সিরিয়ান উদ্বাস্তুরাই না, ইরাকি ও ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তুরাও ঝুঁকির মধ্যে পতিত হবেন। আঙ্কারাসহ বিভিন্ন শহরে কামালের রিপাবলিকান পিপলস পার্টির কট্টর সমর্থকেরা বিদেশিদের ধরে ধরে নাম–পরিচয় জানতে চান। কারণ, কট্টর জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন, উদ্বাস্তু ও বিদেশিদের কারণে তুরস্কের অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তাঁদের তুরস্ক থেকে বের করে দেওয়া উচিত বলে তাঁরা প্রচারণা চালাচ্ছেন।

এরপরও ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা মাথায় রেখেই কামাল কিলিচদারোগলুকে পশ্চিমারা সমর্থন করছে। কারণ, নানা মত ও পথের কারণে কামালের নেতৃত্বে সরকার হবে দুর্বল। এই সরকারে বামপন্থী, ইসলামপন্থী, উদারপন্থী ও কট্টর জাতীয়তাবাদীরা থাকবেন। এ ছাড়া নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও অর্থনৈতিক সংকট সম্ভাব্য কামাল সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এসব কারণে কামালের সরকার দীর্ঘস্থায়ী না–ও হতে পারে এবং কামালকে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা যাবে।

পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য সম্ভবত সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন করে দীর্ঘ মেয়াদে মিসরের সিসির মতো বিশ্বস্ত কাউকে তুরস্কের ক্ষমতায় আনা। ২০১৪ সালের একবার সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়েছিল। এরদোয়ান নাটকীয়ভাবে সেই অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দেন।

আরও পড়ুন

এরদোয়ান কি ক্ষমতার তৃতীয় দশকে প্রবেশ করতে চলেছেন?

কিন্তু কামালের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ ঠেকানো কঠিন হবে। তবে সামরিক হস্তক্ষেপের আগে কামালকে দিয়ে এরদোয়ানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মিসরের মোহাম্মদ মুরসির পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হতে পারে। কামালের জোটসঙ্গী গুড পার্টির নির্বাচনী প্রচারণায় পরাজিত হলে এরদোয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বলা হচ্ছে। রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে এরদোয়ানকে মুছে দিতে পারলে তুরস্ক আগের মতো পুরোপুরি পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।

এরদোয়ানের ওপর পশ্চিমাদের ক্ষোভের কারণ হচ্ছে, তিনি তুরস্ককে স্বতন্ত্র অবস্থানে নিয়ে গেছেন। ন্যাটোর সদস্য হয়েও রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। আরবের রাজনীতি এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ দুই অনারব রাষ্ট্র—ইরান ও তুরস্ক। এর মধ্যে ইরান সৌদি আরবের নতুন করে সখ্য স্থাপন আরও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মূলত ইরান ও তুরস্কের কারণেই সিরিয়ার যুদ্ধ পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়েছে। তুরস্ক ও ইরাক থেকে সন্ত্রাসীরা পিছু হটেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাশিয়া এ যুদ্ধে প্রবেশ করেছে ইরান ও তুরস্কের কারণেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে এই দুই দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, বিরোধী মত দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি তুরস্কের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

১৪ মের নির্বাচনে এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভাগ্য নতুন করে লেখা হবে। জিতলে তুরস্কের ইতিহাসে নতুন উচ্চতায় চলে যাবেন আর হারলে কারাবাস, মৃত্যুদণ্ড—অনেক কিছুই হতে পারে। বিভিন্ন জরিপে কামালের জয়ের পাল্লা বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এখনই আশা ছাড়ছেন না এরদোয়ানের সমর্থকেরা। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে বেরিয়ে আসবেন বলে এরদোয়ানের সমর্থক, ভক্তরা প্রত্যাশা করছেন।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক