পাঠদানের সময় বাড়ালে শিক্ষার মানও কি বাড়ে?

‘যত গুড় তত মধু’—প্রচলিত বাক্যের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘যত ক্ষণ তত মান’ শব্দবন্ধটি প্রাসঙ্গিক বলেই বোধ হয়। এ নিয়ে যে দ্বিমত নেই, তা নয়। যেমন ছোটবেলায় অনেক অপ্রকৃতিস্থ লোক সম্পর্কে শুনেছি, ‘বেশি পড়তে পড়তে লোকটা শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে গেল।’ একই কারণে ১৮৭১ সালে এডওয়ার্ড জার্ভিস আমেরিকার শিক্ষাসম্পর্কিত একটি সরকারি রিপোর্টের নাম দিলেন ‘শিক্ষার সঙ্গে পাগলামির সম্পর্ক’। তাঁর গবেষণাধীন ১ হাজার ৭৪১ জন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের ২০৫ জনই অতিরিক্ত লেখাপড়া করার কারণে পাগল হয়ে গিয়েছিল। 

একইভাবে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হোরেস মান লিখলেন, বেশি লেখাপড়ায় ‘চরিত্র ও অভ্যাসের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়ে...বেশি মাথা খাটালে সেটা প্রায়ই স্বাস্থ্যহানিকর হয়।’ শিক্ষাবিদ কেনেথ গোল্ডেরও ওই একই কথা, ‘লেখাপড়ার সময়টা কমাতে হবে, ওরা যত বেশি বিশ্রামে থাকবে, ওদের মাথার ক্ষতি তত কম হবে।’ একেবারে হাল আমলের শিক্ষাবিদ পাসি সাহলবার্গও তাঁর নিজের দেশ ফিনল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন যে সে দেশে স্কুলের সময় ও বাড়ির কাজ দুটিই কম বলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় এত ভালো। 

এটা সত্যি যে এসব শিক্ষাবিদের কথার পেছনে তথ্য-যুক্তি-প্রমাণ আছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে দেশ ও শিক্ষার্থীভেদে এই যুক্তি পাল্টে যাবে। একটি ধনী দেশের গরিব স্কুলের উদাহরণ দেওয়া যাক। 

নিউইয়র্ক শহরের গরিব একটি এলাকার খুব গরিব ছাত্রদের জন্য ‘কিপ’ নামের একটি স্কুল আছে। স্কুলটিকে বাইরে থেকে দেখলে আপনি হতাশ হবেন। কিন্তু ভেতরের পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের দেখে আপনার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে যাবে। আপনি বুঝবেন ‘কিপ’ কেন নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুলগুলোর মধ্যে একটি। ওখানকার প্রায় অশিক্ষিত এবং দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা সব বিষয়েই ভালো, গণিতে একেবারে অসাধারণ। 

স্কুলটি এ কারণে ভালো নয় যে সেখানে আহামরি কোনো শিক্ষাক্রম, শিক্ষক, বাড়তি কোনো সুবিধা বা নতুনত্ব আছে। সেখানে যেটা আছে, সেটা হচ্ছে শিখন-শেখানোর জন্য প্রচুর সময়। শিক্ষার্থীরা ওখানে সকাল ৭টা ২৫ থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত থাকে। সকাল ৭টা ৫৫ পর্যন্ত তারা সবাই চিন্তা দক্ষতার ওপর একটা কোর্স করে। তারপর ৯০ মিনিট করে একটি অঙ্ক ও একটি ইংরেজি ক্লাস হয়। তবে পঞ্চম গ্রেডের গণিতের ক্লাসটি দুই ঘণ্টার। বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের ক্লাসগুলো এক ঘণ্টা করে। এ ছাড়া সংগীত, খেলাধুলা, ক্লাব কার্যক্রম ইত্যাদি তো আছেই। সব মিলিয়ে অন্য সব স্কুলের চেয়ে শিক্ষার্থীরা এখানে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সময় বেশি থাকে। 

এর ব্যাখ্যা একটাই। উচ্চবিত্তরা সামর্থ্য থাকার কারণে ছুটির ভেতরেও নিজেদের উদ্যোগে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছে কিন্তু অন্যরা পিছিয়ে গেছে। এটা প্রমাণ করে শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের জন্য প্রচুর সময় ও ধৈর্য অপরিহার্য। এগুলো বেশি বলেই এশিয়ানরা পশ্চিমাদের চেয়ে গণিতে ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে যদি বছরে ১৮০ দিন স্কুল খোলা থাকে, তো দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকে ২২০ দিন এবং জাপানে ২৪৩ দিন। বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমে এটা ১৮৫ দিন হলেও একজন শিক্ষার্থীকে এর সঙ্গে আরও ১৩০ ঘণ্টা বেশি কাজ করতে হবে। 

এতে যে অনেক লাভ হয়, সেটা স্কুলের ফলাফল দেখেই বোঝা যায়। তবে সেই স্কুলের শিক্ষক ফ্র্যাঙ্ক করকোরান তাঁর গণিত ক্লাসের নগদপ্রাপ্তির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, কম সময়ের সাধারণ গণিত ক্লাসে সবকিছু তাড়াহুড়া করে করতে হয়। ফলে যাদের দ্রুত শেখার ক্ষমতা আছে, তারা শিখে ফেলে বটে, তবে অন্যরা পিছিয়ে যায়। কিন্তু সময়টা বেশি পাওয়া গেলে শিক্ষক যেমন সময় নিয়ে বোঝাতে পারেন, তেমনি অন্য শিক্ষার্থীরাও বারবার প্রশ্ন করে তা ভালোভাবে বুঝে নিতে পারে। ফলে অন্য স্কুলে গণিতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী শিক্ষার্থীতে যে পার্থক্য থাকে, এখানে তা দেখা যায় না। 

তবে এত লম্বা সময়ের স্কুলে কি শিক্ষার্থীদের অসুবিধা হয় না? স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড লেভিন বলেন, প্রথম প্রথম হয়। বিকেলের দিকে তারা অস্থির হয়ে ওঠে। তখন তারা ধৈর্য ধারণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রয়োগ করে, শিক্ষকেরা তাদের অনুপ্রাণিত করেন, পুরস্কার দেন ও নিয়মানুবর্তিতা শেখান। কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা এসব আত্মস্থ করে ফেলে। 

শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠদানের সময় যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেটা জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল আলেকজান্ডার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন। তিনি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত—এই তিন ধরনের মোট ৬৫০ জন শিক্ষার্থীর ফলাফলের উপাত্ত নিয়ে দেখলেন উচ্চবিত্তরা অন্যদের চেয়ে একটু ভালো, তবে তেমন কিছু নয়। এবার আলেকজান্ডার ফলাফলগুলোকে অন্য দুভাবে দেখলেন। যখন সেপ্টেম্বরে ওদের ক্লাস শুরু হয়, তখন থেকে শেষ মাস অর্থাৎ জুন পর্যন্ত কাদের উন্নতির হার কত, সেটা দেখলেন। দেখলেন সবচেয়ে ভালো করেছে মধ্যবিত্তরা, তারপর নিম্নবিত্তরা, আর সবচেয়ে খারাপ হলো উচ্চবিত্তরা। কিন্তু জুলাই–আগস্টে গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে স্কুলে আসার পর পড়ার দক্ষতার ওপর একটা টেস্ট নিয়ে দেখলেন উচ্চবিত্তরা যেখানে পেয়েছে ৫২ দশমিক ৪৯, সেখানে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা পেয়েছে শূন্য দশমিক ২৬ ও ৭ দশমিক শূন্য ৯। অর্থাৎ উচ্চবিত্তরা অনেক এগিয়ে। 

আরও পড়ুন

এর ব্যাখ্যা একটাই। উচ্চবিত্তরা সামর্থ্য থাকার কারণে ছুটির ভেতরেও নিজেদের উদ্যোগে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছে কিন্তু অন্যরা পিছিয়ে গেছে। এটা প্রমাণ করে শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের জন্য প্রচুর সময় ও ধৈর্য অপরিহার্য। এগুলো বেশি বলেই এশিয়ানরা পশ্চিমাদের চেয়ে গণিতে ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে যদি বছরে ১৮০ দিন স্কুল খোলা থাকে, তো দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকে ২২০ দিন এবং জাপানে ২৪৩ দিন। বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমে এটা ১৮৫ দিন হলেও একজন শিক্ষার্থীকে এর সঙ্গে আরও ১৩০ ঘণ্টা বেশি কাজ করতে হবে। 

যা–ই হোক, এখন শিক্ষকসহ সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে যেন একটা ঘণ্টাও নষ্ট না হয়। যদি হয়, তাহলে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের হয়তো কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু অন্যরা পিছিয়ে যাবে। গুণগত শিক্ষা অর্জনের জন্য যে সাম্য প্রয়োজন হয়, সেটা অর্জিত হবে না। 

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

আরও পড়ুন