প্রাথমিকের শিক্ষকেরা কি হাওয়া খেয়ে সোনার মোহর দেওয়া গল্পের গাই?

আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্ভবত সেই কবলেষী গাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হচ্ছে। তাঁরা মাসে যে সম্মানী পান, তা রীতিমতো তাঁদের সম্মানহানির সমান।ছবি: প্রথম আলো

ছেলেবেলায় গাইবিষয়ক একটা গল্প শুনতাম। গল্পটা সোনার মোহর দেওয়া ‘কবলেষী গাই’য়ের।

এই গাই অর্থাৎ গাভির নামের অর্থ তখন জানতাম না, আজও জানি না। তবে এর কাজকর্ম সম্পর্কে জানতাম। তা হলো, এই গাই ছিল উড়ুক্কু। সারা দিনমান মাঠে চরে বেড়াত। কিন্তু কিছু খেত না।

রাত হলেই উড়ে আসমানে চলে যেত। সেখানে থেকে হাওয়া খেয়ে সুবহে সাদিকের আগে ফিরে আসত। এসে ভোরবেলা যে গোবর দিত, তার মাঝে সোনার মোহর পাওয়া যেত।

আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্ভবত সেই কবলেষী গাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হচ্ছে। তাঁরা মাসে যে সম্মানী পান, তা রীতিমতো তাঁদের সম্মানহানির সমান।

আর বিশেষ করে ‘টিফিন ভাতা’ নামে যে অস্বাভাবিক ভাতা পান, তা শুনে যে কেউ তাঁদের কবলেষী গাই ভেবে বসতে পারেন।

আরও পড়ুন

২০১৫ সালের সর্বশেষ জাতীয় পে স্কেল অনুসারে, প্রাথমিকের শিক্ষকেরা মাসে ২০০ টাকা টিফিন ভাতা পান। অর্থাৎ দিনে ৬.৬৬ টাকা।

এই টাকায় সকাল ৯টা থেকে বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত চরে তাঁদের ‘সোনার মোহর’ প্রসব করতে বলা হয়। সেটা কি কবলেষী গাই না হলে সম্ভব?

এখন আসি প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম শর্তে। ২০১৮ সাল থেকে সহকারী শিক্ষক পদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্নাতক বাধ্যতামূলক।

এই যোগ্যতায় শিক্ষক নিয়ে বেতন দেওয়া হয় তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদায়—১৩তম গ্রেডে। যা সাকল্যে প্রায় ১৮ হাজার টাকা।

প্রধান শিক্ষক পদেও ন্যূনতম একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পদে আবার ৩৪তম বিসিএস থেকে শুরু করে নন-ক্যাডার হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেতন বা মর্যাদা? ১২তম গ্রেড, যার সাকল্যে বেতন ১৮ হাজার টাকার সামান্য বেশি।

আরও পড়ুন

মজার বিষয় হলো, একই বিসিএস থেকে অন্যান্য সব চাকরিতে ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণির সমমর্যাদায় বেতন-ভাতা দেওয়া হলেও ব্যতিক্রম ছিল শুধু প্রাথমিকেই।

এখানে আবার গেজেটে গালভরা দ্বিতীয় শ্রেণি উল্লেখ থাকলেও বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে সেই তৃতীয় শ্রেণির স্কেলেই। বিষয়টা অনেকটা সেই গল্পের গাইয়ের মতোই। এঁদের আবার অর্থ/সম্মান কিছু দিতে হয়?

এঁরাই তো উল্টো সোনার মোহর রূপে অর্থ/সম্মান দুটোই দেবে। এঁদের শুধু হাওয়া খাইয়ে পেলেপুষে রাখলেই হবে!

সে জন্যই হয়তো হতে যাওয়া নতুন পে স্কেলেও নাকি সহকারী শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হবে তৃতীয় শ্রেণির ১২তম গ্রেডে। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ধরা হয়েছে দশম।

কথা হলো, এই দ্বিতীয় আর তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদার শিক্ষকের কাছ থেকে জাতি কোন শ্রেণির ভবিষ্যৎ নাগরিক চায়?

আরও পড়ুন

নিশ্চয়ই দ্বিতীয়/তৃতীয় শ্রেণিরই! এই শিক্ষকদের কাছে পড়ে আপনি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির পদ পেলেও মনমানসিকতায় তো ‘সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস’ই থাকবেন।

এবার আসি, প্রাথমিকের শিক্ষকদের কি আসলেই বেতন দেওয়া উচিত? দিলে কত? এই প্রশ্নটা আসল মূলত সম্প্রতি সরকারের নতুন জাতীয় পে স্কেল গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই।

এই উপলক্ষে অনলাইনে জরিপে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তাতে সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি মত দেওয়ার সুযোগ আছে সাধারণ নাগরিকদেরও। খুবই ভালো উদ্যোগ।

এর আগে নতুন এই সরকার গঠনের পরপরই বেতন বাড়ানোর একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। নিদেনপক্ষে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়।

দৃশ্যত, সাধারণ নাগরিকদের (মূলত যাঁরা সরকারি চাকরি করেন না) তীব্র আপত্তির মুখে এসব উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে, দৃশ্যত এই সাধারণ নাগরিকেরা আসলে অতটাও সাধারণ নন। তাঁরা  আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেসরকারি চাকরিজীবী।

আরও পড়ুন

গ্রামের মাঠের কৃষক, শহরের খেটে খাওয়া মানুষ অন্ততপক্ষে ফেসবুক ব্যবহার করে মহার্ঘ ভাতার বিষয়ে মতামত দিতে পারার কথা না।

তাঁরা বরং যেকোনো চাকরিজীবীর বেতন বাড়লে খুশিই হন। কারণ, এর প্রভাব পড়ে বাজারেও। এর কিছুটা হলেও উপরি গিয়ে পরে সেই খেটে খাওয়া শ্রমিক, মেহনতি কৃষকের পাতেও।

অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকরূপী ব্যক্তিরা সম্ভবত সরকারি চাকরিজীবী মানেই মনে করেন ‘উপরি আয়’ করা কর্মচারী-কর্মকর্তাদের। যাঁদের কৃতকর্মের ফিরিস্তি প্রায়ই মিডিয়ায় প্রচারিত হয়।

এঁদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে এর আগুনটা গিয়ে পড়ে উপরি আয়ের উপায় না থাকা বিপুলসংখ্যক নিরীহ চাকরিজীবীর ওপর।

আরও পড়ুন

কথা হচ্ছে, এমন উপরি আয়কারী সরকারি চাকরিজীবী আসলে কজন? দেশে মোট সরকারি চাকরিজীবী কমবেশি ১৬ লাখ।

এর মধ্যে প্রাথমিকেই প্রায় ৪ লাখ। অন্যদের যদি না-ও ধরি, এই ৪ লাখ গোবেচারা শিক্ষকের উপরি আয়ের ‘সুযোগ’ কোথায়? অন্য চাকরিজীবী যাঁদের সে সুযোগ আছে, তাঁদের কজনই বা এর ‘সদ্ব্যবহার’ করেন?

সাধারণ নাগরিকরূপী ব্যক্তিরা ভুলে যান, সরকারি কর্মচারীদের অনেকে এই চাকরিতে যুক্ত হন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনের হাতছানি উপেক্ষা করে। অনেকে এই আশায় এ পেশায় আসেন যে, চাকরিটাতে বেতন কম হলেও শেষ বয়সটা নিশ্চিন্ত হবে। কিন্তু এই শেষ বয়সের আশায় এসে যে তাঁকে সারা জীবন গরিব থাকতে হবে, তা অনেকেই আগে ধারণা করতে পারেন না।

একটা সরল হিসাবে আসি। ধরেন, একজন ব্যক্তি ১০ বছর আগে ১০০ টাকা বেতন পেতেন। প্রতিবছর তাঁর বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি ৫ টাকা। ৯ টাকা হারে মুদ্রাস্ফীতি হলে পরের বছরই তাঁর বেতন গিয়ে দাঁড়ায় ৯৬ টাকায়। তাহলে ১০ বছর পর তাঁর বেতন কত হবে? ৬০ টাকা, তাই তো?

তাহলে সেই ২০১৫ সালের পর এই ২০২৫ সালে এসেও সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ালের কথা শুনলেই এক শ্রেণির মানুষ তেড়ে আসেন কেন?

আপনারা কি চান সরকারি চাকরিজীবী সবাই সেই কবলেষী গাই হয়ে আসমান থেকে আসা হাওয়া-বাতাস খেয়ে শুধু সোনার মোহরই দিয়ে যান? তাঁদের আত্মীয়-পরিজন নেই?

এখন প্রাথমিকের কথা যদি বলি, তবে অবস্থা আরও বেগতিক। প্রাথমিকে নারী শিক্ষকেরা পড়ানো বাদ দিয়ে উঁকুন মারেন, পুরুষেরা স্কুলের মাঠের পাশে সবজি চাষ করেন—ইত্যাকার অভিযোগের অন্ত নেই। এসব অভিযোগে অনেকে তাঁদের বেতনই বন্ধ করে দিতে চান।

কিছু উপরি আয়কারী সরকারি কর্মজীবীর অপকর্মের দায় যেমন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর পড়তে পারে না। তেমনি কিছু দায়হীন শিক্ষকের অবহেলাও পুরো শিক্ষক পরিবারের ওপর পড়তে পারে না। কাজেই এই অজুহাতে তাঁদের ন্যায্য বেতন বঞ্চিত করা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত নয়। বরং চাকরিতে যথাযথ পুরস্কার/তিরস্কারের ব্যবস্থা রেখে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ীই সম্মান ও সম্মানীর ব্যবস্থা করা দরকার।

এসব অভিযোগের সব যে অমূলক তা হয়তো নয়। কিন্তু কথা আগেরটাই—৪ লাখের মধ্যে মোট কতজন শিক্ষক এমন? ক্লাসে পাঠদান ছাড়াও শিশুজরিপ থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদ—প্রাথমিকে যে পরিমাণ কাজের বোঝা সরকার চাপিয়ে রেখেছে, তা কটা চাকরিতে আছে?

আর কিছু ফাঁকিবাজ শিক্ষকের দায় গোটা প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ বহন করবে কেন? প্রাথমিকে যদি ফাঁকিবাজি হয়, পড়ানো কম হয়—তবে তার দায় তো সমান হারে হর্তাকর্তাদের ঘাড়েও পড়ে। কর্তারা ফাঁকি দূর করতে পারেন না কেন? নাকি তাঁরাও দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে বসে থাকেন?

কিছু উপরি আয়কারী সরকারি কর্মজীবীর অপকর্মের দায় যেমন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর পড়তে পারে না। তেমনি কিছু দায়হীন শিক্ষকের অবহেলাও পুরো শিক্ষক পরিবারের ওপর পড়তে পারে না।

কাজেই এই অজুহাতে তাঁদের ন্যায্য বেতন বঞ্চিত করা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত নয়। বরং চাকরিতে যথাযথ পুরস্কার/তিরস্কারের ব্যবস্থা রেখে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ীই সম্মান ও সম্মানীর ব্যবস্থা করা দরকার।

সবচেয়ে ভালো হয়, শিক্ষকদের নিয়োগপ্রক্রিয়া পুরোটা পিএসসির মতো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিয়ে এখানে নবম গ্রেড দিয়ে শুরু করা।

আলাদা পে স্কেল দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে দেশের যেকোনো পেশার চেয়ে আকর্ষণীয় ও সম্মানিত করে তোলা। আর এই কাজটা করা সবচেয়ে সম্ভব ছিল সম্ভবত এই সরকারের আমলেই।

না হলে দৈনিক সাড়ে ৬ টাকা হারে টিফিন ভাতা দেওয়া শিক্ষকের কাছ থেকে গল্পের গরুর মতো সোনার মোহরের আশা করা শুধু আসমানেই ঘটবে, জমিনে তা আর দেখা দেবে না।

  • রঞ্জু খন্দকার: শিক্ষক ও লেখক
    [email protected]

    *মতামত লেখকের নিজস্ব