রাশিয়ার নির্বাচনই বলে দিল ইউক্রেন যুদ্ধ কতটা লম্বা হবে

সম্প্রতি ইউক্রেনের কাছ থেকে দখলে নেওয়া চারটি অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল

সম্প্রতি রাশিয়াতে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অবৈধ গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল (দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন) নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, সেসব অঞ্চলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনের ফলাফল যে পুতিন সরকারের আরেকটি ‘বিজয়’, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।

কিন্তু শত শত অভিযোগ আর অনিয়মের মধ্যে অনুষ্ঠিত রাশিয়ার অধিকৃত চারটি অঞ্চলে নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তা থেকে রাশিয়ার পরিকল্পনা এবং যুদ্ধের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা আঁচ করা যায়।

রাশিয়ার প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে গেলে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চাইল যে ওই চার অঞ্চল এখনকার মতো ও চিরদিনে জন্য রাশিয়ার ভূখণ্ড। কিন্তু ক্রেমলিনের চিন্তাভাবনার মান বিবেচনাতেও এই দাবি অন্তঃসারশূন্য।

আরও পড়ুন

এর কারণ হলো, রাশিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষিত চার অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ এখনো রুশ বাহিনী দখলে নিতে পারেনি। এমনকি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে মস্কোর আত্তীকরণের ঘোষণা দেওয়ার পর ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে কিছু পরিমাণ ভূখণ্ডও হারিয়েছেও তারা। এ ছাড়া রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও ইরানও ওই চার অঞ্চল যে রাশিয়ার, এখন পর্যন্ত সেই স্বীকৃতি দেয়নি।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে পরিচালিত পাল্টা আক্রমণ অভিযানের ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে খুব ধীরগতিতে। এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মস্কো এটাও দেখাতে চাইছে যে অধিকৃত ভূখণ্ডে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। রাশিয়ার বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে ওই চার অঞ্চলের অধিবাসীরা যে মানিয়ে নিয়েছে, সেটাও প্রমাণ করতে চায় রাশিয়া।

বিষয়টি ক্রেমলিনের তথাকথিত ‘বিশেষ সামরিক অভিযানকে’ (ইউক্রেনে অবৈধ আগ্রাসনকে এই নামেই ডাকে রাশিয়া) বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টাও।

আরও পড়ুন
সোভিয়েত কায়দায় যথার্থ নির্বাচনের মানে হলো, সব প্রার্থীকে আগে থেকেই সরকার অনুমোদন দিয়ে রাখবে। সুতরাং, এ ধরনের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না, ভোটারের কোনো পছন্দ-অপছন্দও থাকে না। স্বাধীন গণমাধ্যম আর নাগরিক সমাজের সংগঠন নির্বাচন ও ভোট গণনা পর্যবেক্ষণের সময় থাকে না। অধিকৃত চার অঞ্চলে নির্বাচনের ফলাফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। ক্রেমলিনের অনুগত ব্যক্তিরা এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

রুশীকরণের প্রচারণা

রাশিয়াতে সাধারণভাবে যে মানের পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন হয়, সেই বিবেচনাতেও এটিকে স্বাভাবিক নির্বাচন বলা যাবে না। রাশিয়া তাদের অধিকৃত চার অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে রুশ পাসপোর্ট দেওয়ার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তার অগ্রগতি এখন পর্যন্ত খুব একটা বেশি নয়। এ কারণে ক্রেমলিন নির্বাচনের আগে বিশেষ ফরমান জারি করে, যেসব বাসিন্দা ইউক্রেনীয় নাগরিকত্ব আছে, তাঁরা নিবন্ধন করে ভোটে দিতে পারবেন।

তা সত্ত্বেও চার অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর রাশিয়ানদের চাপ একটুও কমেনি। রাশিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করার জন্য তাঁদের ওপর জোর করা হচ্ছে। অথচ মস্কোর পক্ষ থেকে দেখানো হচ্ছে, ‘নতুন নাগরিক’ হতে তাঁরা কতটা ব্যাকুল।

অ-নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া কিংবা তাঁদের নাগরিকত্ব পাল্টে দেওয়ার মানে এই নয় যে ইউক্রেনের সার্বভৌম ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে নেওয়া বৈধ ও আইনসংগত। কিন্তু এই নির্বাচন সাধারণ রাশিয়ানদের বিষয়টির সঙ্গে ধাতস্থ করার একটি প্রক্রিয়া।

আরও পড়ুন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তার দৃষ্টান্তও আছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ভূখণ্ড ক্রিমিয়া দখলে নেওয়ার পরও একই চিত্র দেখা গেছে। ৯ বছর ধরে ক্রিমিয়া নিজেদের দখলে রেখেছে রাশিয়া।

সোভিয়েত কায়দায় যথার্থ নির্বাচনের মানে হলো, সব প্রার্থীকে আগে থেকেই সরকার অনুমোদন দিয়ে রাখবে। সুতরাং, এ ধরনের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না, ভোটারের কোনো পছন্দ-অপছন্দও থাকে না। স্বাধীন গণমাধ্যম আর নাগরিক সমাজের সংগঠন নির্বাচন ও ভোট গণনা পর্যবেক্ষণের সময় থাকে না। অধিকৃত চার অঞ্চলে নির্বাচনের ফলাফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। ক্রেমলিনের অনুগত ব্যক্তিরা এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতার পথে ধীরযাত্রা

এই নির্বাচনের ফলাফল কী হলো, তার জন্য ইউক্রেন সরকার ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, তা থেকে সরে আসবে না। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার সময় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইউক্রেনের ভূখণ্ডের যতটা অংশ রাশিয়া অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে, তার পুরোটাই পুনরুদ্ধার করতে চায় তারা। কিন্তু এই লক্ষ্য খুব শিগগিরই অর্জন হওয়ার নয়।

খুব আশাবাদী পূর্বানুমান বলছে, আজভ সাগর পর্যন্ত পৌঁছানোর যে লক্ষ্য নিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী এগোচ্ছে, সেটা অর্জন করতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে। রাশিয়ার মূল ভূমি থেকে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ইউক্রেনীয় বাহিনীর মূল কৌশল নীতি এটা।

আরও পড়ুন

ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে স্বাধীন করতে হলে এবং দনবাস অঞ্চলকে রাশিয়ার মুঠো থেকে আলগা করতে হলে এই শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। অবৈধভাবে দখলে নেওয়া চারটি ভূখণ্ডে শক্ত ও কার্যকর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে রাশিয়া। অন্যদিকে ইউক্রেনের কাছে সামরিক শক্তি অপর্যাপ্ত। এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে এই দুটি লক্ষ্য অর্জন করা খুব সহজ নয়। আর খুব দ্রুত সেটা অর্জিত হওয়ারও নয়।

একই সঙ্গে রাশিয়া অধিকৃত ভূখণ্ডে যাঁরা এখনো বাস করছেন, তাঁদের প্রতি কঠোর একটি অবস্থান নিয়েছে ইউক্রেন। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেসচুক সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ার অধিকৃত চারটি অঞ্চলে সামাজিক খাতে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা তাঁরা যাচাই-বাছাই করবেন। এর মানে হচ্ছে, ওই অঞ্চলে অবসর ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

২০১৪ সালে তথাকথিত স্বঘোষিত পিপলস রিপাবলিক অব দোনেৎস্ক ও লুহানেস্ক ঘোষণার পর একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন সরকার এখন যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটা যৌক্তিক।

সুতরাং, ভিন্ন ভিন্ন পথে মস্কো ও কিয়েভ যার যার মতো করে যুদ্ধের বাস্তবতার মীমাংসা করছে। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে।

  • স্টেফান উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক

  • জেন মনেপ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ওদেসা ল একাডেমির ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক