ইউরোপের ক্রিসমাসের একটা গন্ধ আছে

ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় ক্রিসমাস ইভে শিশু যিশুর মূর্তি।ছবি: এএফপি

অন্য বছরের তুলনায় এবার ডিসেম্বরে শীত একটু কম। শুধু লন্ডন নয়, ইউরোপের প্রায় সবখানেই। ডিসেম্বরের এ সময়ে গোটা ইউরোপ অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। চারদিকে উৎসবের আমেজ। বড়দিন, তারপরেই খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণ।

বাড়ির সামনে, রাস্তায়, দোকানে আলোর উৎসব। অফিস, বাড়ি, বিপণিবিতান—সবখানে সাজানো বিভিন্ন জাতের পাইন গোত্রের গাছ, যা কিনা সবার কাছে ক্রিসমাস ট্রি নামেই পরিচিত।

১৫ ডিসেম্বরের পর থেকে অনেকে বছরের জমানো ছুটি নিতে শুরু করেন বড়দিন উপলক্ষে। বাড়িতে, অফিসে নানা আয়োজন।

আরও পড়ুন

ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরেই তৈরি হয় অস্থায়ী ক্রিসমাস মার্কেট। ছোট–বড় সব ধরনের দোকানি পসরা সাজিয়ে বসেন। ক্রিসমাস মার্কেটের এই চল আসলে জার্মানি থেকে আসা। কোলন, বার্লিন আর মিউনিখ হয়ে ইউরোপের প্রায় সব শহরেই এখন ক্রিসমাস মার্কেট দেখা যায়।

ধর্মীয় উৎসবের গণ্ডি পেরিয়ে বড়দিন এখন ইউরোপে প্রধান সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কাজ করতে করতে ক্লান্ত, অবিরাম ছুটে চলা মানুষ বছরের এ সময়ে একটু জিরিয়ে নেন। পরিবার, বন্ধুত্ব আর সম্পর্কের উদ্‌যাপনে ব্যস্ত থাকেন।

অনেকেই ধারণা করেন, পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা পরিবারকেন্দ্রিক নয়। এ ধারণা আসলে সত্য নয়। পরিবার এখানে সবকিছুর মূলে। দেশভেদে এ মূল্যবোধ আর আচারটা আলাদা।

আরও পড়ুন

অপরিচিত, অচেনা আর স্বতন্ত্র মূল্যবোধকে সম্মান জানানো, নিজেদের থেকে হীন মনে না করা সভ্যতা ও সহিষ্ণুতা প্রকাশের এক বড় মাপকাঠি। অনেকেই মনে করেন, পাশ্চাত্যে সন্তানেরা বড় হয়ে গেলে মা–বাবার যত্ন নেন না, বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যান অনেক কারণে। একটি পরিবার চালাতে গেলে যে পরিপক্বতার দরকার হয়, মা–বাবার সঙ্গে থাকলে সেই পরিপক্বতা আসতে সময় লাগে। কিন্তু একা থাকলে এই পরিপক্বতা ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ধাতস্থ করা সহজ হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিস্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা তো রয়েছেই।

এসব দেশে কেউ কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চায় না; সে সন্তানই হোক, আর মা–বাবা। সে কারণেই মা–বাবারা ‘কেয়ার হোম’ যাকে কিনা আমরা ‘বৃদ্ধাশ্রম’ বলি, সেখানে থাকতেই পছন্দ করেন।

এখানে টাকা দিলে যত্নের কোনো ত্রুটি হয় না। কারও দয়া বা দাক্ষিণ্যের দরকার হয় না স্বাধীন জীবন যাপনের জন্য।

বড়দিন নিয়ে কথা হচ্ছিল। এ সময় হলো ইউরোপের সবচেয়ে লম্বা ছুটির মৌসুম।
বড়দিনের সব আয়োজন পরিবার আর বন্ধুকেন্দ্রিক। বড়দিন উপলক্ষে পরিবারের সব সদস্য একত্র হয়। যোগ দেয় বন্ধুরাও।

আমার মতো অনেকেই সময়টা কাজে লাগায় সারা বছর জমে থাকা না–দেখা সিনেমা দেখে, না–পড়া বই পড়ে, আর নতুন গান শুনে। অনেকে আবার ঘুরতে বেরিয়ে যায় অজানা দেশ দেখতে।

চলতে থাকে প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া আর তার সঙ্গে অন্যকে উপহার দেওয়া। অন্যকে উপহার দেওয়ার এই চল স্কুল থেকেই শিশুদের শেখানো হয়। লন্ডনে আমাদের পাড়ার সব থেকে মুখপোড়া প্রতিবেশীও একগাল হাসি নিয়ে আমাদের বাড়িতে বড়দিন আর নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে এক বাক্স চকলেট আর কার্ড নিয়ে হাজির হয় প্রতিবছর।

বড়দিনের প্রাক্কালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা লেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সান্তা ক্লজের টুপি পরে শীতল স্নানে মেতে উঠেছিলেন বহু মানুষ।
ছবি: এএফপি

দোকানগুলো সেজে ওঠে দারুণভাবে। ক্রিসমাসের রং হলো লাল, সঙ্গে সবুজ আর আর রুপালি রঙের খেলা। চলে কম আওয়াজে নানা ধরনের গান। ক্রিসমাসের একটা গন্ধ আছে। দারুচিনি, লবঙ্গ আর কমলালেবুর খোসার এক মিষ্টি গন্ধ।

বিভিন্ন খাবার থেকে দোকানে ঢুকলেই নাকে এসে লাগে। পাগল করা সে গন্ধ। উৎসবের আমেজ দিতেই এগুলো করা হয় বাণিজ্যিক কারণে। আমাদের সব কটি ইন্দ্রিয়ের দুর্বলতাকে বিপণন–বিশেষজ্ঞরা দারুণভাবে কাজে লাগান ছুটির এ সময়ে। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বিপণন একাকার হয়ে যায়। রং, গন্ধ আর সুরের মূর্ছনা—সবকিছুই আমাদের ওই দোকানে বেশি সময় থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।

বেশি সময় থাকা মানেই বেশি কেনাকাটা। উৎসবের এ সময়ে শুধু বিলেতে প্রায় ৮৫ বিলিয়ন পাউন্ডের কেনাকাটা হবে। গত বছরের তুলনায় যা কিনা তিন বিলিয়ন পাউন্ড বেশি। এরপর রয়েছে জার্মানি, তারা খরচ করে প্রায় ৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড।
ফ্রেঞ্চ আর ইতালীয়রা খরচ করে যথাক্রমে ৬২ বিলিয়ন ও ৩৭ বিলিয়ন পাউন্ড শুধু ডিসেম্বরেই।

উৎসব ঘিরে মানুষের আবেগকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর কোনো প্রবণতা ইউরোপ বা আমেরিকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে নেই। নেই কোনো অজুহাতও। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের সবখানেই উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বেড়েছে পণ্য পরিবহনের খরচ।

সরকারি হিসাবমতে, বিলেতের অর্ধেক পরিবার দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বলছে, এ বছর গড়পড়তার একটি পরিবার ব্রিটেনে মাসে ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড খরচ করে, ক্রিসমাস উপলক্ষে খরচ অন্তত ৭৪০ পাউন্ড বেশি হবে।

সব থেকে অবাক ব্যাপার হলো, সবচেয়ে বড় উৎসবের এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম কমে যায়। অর্ধেক বা তারও কম। দুই কেজি আলুর দাম বাংলাদেশি টাকায় ১৪০ টাকা, যা গতকাল ২১ টাকায় কিনেছি। ৮৪ টাকার এক কিলো গাজর কমে হয়েছে ২৭ টাকা। মাছ, মাংস আর পানি এর দামও কমে অর্ধেক হয়ে গেছে।

এক বা দুই দিনের জন্য নয়। কম দাম চলবে কয়েক সপ্তাহ ধরে। জামাকাপড় থেকে শুরু করে টিভি ফ্রিজ বা সবে ছাপা হওয়া বই। সবকিছুতেই উৎসবের এ মৌসুমে দাম কমে যায়। অনেকেই সারা বছরের প্রয়োজনীয় অনেক বড় বাজার এ সময়ে করে থাকেন।

উৎসব ঘিরে মানুষের আবেগকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর কোনো প্রবণতা ইউরোপ বা আমেরিকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে নেই। নেই কোনো অজুহাতও। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের সবখানেই উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বেড়েছে পণ্য পরিবহনের খরচ।

ব্রিটিশ ভূখণ্ডে অধিকাংশ খাদ্য বিভিন্ন দেশ থেকে আসে যেমন চাল আসে ভারত থেকে, ডাল আসে ইউক্রেন আর অধিকাংশ ফল আসে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে।

এ মৌসুমে ইউরোপ আর আমেরিকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা উৎপাদন থেকে বেশি থাকবে—এ যুক্তি দেখানো যেতেই পারে। দাম না বাড়িয়ে উৎসবের এ মৌসুমে সবকিছুর দাম কমানো হয়।

এর জন্য সরকারকে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয় না, ভোক্তাদের কোনো আন্দোলন করতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে উৎসবের আগে, বিশেষ করে রমজানের আগে অকারণে, অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়।

অথচ এই আমরাই সকাল-সন্ধ্যা অন্যকে নৈতিকতার সবক দিয়ে থাকি। ছোটখাটো লোভ আমরা সংবরণ করতে পারি না, অথচ নৈতিকতার মানদণ্ডে হরহামেশা নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করি। সবাই ভালো থাকবেন। শুভ বড়দিন।

  • ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
    [email protected]