জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে হাল আমলে নতুন করে পুরোনো এক তত্ত্ব বাজারে হাজির হয়েছে। এটা হলো ‘মেটিকুলাস ডিজাইন তত্ত্ব’। সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম দাবি করেছেন, আংশিক হলেও একটা অভ্যুত্থান নিগূঢ় পরিকল্পনা অনুসারে ঘটেছে।
মাহফুজ আলমের এই মন্তব্যের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত হতে পারিনি। তবে ছাত্রেরা যে দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা করেই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, সেটা আমি এই লেখার অবয়বে তুলে ধরব।
২.
সামাজিক বিজ্ঞানে ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা’ নিয়ে একধরনের তত্ত্ব চালু আছে। এই তত্ত্ব অনুসারে, সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিষয়াদি আগে থেকে পরিকল্পনা করে আসলে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায় না।
এ বিষয়ে ফ্রেডেরিক হায়েককে স্মরণ করতে হয়। তিনি বলেছিলেন অর্থশাস্ত্রের কৌতূহল জাগানো কাজ হলো মানুষকে দেখানো যে যেটাকে তাঁরা পরিকল্পনা করবেন বলে মনে করেন, সেটা তাঁদের কতটা অজানা।
হায়েকের ‘রাত পাহারার সরকারের ধারণা’র সঙ্গে তীব্র দ্বিমত থাকলেও আমি তাঁর পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা তত্ত্বের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত।
কোনো আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের পূর্বপরিকল্পনা থাকতেই পারে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবতা এতই বিচিত্র থাকে যে সেই পরিকল্পনা নানা সময় ভেস্তেও যেতে পারে।
একটা আন্দোলনে কোন মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা আগেভাগে নির্ধারিত বা ঠিক করা থাকে না। আন্দোলনে সরকার ও আন্দোলনকারী পক্ষ একটা ‘গেম থিওরি’ সদৃশ অবস্থানে উপনীত হয়, যেখানে একজনের সিদ্ধান্তের ওপর অপরের সিদ্ধান্ত অনকটাই নির্ভর করে।
ছাত্র নেতৃত্বের কৃতিত্ব এখানেই যে তাঁরা গেম থিওরির বিশেষজ্ঞের মতো সরকারকে বুদ্ধির খেলায় ‘কুপোকাত’ করতে পেরেছেন। সেসব কুপোকাতের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
ডিবি হারুন (ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ) আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের তুলে নিয়ে তাঁদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছিলেন। এটা ছিল একটি ‘নাটক’।
এর প্রত্যুত্তরে বাইরে থাকা ছাত্র নেতৃত্ব আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা আন্দোলন অব্যাহত রাখতে এবং আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে।
একই রকম ‘নাটক’ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও করা হয়েছিল। তখনও একদল ছাত্রকে আন্দোলনের নেতা বানিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু জুলাইয়ে তফাত ছিল এই যে এবার আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল মোক্ষম এক অস্ত্র—সংগঠন।
সংগঠন থাকার কারণেই এক সারির নেতাদের দিয়ে জোর করে আন্দোলন বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ালেও, পরের সারির নেতারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাতে পেরেছিলেন। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলো এই সাংগঠনিক কাঠামো।
৩.
এই সংগঠন এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চর্চা।
এই চর্চার মূল সূতিকাগার ছিল ২০১৮ সালের কোটা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। বিশেষত, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে ছাত্ররা বুঝতে পারেন যে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প ও রাজনৈতিক চর্চা ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে নানা আলাপ–আলোচনা ও স্বশিক্ষার সংগঠন গড়ে ওঠে, যেগুলো ছিল গভীরভাবে রাজনৈতিক। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বচিন্তন’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুরুবার আড্ডার’ কথা উল্লেখ করা যায়।
এ ছাড়া নানা আলোচনা সভা, বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মাধ্যমে আন্দোলনকারী ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে এক রকম মৈত্রী গড়ে ওঠে। সেখান থেকে আর কোটা আন্দোলনের গর্ভে জন্ম নেওয়া গণ অধিকার পরিষদের নানা সীমাবদ্ধতার কারণেই নতুন ছাত্রসংগঠন হিসেবে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি গড়ে ওঠে।
জুলাই অভ্যুত্থানের অনেক অগ্রসৈনিকই এই সংগঠন (গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি) থেকেই গড়ে ওঠেন। আন্দোলনের স্বার্থে তাঁরা আবার গড়ে তোলেন আরেকটি প্ল্যাটফর্ম, যার নাম দেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এই পদক্ষেপও আন্দোলনের একাডেমিক ধারণার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। ম্যানসার ওলসনের তত্ত্ব একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে তিনি ছোট ছোট সংগঠনের একত্র হয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গড়ে তোলাকেই শ্রেষ্ঠতম কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেমন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি শক্ত অবস্থানে ছিল, তেমনি ছিলেন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ডান-বাম ছাত্ররাজনীতি করা অনেক ছেলে–মেয়ে। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যে এই সংগঠন নিজেদের রাজনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
এই চিহ্নায়ণের বিশেষত্ব হলো যে তাঁরা নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ হিসেবে প্রকাশ করেননি। এই বর্গের নিজস্ব একটা রাজনীতি সব সময়ই ছিল।
এ রাজনৈতিক প্রকল্পের কেন্দ্রে ছিল সবাই মিলে এক জোট হয়ে হাসিনা সরকারের উচ্ছেদ করা; যদি কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে তা না করা যেত, তবে সেটা হতো অন্য কোনো ইস্যুতে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে তাই কেন্দ্রবিন্দু না বলে, বরং হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের প্রবেশপথ বললেই হয়তো বেশি যথার্থ হবে। দীর্ঘ সময় ধরে এমনই এক প্রবেশপথের জন্য ছাত্ররা অপেক্ষা করছিলেন ও প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
এসব কর্মী নিজেদের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন ২০২৬ সালকে কেন্দ্র করে। কিন্তু পরিস্থিত এর আগেই তাঁদের এনে দেয় মোক্ষম সুযোগ, যেটা তাঁরা গ্রহণ করতেও ভুল করেননি।
তবে তাঁরা (আন্দোলনকারীরা) পুরোটা সময় নিজেদের রাজনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র হিসেবে পরিচিত করান। এর কারণ হলো, সরকার যেন তাঁদের আন্দোলনকে বিএনপি বা জামায়াতের আন্দোলন বলে নামাঙ্কিত করতে না পারে এবং সেই সুযোগে তাঁদের নির্বিচার দমন করতে না পারে।
একই সঙ্গে তাঁদের পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্পও তাঁরা অনেকটা অপ্রকাশ্য রেখেই কোটার ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই কৌশলগত সিদ্ধান্তকে আমি বলছি, ‘কৌশলী অরাজনৈতিকতা’।
আন্দোলনের পর অনেক নেতাই তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় বা প্রকল্প প্রকাশ্য এনেছেন, আন্দোলনে কার কতটা অবদান, তা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়েছেন। তবে আন্দোলনের সময় আন্দোলনের স্বার্থেই তাঁরা নীরবতা বজায় রেখেছিলেন।
৪.
গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাইরে থেকে নিজেদের অরাজনৈতিক দেখানোর চেষ্টা করলেও, আদতে এই আন্দোলন ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। তাঁদের একটি রাজনৈতিক প্রকল্প বরাবরই ছিল আর সেটাই অপরাপর বৃহৎ ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এর পার্থক্য তৈরি করেছে।
এই রাজনৈতিক প্রকল্পের বর্তমান বাস্তবায়িত রূপ হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে কেবল ভোটের রাজনীতি নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ ‘বিপ্লব’ ঘটানোর জন্যই এ আন্দোলনকারীরা ছিলেন চিরপ্রস্তুত।
তাঁদের মধ্যে ছিল বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষা, বৈপ্লবিক ঐকমত্য ও তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন একটি বৈপ্লবিক জোট। একটি বৈপ্লবিক মুহূর্তও তাঁদের হাতে ধরা দিয়েছিল, যেটিকে তাঁরা বৈপ্লবিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারতেন।
নানা চাপের কারণে তাঁরা বৈপ্লবিক সমাধানের বদলে ‘মধ্যপন্থা’ বেছে নিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছন যে মধ্যপন্থা মানে কেবল মাঝামাঝি অবস্থান করা নয়, অনেক সময় মিডিওক্রিটি বা মধ্যম মান বেছে নেওয়া।
৫.
জুলাইয়ের আন্দোলনের একটা অন্যতম মূল চালিকা শক্তি ছিলেন এমন মানুষেরা, যাঁরা প্রকৃতপক্ষেই অরাজনৈতিক। এঁদের অনেকে কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকেই সমর্থন করেননি, তবে আওয়ামী লীগের শাসনে তাঁরা ত্যক্ত–বিরক্ত ছিলেন।
অনেকে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলেও বিপুলসংখ্যক হতাহতের ঘটনা দেখে তাঁদের অবস্থানও বদলে গিয়েছিল। এই মানুষদের ভোট এনসিপি টানতে পারবে কি না, সেটা এখন একটা দেখার বিষয়।
এই মুহূর্তে যাঁরা এনসিপিতে আছেন, তাঁদের অনেকে জুলাইয়ের ছাত্র নেতৃত্ব হলেও, আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশের অংশগ্রহণ এখানে অনুপস্থিত। আন্দোলনের শেষে একটা বড় অংশ ঘরে ফিরে গেছে। সেই ছাত্র–জনতা কোনো দলে যুক্ত হতে বা ক্ষমতার ভাগীদার হতেও আগ্রহী নন।
এই মানুষগুলোকে আমি আমার ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে অভিহিত করেছিলাম বাংলাদেশি রাজনীতির ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে। এখন এই তৃতীয় শক্তির ভোট কারা সবচেয়ে সফলভাবে টানতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে দুঃখের বিষয় এই যে আমার ধারণা, নানা কারণে এনসিপি এই ভোটের একটা বড় অংশকেই এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে।
জুলাইয়ের যে সাংগঠনিক কাঠামো, যে ‘যুক্তফ্রন্ট’ ছিল, সেটাকে ভেঙে এখন কেন্দ্রীভূত রাজনীতি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মিত্র, যেমন বামপন্থীদের দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি ধীরে ধীরে প্রকাশ হচ্ছে। এতে সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হচ্ছে।
এনসিপির পদযাত্রায়, পথসভায় যতই ‘মানুষের ঢল’ দেখা যাক, সাংগঠনিক ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে না পারলে এই দল দাঁড়াবে না। এনসিপির উচিত জুলাইয়ের স্মরণে হলেও তাঁদের আশপাশের অপরাপর গোষ্ঠী, দল, সংগঠনকে নিয়ে একটা বড় মৈত্রী গড়ে তোলা, যাতে সংগঠন শক্তিশালী হয়।
জুলাই থেকে এই শিক্ষা নিতে না পারলে রাজনৈতিকভাবে এনসিপি হোঁচট খেতে পারে। জুলাইয়ের কান্ডারি হতে চাইলে এনসিপিকে জুলাই থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।
অনুপম দেবাশীষ রায় ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ডিফিল (পিএইচডি) গবেষক।
ই–মেইল: [email protected]*মতামত লেখকের নিজস্ব