জনসভা বিএনপির, পাহারায় আওয়ামী লীগ

বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিনই সমাবেশস্থল ভরে গেছে দলীয় নেতা–কর্মীদের পদচারণে।
ছবি: প্রথম আলো

ধারণা করা হয়েছিল, খ্রিষ্টীয় নতুন বছর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি। সে দিক থেকে পাক্কা এক বছর প্রচারের সুযোগ পাবে তারা। কিন্তু তার আগেই ২৪ নভেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলো যশোরে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভার মধ্য দিয়ে। কোভিডের পর ঢাকার বাইরে এটাই তাঁর প্রথম জনসভা।

এ জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ছিল ‘আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে আমাদেরকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই, আগামী নির্বাচনেও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন।’ বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, তারা ক্ষমতায় এসে হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ছাড়া কিছু দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতারা একে যশোরে স্মরণকালের বৃহত্তর জনসভা বলে অভিহিত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী যখন যশোরের জনসভায় ভোট চাইছিলেন, সে সময় বিএনপি কুমিল্লায় বিভাগীয় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আজ কুমিল্লায় বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে দুই দিন আগ থেকে দলের নেতা-কর্মীরা নির্ধারিত স্থানে সমবেত হয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১০ শর্তে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। এর আগে সিলেট, খুলনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, চট্টগ্রামেও তাদের সমাবেশ হয়েছে নানা শর্ত ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে। একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করলেও কোনো শর্তের কথা শোনা যায়নি।

দুই দিন আগে নতুন দুটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার—পদ্মা ও মেঘনা। ফরিদপুরে হবে পদ্মার সদর দপ্তর আর কুমিল্লায় মেঘনার। সরকারের এই সিদ্ধান্তে কুমিল্লা ও ফরিদপুরের মানুষ খুশি হয়নি।

নাগরিক সমাজ থেকে প্রতিবাদ এসেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বরকতউল্লা বলেন, ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রস্তাবিত মেঘনা বিভাগের নাম পরিবর্তন করে তা কুমিল্লা বিভাগ ঘোষণা করা হবে। এর আগে কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লার নামে বিভাগ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেনদরবারও করেছিলেন। কুমিল্লা ও ফরিদপুরবাসীর প্রশ্ন—নদীর নামে বিভাগ হলো মাত্র দুটি কেন? সব বিভাগের নাম নদীর নামে হোক।

সাম্প্রতিক কালে রাজনীতিতে নানা অঘটনের মধ্যে স্বস্তির খবর হলো, কুমিল্লায় বিএনপির সমাবেশকে সামনে রেখে জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ধর্মঘট না ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপির নেতারা পরিবহন সমিতির এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এর আগের সমাবেশগুলোতে প্রতিটি এলাকায় ঘোষিত ও অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট পালিত হয়েছে। এতে সমাবেশগামী মানুষই দুর্ভোগে পড়েননি, সাধারণ মানুষকেও অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে। কোনো দলের সভাসমাবেশ নিয়ে এ ধরনের ধর্মঘট বা অঘটন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এক দিনে এতসংখ্যক ডিসি রদবদলের ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেনি। এটা যে নির্বাচনের প্রাক্‌–প্রস্তুতি, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাই বলা যায়, কেবল মাঠে নয়, প্রশাসনেও নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপি আহূত জনসভার স্থান নিয়ে যে ধোঁয়াশা ছিল, তা–ও অনেকটা কেটে যাবে আশা করা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি দেওয়া হবে। এর আগে বিএনপি ডিএমপি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে জনসভার অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। ২০১৫ সালের পর বিএনপি বহুবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার অনুমতি চাইলেও পায়নি। এবার যখন সেই অনুমতি পাওয়া গেছে, বিএনপির উচিত হবে সেই সুযোগ নেওয়া। 

১০ ডিসেম্বরের জনসভাকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের অতি উৎসাহী নেতারা উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। বিএনপির এক নেতা বলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়।

এর জবাবে আওয়ামী লীগের নেতারা কোরাস গাইতে থাকলেন, ডিসেম্বরে বিএনপিকে রাজপথে নামতে দেওয়া হবে না। গত বুধবার সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়ে দিলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাহারায় থাকবেন। গণসমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের সতর্ক পাহারা বসানোর অর্থ হলো, বিএনপিকে নির্বিঘ্নে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেওয়া। সে ক্ষেত্রে সংঘাত, মারামারি অনিবার্য হবে।

বিএনপির জনসভার দিনে আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি দেবে, এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। আওয়ামী লীগের পাহারা–কর্মসূচি দেখে মনে হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তার প্রতি তাদের কোনো আস্থা নেই। তাই শান্তি রক্ষার দায়িত্বটি তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে থেকে নিজেদের হাতে নিতে চাইছে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের প্রধান সমস্যা হলো সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের একাকার হয়ে যাওয়া। প্রশাসন ও দলকে ভাগ করতে না পারলে কখনোই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র সম্ভব নয়, এই সরল সত্যটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন বুঝতে চাইছেন না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তাদের নেতা-কর্মীরাও বুঝতে চাইতেন না। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পার্থক্য কি কেবল স্লোগানে, পোশাকে?

যশোরে প্রধানমন্ত্রী জনসভা করে জনগণের কাছে ভোট চেয়েছেন, এটাই নির্বাচন প্রস্তুতির একমাত্র ইঙ্গিত নয়। জনপ্রশাসনেও নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহে পুলিশ সুপারসহ পুলিশ বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁদের যোগ্যতার ঘাটতি আছে। তাঁরা এতটা অযোগ্য হলে এত দিন চাকরি করলেন কীভাবে? ২৩ নভেম্বর রাতে একযোগে ২৩ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে চট্টগ্রামের ডিসি মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে ঢাকায়, কিশোরগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ শামীম আলমকে কুমিল্লায়, জয়পুরহাটের ডিসি মো. শরিফুল ইসলামকে পটুয়াখালীতে, বরিশালের ডিসি জসীম উদ্দীন হায়দারকে টাঙ্গাইলে, সুনামগঞ্জের ডিসি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে বরিশালে এবং নীলফামারীর ডিসি খন্দকার ইয়াসির আরেফীনকে খুলনার ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীকে সুনামগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব কাজী মাহবুবুল আলমকে গোপালগঞ্জ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে চট্টগ্রাম, অর্থ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সাইদুল আরিফকে কুড়িগ্রাম, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক ড. চিত্রলেখা নাজনীনকে রংপুরের ডিসি করা হয়েছে।

এর আগে ২৭ অক্টোবর একজন জ্যেষ্ঠ সচিব ও দুজন সচিবকে বদলি করে সরকার। এ ছাড়া একজন সচিবকে জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়েছে। অন্যদিকে তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানাকে তথ্যসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচারসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শিল্পসচিব হিসেবে বদলির আদেশ হওয়া হুমায়ুন কবীর খন্দকারকে।

এর আগে তিনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব ছিলেন। জননিরাপত্তা বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব জাহাঙ্গীর আলম নিয়োগ পেয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব পদে।

এক দিনে এতসংখ্যক ডিসি রদবদলের ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেনি। এটা যে নির্বাচনের প্রাক্‌–প্রস্তুতি, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাই বলা যায়, কেবল মাঠে নয়, প্রশাসনেও নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]