নীরবতার রাজনীতি এবং বাংলাদেশের বিপন্ন ভবিষ্যৎ

সন্ত্রাসী হামলার শিকার প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাছবি : প্রথম আলো

‘প্রথমে ওরা কমিউনিস্টদের ধরতে এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি; কারণ আমি কমিউনিস্ট নই। এরপর ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই। ওরা আবার ফিরে এল ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, তখনো চুপ করে ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই। এরপর ওরা এল ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই। শেষবার ওরা ফিরে এল আমাকে ধরে নিয়ে যেতে, আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না। কারণ, কথা বলার মতো কেউ আর বেঁচে ছিল না।’

লাইনগুলো জার্মান ধর্মযাজক এমিল মার্টিনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁর এই স্বীকারোক্তিমূলক গদ্যটি কাব্যের আবরণে মোড়া এক করুণ আর্তনাদ। নাৎসিরা যখন ক্ষমতার শিখরে আরোহণ করল, তখন জার্মানির বুদ্ধিজীবী ও ধর্মযাজকদের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে নীরব হয়ে গেল। সেই নীরবতা অজ্ঞতার ফল ছিল না। ছিল সচেতন ও সুবিধাজনক অন্ধত্ব। সেই অন্ধত্বের বলি হতে হয়েছে সারা বিশ্বের কোটি কোটি নিরীহ মানুষকে। বাংলাদেশও যেন ক্রমেই এমন এক নীরবতায় তলিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিটি বড় রাষ্ট্রের সঙ্গেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বহুমুখী বিবাদ থাকে। ইতিহাসে সব সময়ই তেমন ছিল। সেই বিবাদ নিয়েই রাষ্ট্রগুলো বিরাজ করে প্রতিবেশী-প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে যায় তখনই, যখন বড় রাষ্ট্র প্রতিবেশী জনগণের সার্বভৌমত্বে নানা কায়দায় হস্তক্ষেপ করে। এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্ত জনতার ফুঁসে ওঠা অনিবার্য। যেই অনিবার্যতাই তৈরি করে অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট।

কিউবায় প্রতিবেশী আমেরিকার বসানো পাপেট বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, কিংবা বাংলাদেশে ভারতের স্নেহভাজন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানও এরই দৃষ্টান্ত। অবশ্য ২৪-এর অভ্যুত্থান সরাসরি ভারতবিরোধী অভ্যুত্থান ছিল না, অভ্যুত্থান ছিল আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধেই। তবে একদিকে দেশটির সঙ্গে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তি,অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন লুটপাট, গুম, খুন ও ভোট কারচুপির পরও শক্তিশালী প্রতিবেশি হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বৈধতা প্রদান জনমনে তৈরি করেছিল তীব্র ভারতবিরোধী অবস্থান। অভ্যুত্থানেও যার ছায়া পড়েছে।

এখন যারা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না, তারা আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অবশিষ্ট থাকবে না কেউ। প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসস্তূপের সামনে তখন প্রতিধ্বনিত হবে এমিল মার্টিনের শোকগাথার পুনরাবৃত্তি— প্রথমে ওরা সাংবাদিকদের ধরতে এসেছিল, আমি প্রতিরোধ করিনি, কারণ...।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিরোধ করতে অভ্যুত্থানের একটা সাধারণ লক্ষ্য থাকে, প্রাথমিকভাবে সেই লক্ষ্য হয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চেয়েও যতভাবে সম্ভব উন্নত হওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক ও ঐতিহ্যগতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। কিন্তু হৃদয়ে রক্ত ঝরানো বাস্তবতা এই যে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর আমাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্রে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

ক্ষমতায় থাকাকালে বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় সব স্তরের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে দলীয় দখলদারি কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ। অভ্যুত্থানে তাদের পতনের পর প্রতিষ্ঠানগুলো দখলমুক্ত করা জরুরি ছিল। কিন্তু তেমন হয়নি। দখলমুক্ত হওয়ার বদলে প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদ পুনর্দখল হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাভাজনদের দ্বারা। এ কথা আমাদের নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টা থেকে শুরু করে একাধিক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি বহুবার এই আফসোস পুনরাবৃত্তি করেছেন। ফলে অভ্যুত্থানের ধাক্কায় প্রতিষ্ঠানগুলোর যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ছিল, তা আর হয়নি।

আরও পড়ুন

আর যে প্রতিষ্ঠানগুলো আওয়ামী লীগ দখলের বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান সময়ে হচ্ছে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর মতো গণমাধ্যমে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ সেই ধ্বংসযজ্ঞের সবচেয়ে নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলা, হয়রানি, সংবাদে হস্তক্ষেপের চেষ্টা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদ থেকে বর্জনের খড়্গও নেমে এসেছিল এই প্রতিষ্ঠান দুটির ওপর। তবে সাহসের সঙ্গে সত্য প্রকাশের ধারায় অবিচল এই গণমাধ্যম দুটি সেই প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়েছিল পাঠকের আস্থার ওপর নির্ভর করে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনেরা চেষ্টা করেছিল পত্রিকার মালিকানা ও সম্পাদক বদলে ফেলতে। গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সে সুযোগ তারা আর পায়নি। নিজেরাই পালিয়ে গেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বহু পত্রিকায় বদলে গেছে সম্পাদক, বদলে গেছে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি ও বয়ান। প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে অবিচল ছিল এই দুটি গণমাধ্যম। ক্ষোভটা তাই অনুমেয়। কিন্তু সামনের নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসার সবচেয়ে নিকটে আছে, আশ্চর্যজনকভাবে এটা তাদের ক্ষোভ নয়। খেয়াল করলেই স্পষ্ট হয়, এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে দেশের স্থিতিশীলতা ও নির্বাচনবিরোধী শক্তি। নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সফল করতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে শেষ পর্যন্ত হামলাকারী গোষ্ঠী পৃথিবীকে কী বার্তা দিল?

সারা পৃথিবী দেখল, বাংলাদেশে হাতে গোনা যেই দু–একটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে।

ভারতে রয়েছে হাজারো প্রতিষ্ঠান, সেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবেশী দেশসহ সারা বিশ্বেই নানা কায়দায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার পদ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক দক্ষ শ্রমশক্তির বড় অংশ ভারতের দখলে। ভারতের বৈশ্বিক প্রভাব এ দেশের মাটি থেকে যারা উৎখাতের প্রয়োজন বোধ করে, তাদের তো সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতায়িত করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম উল্টো দৃশ্য। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই পড়তে হলো হামলার মুখে, যা শেষ পর্যন্ত ভারতবিরোধিতার মোড়কে উপকার করল ভারতীয় প্রভাবেরই।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর ওপর হামলার পর বড় পরিসরে কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ এখনো দেখা যায়নি। তবে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের নানা অংশ নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জারি রেখেছেন। নিঃসন্দেহে তাঁদের এই প্রয়াস প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের মনোবল বাড়াতে সহায়ক। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, প্রতিষ্ঠান দুটির ওপর হামলা হয়েছে একেবারে প্রতিরোধহীনভাবে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী সময়মতো এগিয়ে আসেনি, রাজনৈতিক দলগুলো হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি, আশপাশে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসেননি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসেনি, অগ্নিসংযোগের পর ফায়ার সার্ভিসও সময়মতো আসেনি, এমনকি হামলার শুরুতে ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা শত শত সাংবাদিকও প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি।

দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় রচনার আগুন জ্বালানো হয়েছে একেবারে প্রতিরোধহীনভাবে।

এই এগিয়ে না আসার জন্য প্রত্যেকেরই হয়তো নিজস্ব কারণ, শঙ্কা, ভয় বা বাস্তবতা রয়েছে। কিন্তু এই সব বাস্তবতা একত্র হয়েই তৈরি করে চূড়ান্ত অস্থিতিশীল সময়, চূড়ান্ত ভয়ের সংস্কৃতি। নিজেদের মনঃপূত সংবাদ না পরিবেশন করায় যারা এ দুটি গণমাধ্যমের কলম চেপে ধরতে চাইছে, তারা অচিরেই অন্য গণমাধ্যমের দিকে ধেয়ে আসবে, এরপর একে একে ধেয়ে আসবে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের দিকেও।

এখন যারা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না, তারা আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অবশিষ্ট থাকবে না কেউ। প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসস্তূপের সামনে তখন প্রতিধ্বনিত হবে এমিল মার্টিনের শোকগাথার পুনরাবৃত্তি— প্রথমে ওরা সাংবাদিকদের ধরতে এসেছিল, আমি প্রতিরোধ করিনি, কারণ...।

  • সৈকত আমীন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

*মতামত লেখকের নিজস্ব