পশ্চিমারা যে কারণে বর্ণবাদের নিন্দা করতে চায় না

দক্ষিণ আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে ইহুদিবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জোসেপ বোরেল (ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসি) সম্প্রতি ইউরোপকে ফুলে-ফলে সুশোভিত ‌‌‘একটি বাগিচা’ এবং বাকি বিশ্বকে ‘জঙ্গল’ হিসেবে বর্ণনা করার পর বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাঁর বক্তব্য যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা বোঝা যাবে কয়েক দিন আগের একটি ঘটনার দিকে তাকালে।

ঘটনাটি গত অক্টোবরের। ওই মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বর্ণবাদ, অভিবাসীবিদ্বেষ এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে একটি খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবটিতে ঔপনিবেশিকতা ও দাসত্বকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। প্রস্তাবটিতে সাবেক ঔপনিবেশিক এবং দাস-ব্যবসায় যুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে অতীতে তারা যে ক্ষতি করেছে, তার আনুপাতিকভাবে ক্ষতিপূরণ দিতেও বলা হয়েছিল।

মোট ৪৭টি দেশের মধ্যে সব মিলিয়ে ৩২টি দেশ (যেগুলোর বেশির ভাগই লাতিন আমেরিকান, আফ্রিকান এবং এশিয়ান) প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়েছে। নয়টি দেশ এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তারা হলো চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, জার্মানি, মন্টেনেগ্রো, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

তাদের এ ‘না’ ভোট মার্কিন এবং ইউরোপীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার একটি অনুস্মারক। এটি উদারপন্থী সরকারগুলোকে তাদের দেশের অতীত কর্মকাণ্ডের ট্র্যাক রেকর্ডের বাহ্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিতে অনিচ্ছুক করে তোলে।

ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ফিলিস্তিনিদের লক্ষ করে তার বর্ণবাদ-সদৃশ নীতিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান না নেওয়া এই দেশগুলোর পক্ষে বর্ণবাদের দ্ব্যর্থহীন সমালোচনা করাকে দুরূহ করে তোলে।

সবচেয়ে আতঙ্কের কথা হলো, বর্ণবাদ এখন উদারপন্থী দেশগুলোর মূলধারার রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। এই বছরের শুরুতে ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী প্রার্থী মারি লো পেন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে লড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি হেরে গেলেও তাঁর এযাবৎকালের সেরা সাফল্য হিসেবে তিনি যত ভোট পেয়েছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে দেশটির রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে।

ইউএনএইচসিআরের কাছে যুক্তরাজ্য তার বিবৃতিতে বলেছে, দাস ব্যবসা এবং ঔপনিবেশিকতা ‘মহা দুর্ভোগ’ সৃষ্টি করলেও সেগুলো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি। যুক্তরাষ্ট্রও রেজল্যুশনের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ন্যায্য বলে দাবি করেছে। এটি বর্ণবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সমতুল্য। এই ইতিহাসকে স্বীকার না করে আমরা আজকের সমাজকে মেরামত করতে পারব না।

২০২১ সালে ফ্রান্সে মুসলিমবিদ্বেষী হামলা ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। এই মাসের শুরুতে কার্লোস মার্টেনস বিলোঙ্গো নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ পার্লামেন্ট সদস্য শরণার্থীদের প্রতি ফরাসি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করার পর লো পেনের দলের একজন এমপি কার্লোসকে ‘আফ্রিকাতে ফিরে যান’ বলে হুমকি দেন।

যুক্তরাজ্যের গোটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলজুড়ে অভিবাসন কমানোকে একটি অগ্রাধিকারমূলক করণীয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় লেবার পার্টি তাদের অনলাইন স্টোর থেকে যে মগ বিক্রি করেছিল, তাতে লেখা ছিল ‘অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ।’ অন্যদিকে ২০২০ সালে রক্ষণশীল সরকার এমন এক গুচ্ছ আইন পাস করেছে, যা অদক্ষ এবং ইংরেজি ভাষার উচ্চ স্তরের দক্ষতা না থাকা অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাজ্যের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

ইতালিতে সম্প্রতি নব্য ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যুক্ত একটি দলকে আমরা ক্ষমতায় আসতে দেখলাম। গবেষণায় দেখা গেছে, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে শ্রমবাজার থেকে আইন বিভাগ; এবং শিক্ষা থেকে আবাসন—সবখানে সবকিছুতে কাঠামোগত বর্ণবাদ ঢোকানো হয়েছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের উত্থান ক্রমবর্ধমান ঘৃণামূলক অপরাধের আকারে অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষকেরা বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ এবং সাধারণভাবে, শ্রেণিকক্ষে পদ্ধতিগত বৈষম্য নিয়ে কী আলোচনা করতে পারেন, তা সীমাবদ্ধ করে বেশ কয়েকটি রাজ্য আইন পাস করেছে।

আরও পড়ুন

এ অবস্থায় ইউরোপীয় দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোকে বর্ণবাদ প্রশ্নে জবাবদিহিমূলক অবস্থানে রাখার বিষয়ে চুপ থাকতে দেখা যাচ্ছে। মূলত এর পেছনে আছে ইহুদিবাদকে সমর্থন করা। বর্ণবাদের পালের গোদা ইসরায়েল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণের মিত্র। এটি মোটেও তুচ্ছ ঘটনা নয় যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই জাতিসংঘের প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ন্যায্যতার সাফাই হিসেবে অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষ–সম্পর্কিত তাদের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছে।

২০০১ সালে ডারবানে বর্ণবাদবিরোধী একটি সম্মেলন পেশ করা প্রস্তাবে ইসরায়েলের ‘নিরাপত্তার অধিকার’-এর স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা ছিল। কিন্তু তারপরও ইহুদি রাষ্ট্রটি এবং তার পশ্চিমা সমর্থকেরা জোর দিয়ে বলেছিল, ওই সম্মেলনটিই নাকি ‌‘ইহুদিবিরোধী’ ছিল।

বিশ্বজুড়ে গভীরভাবে বর্ণবাদের টিকে থাকা বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে তাদের অতীত অপরাধের জন্য অবশ্যই আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু তারা তা না করে উল্টো নিজেদের অপরাধের হিসাব রাখতে অস্বীকার করে চলেছে।

ইউএনএইচসিআরের কাছে যুক্তরাজ্য তার বিবৃতিতে বলেছে, দাস ব্যবসা এবং ঔপনিবেশিকতা ‘মহা দুর্ভোগ’ সৃষ্টি করলেও সেগুলো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি। যুক্তরাষ্ট্রও রেজল্যুশনের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ন্যায্য বলে দাবি করেছে। এটি বর্ণবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সমতুল্য। এই ইতিহাসকে স্বীকার না করে আমরা আজকের সমাজকে মেরামত করতে পারব না।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • সোমদীপ সেন রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক