ডিম যেভাবে মুরগি থেকে অধিক উত্তম

যাত্রাবাড়ীর বড় বাজারে ঢোকার মুখে কয়েক খাঁচা ডিম নিয়ে বেশ ডাঁটের সঙ্গে বসে ছিলেন বিক্রেতা। তাঁর ভাবটা এমন, ‘কেউ নিলে নাও, না নিলে না নাও’, তবে দাম ১৪৫ টাকা প্রতি ডজন। দুজন ক্রেতা কাঁচুমাচু হয়ে দাম কিছুটা কমানোর আকুতি জানাতেই বিক্রেতা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে এমন মুখভঙ্গি করলেন, তাতে মহার্ঘ ওই বস্তু কেনার আর কোনো সুযোগ তাঁরা পেলেন না।

কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম দৃশ্যটি। আমার ডজন দুই ডিম দরকার। ট্যাঁকে যে টাকা আছে, তাতে হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটা ডিমের দাম ১২ টাকা কোন যুক্তিতে? সামনে রমজান আর গরমের মৌসুম। দামের ঘোড়া কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? জাতির বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন রেখে গেলাম।

তবু আজ আর কোনো সিরিয়াস আলাপ নয়। আজ হোক হালকা কথার দিন। উপবৃত্তকার বস্তুটি কিনে টাকার শ্রাদ্ধ যেহেতু হয়েছে, তাই আর আক্ষেপ না করে বরং একটু মউজ-ফুর্তি করা যাক! তবে ডিমের ভেতর মুরগির বাচ্চা ঢুকল কীভাবে? কিংবা ডিম আগে না মুরগি আগে, সে বিতর্কে আজ যাব না। কারণ, বিজ্ঞানীরা আজও এ বিষয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন! কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি।

একটা পুরোনো কৌতুক নতুন করে বলা যাক। একটি মুরগি বাজারে গেছে। কথা বলছে দোকানদারের সঙ্গে।

মুরগি: একটা ডিম দেন তো।
দোকানদার: তোমার লজ্জা করে না?
মুরগি: কেন? লজ্জা করবে কেন?
দোকানদার: মুরগি হয়ে ডিম কিনতে এসেছ?
মুরগি: আমার স্বামী বলেছে, ৮ টাকার ডিমের জন্য নিজের ফিগার নষ্ট করে লাভ নেই। তাই ডিম কিনতে এসেছি।

আরও পড়ুন

২.

আমরা অনেকেই জানি, ডিমের অপর নাম আন্ডা। গ্রামেগঞ্জে এখনো আন্ডা নামেই পরিচিত। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ডিমকে বলা হয় ‘বজা’। প্রেম ভেঙে গেলে কখনো কখনো জোড়া লাগতে পারে। কিন্তু ডিম ভেঙে গেলে তা আর জোড়া দেওয়া যায় না।

ডিম ভাঙলে নিশ্চিতভাবে কুসুম পাওয়া যায়। এই কুসুম লালও হতে পারে, আবার হলুদও হতে পারে। ডিমের কুসুমের রহস্যময় রঙের সঙ্গে মিল খোঁজার চেষ্টা সাধারণত কবি-সাহিত্যিকেরা হামেশা করে থাকেন। যেমন ডিমের কুসুমের মতো মেঘ কিংবা বিকেলের আকাশ যেন ডিমের কুসুম। তবে কুসুম নিয়ে মানুষ যতই আকাশকুসুম কল্পনা করুক না কেন, কুসুম নিয়ে সব রোমান্টিকতা শেষ হয়ে যায়, যদি ডিমটি পচা হয়! তবে ডিম পচা না টাটকা, তা চেনারও উপায় আছে। ডিমটি পানিতে ছেড়ে দিন। যদি ডুবে যায়, তাহলে ডিম ভালো, আর ভেসে উঠলেই বুঝবেন, ইয়ে গলদ হ্যাঁয়।

ডিম ভাজি করেও খাওয়া যায়, সেদ্ধ করেও খাওয়া যায়। ক্যানটিনে বসে আমরা অনেকে হাঁক ছাড়ি, মামা, পেঁয়াজ-মরিচ বেশি করে দিয়েন। কেউ খান ডিমের পোচ, কেউ দোপেয়াজি। কেউ ফুল বয়েল বা ভারী সেদ্ধ পছন্দ করেন। কেউবা হাফবয়েল বা হালকা সেদ্ধ চান। তাঁরা কুসুমটা যেন মাখনের মতো জিহ্বার স্পর্শ পায়, তেমন করে খাওয়া পছন্দ করেন। ডিমের আরও রেসিপি পেতে ইউটিউবে সার্চ দিন।

তবে যেভাবেই খান না কেন, পরীক্ষার খাতায় যে ডিম পাওয়া যায়, তা খাওয়া যায় না! অনেক মাল্টিট্যালেন্টেড ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার খাতায় এ বস্তু পেয়ে থাকেন, বিশেষ করে অঙ্ক পরীক্ষায়!

৩.

বাজারে ডিমের আকার যা-ই হোক না কেন, হালি ওই ৪৮ টাকাই। গঞ্জের বাজারে ডিম কিনতে গেলেন ছয় ফুটের ওপর লম্বা এক লোক। এক কোনায় ঝুড়ি নিয়ে বসেছেন ডিমওয়ালা। ভদ্রলোক ডিমওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
ভদ্রলোক: ডিমের হালি কত টাকা, ভাই?
ডিমওয়ালা: জি, হালি ৫০ টাকা। তবে আপনার জন্য দুই টাকা কম।
ভদ্রলোক: বলেন কী! এত ছোট ছোট ডিম ৫০ টাকা! একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
ডিমওয়ালা: স্যার, অত উঁচু থেকে দেখলে তো ছোটই মনে হইব। একটু বইসা দেখেন।

আকারের ওপর যেমন দাম ততটা নির্ভর করে না, তেমনি এর বহুমুখী ব্যবহারেও আকার কোনো ফ্যাক্টর নয়। বলা হয়ে থাকে, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদকালে ‘ডিম থেরাপি’ একটি উত্তম পদ্ধতি। একটি গরম সেদ্ধ ডিম শরীরের বিশেষ স্থানে স্পর্শ করালেই হলো। যেকোনো নির্দোষ ব্যক্তিও পইপই করে দোষ কবুল করে নেবেন। তবে পদ্ধতি যতই উত্তম হোক, একে সমর্থন করা যায় না।

সভা-সমাবেশে পচা ডিম ছুড়ে প্রতিবাদ জানানোর রীতি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। কে প্রথম এটা আবিষ্কার করেছিলে, জানা যায় না। কনসার্টে শিল্পীর গান শুনে টিকিটের পয়সা উশুল না হলেও বস্তুটি মঞ্চ অভিমুখে ছুড়ে মারা হয়। তবে সে ক্ষেত্রে লক্ষ্য শিল্পী না হয়ে আয়োজকদের কেউ হলে তা যুক্তিসংগত হয়।

আরও পড়ুন

৪.

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয় বিশ্ব ডিম দিবস। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন বা আইইসি। সংস্থাটির উদ্যোগে ওই বছর থেকেই ডিম দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, সুস্থ থাকার জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে ৫০টি।

যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে সামনে এ সংখ্যা আরও কমবে। কেবল তা-ই নয়, দাম বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের ডিমান্ড বাড়াতে মুরগি বোধ হয় কম ডিম পাড়ছে। একটা লেখা পড়ছিলাম। তাতে একজন উৎপাদনকারী বলছেন, তাঁর খামারের মুরগিগুলো মনে হয় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ‘দুটি ডিমের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’—এই নীতিতে তারা ডিম পাড়ে। এতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে তাঁকে বেগ পেতে হচ্ছে।

৫.

বিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম স্রষ্টা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, আজকের একটি ডিম কালকের একটি মুরগির চেয়ে অধিক উত্তম। গভীর কথাটি যদি হালকা করে ব্যাখ্যা করি, তাহলে বলতে হবে, গরিবের জন্য এখনো ডিমই শ্রেষ্ঠ। এক কেজি বয়লার মুরগির দাম ২৩০ থেকে ২৩৫ টাকা। এর সঙ্গে আলু দিয়ে ঝোল করলে পাঁচজনের পরিবারে তা একবেলার বেশি যাওয়ার কথা নয়। সে তুলনায় পাঁচটি ডিম কিনে একই ধরনের ব্যঞ্জন রাঁধলে সাধারণ পরিবারের ওই একবেলা চলে যায় ভালোমতোই।
তাই এ জায়গা থেকেও বলা যেতে পারে, মুরগি থেকে ডিম অধিক উত্তম!

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখায় ব্যবহৃত কৌতুকগুলো মৌলিক নয়। অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত ও ঈষৎ কাস্টমাইজড)

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    [email protected]