সন্তান কীভাবে মানুষ করতে হবে, সে সিদ্ধান্ত কে নেবে?

মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে ছবির ট্রেইলারে রানীর চরিত্রটির মুখে আমরা শুনি, ‘আমি জানি না আমি ভালো মা না আমি খারাপ মা, তবে আমি একজন মা’।
ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় অভিনেত্রী রানী মুখার্জির নতুন সিনেমা মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে বেশ সাড়া ফেলেছে সামাজিক মাধ্যমে। নানা কারণেই সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এ সিনেমা যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয় তা হলো, সন্তান কীভাবে মানুষ করতে হবে, এ সিদ্ধান্ত কে নেবে? সিনেমাটি একটি সত্যি ঘটনানির্ভর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নতুন জীবন গড়তে নরওয়েতে পাড়ি জমায় চ্যাটার্জি পরিবার। নরওয়েতে বাঙালি মায়ের সন্তান পালনের রীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই তাঁর দুগ্ধপোষ্য মেয়েসন্তানকে ও কিন্ডারগার্টেনে পড়ুয়া ছেলেসন্তানকে জিম্মায় নেয় নরওয়েজিয়ান চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিস। কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে অসহায় মা নিজ রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হন।

২০১১ সালে এ ঘটনা ঘটে সাগরিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁর দুই সন্তান অভিজ্ঞান ও ঐশ্বরিয়াকে ফস্টার কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয়, তাঁদের সন্তান প্রতিপালনের সক্ষমতা নিয়ে কর্তৃপক্ষ সন্দিহান। এ ছাড়া আর কোনো যুক্তি দেওয়া হয়নি কিংবা অভিভাবকদের কোনো অনুমতিও নেওয়া হয়নি। সেদিন তাঁদের কেস ওয়ার্কার নিয়মিত পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাঁর সামনে সাগরিকা স্বামী অনুরূপের সঙ্গে একটু বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন। সাগরিকা অনুযোগ করছিলেন, অনুরূপ কেন খাবার টেবিল গোছাতে তাঁকে সাহায্য করেন না। কেস ওয়ার্কার তাঁদের বলেন, আপনারা ঝগড়া মেটান, আমি ঐশ্বরিয়াকে নিয়ে হেঁটে আসি। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর আরেক সহকর্মী অভিজ্ঞানকে কিন্ডারগার্টেন থেকে তুলে নেন।

আরও পড়ুন
উন্নত দেশগুলো বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ—এমন নানা কথা বললেও দেশীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য প্রবাসীদের ভিন্ন করে রাখে। এমনকি সাগরিকার মতো সন্তান প্রতিপালনে ‘অক্ষম’ও করে তোলে। সবাই হয়তো সন্তান হারানোর মতো দুর্যোগের মুখোমুখি হন না, তবে তাঁদের আত্তীকরণের এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাঁদের প্রথমেই মেনে নিতে হয় যে ব্যবস্থার মধ্যে আছেন, তার সবকিছুই সঠিক আর সেটাই মেনে নিতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনে মায়ের আদরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বাবার শাসনকে রাখতে হবে কড়া শাসনে।

নরওয়ের আইনে দেশটির চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিসকে আদালতের অনুমোদন ছাড়াই যেকোনো শিশুকে জিম্মায় নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদি কেস ওয়ার্কার মনে করেন শিশু কোনো ধরনের ‘ঝুঁকি’তে রয়েছে, তাঁরা এই ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন। কয়েক মাস পর যখন বিষয়টি আদালতে ওঠে, তখন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিস সাগরিকা-অনুরূপের সন্তান প্রতিপালনের ধরন নিয়ে নানা উদ্বেগ জানায়। এর মধ্যে ছিল, তাঁরা শিশুদের হাত দিয়ে খাবার খাওয়ান; অভিজ্ঞান যখন খাবার ছুড়ে ফেলছিল, তখন সাগরিকে চড় দেওয়ার ভঙ্গি করেছিলেন এবং ডায়াপার পাল্টানোর সময় ঐশ্বরিয়াকে একা রেখেছিলেন।

২০২১ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৩৮টি শিশু, যাদের বয়স ১৭ বছর পর্যন্ত ফস্টার কেয়ারে বেড়ে উঠছিল। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৫৮১ শিশু প্রবাসী পরিবার থেকে এসেছে। সম্প্রতি আরেক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেন ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বাঙালি পরিবারগুলো এসব বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন। এক আড্ডায় একজন বললেন, বাংলাদেশের এক দূতাবাসকর্মীর সন্তান স্কুলে তার মন খারাপ বলায় সোশ্যাল সার্ভিস তাকে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। বেশির ভাগ প্রবাসী পরিবারই সন্তানের সুরক্ষা ও উন্নত জীবনের কথা ভেবেই বিদেশে যান। সেই সন্তানকে যাতে রাষ্ট্র কেড়ে না নেয়, সে জন্য সব সময় তাঁদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে কি?

আবার সাগরিকার গল্পে ফেরা যাক। দীর্ঘদিনের প্রচারণা, প্রতিবাদের পর নিজ দেশ ভারতের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে তিনি সন্তানদের ফেরত পান। তবে তাঁর নরওয়েতে থাকা হয়নি। যদিও স্বামী অনুরূপ এই যুদ্ধে তাঁর পাশে না থেকে নরওয়ের নাগরিকত্বকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

উন্নত দেশগুলো বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ—এমন নানা কথা বললেও দেশীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য প্রবাসীদের ভিন্ন করে রাখে। এমনকি সাগরিকার মতো সন্তান প্রতিপালনে ‘অক্ষম’ও করে তোলে। সবাই হয়তো সন্তান হারানোর মতো দুর্যোগের মুখোমুখি হন না, তবে তাঁদের আত্তীকরণের এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাঁদের প্রথমেই মেনে নিতে হয় যে ব্যবস্থার মধ্যে আছেন, তার সবকিছুই সঠিক আর সেটাই মেনে নিতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনে মায়ের আদরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বাবার শাসনকে রাখতে হবে কড়া শাসনে।

শিশুদের সুরক্ষায় নজরদারি ও জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই রয়েছে এবং সে দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনের পথটি তো সহজ নয়। মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে ছবির ট্রেইলারে রানীর চরিত্রটির মুখে আমরা শুনি, ‘আমি জানি না আমি ভালো মা না আমি খারাপ মা, তবে আমি একজন মা’।

কোনো মায়ের কাছে সন্তান থাকতে পারবে কি পারবে না—তা কোন নির্ধারণের নিক্তি আসলে কী? আর তা নির্ধারণ করা কি আদৌ সম্ভব?

  • নাজিয়া আফরিন প্রথম আলোর ভিডিও বিভাগের হেড অব নিউজ।

আরও পড়ুন