এ বিষয়ে দ্বিমত করার খুব বেশি সুযোগ নেই, বাংলাদেশ একটি ‘ঘটনাবহুল’ দেশ। একটা ঘটনা বা ইস্যু শেষ না হতেই নতুন কিছুর আগমন ঘটছে। এর ফলে অনেক সময় বিষয়গুলো ঠিকমতো বুঝে ওঠার ফুরসতও পাওয়া যায় না। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টে এমন কিছু ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে, যার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু এ ঘটনাগুলোর ঘাত-অভিঘাত, ফলাফল বা তাৎপর্য নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
১২ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আদালত অবমাননার অভিযোগে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সোহেল রানাকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। তিন ঘণ্টা পর একই বেঞ্চ তাঁকে ৩০ দিনের জামিন দেন। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন তিনি। বিকেল পাঁচটার পর আবেদনের শুনানি নিয়ে চেম্বার আদালত তাঁর কারাদণ্ড ও জরিমানার রায় স্থগিতের আদেশ দেন। (প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর ২০২৩)
এভাবে ‘সকালে সাজা, দুপুরে জামিন ও বিকেলে রায় স্থগিত’ করার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, কীভাবে এত অস্বাভাবিক দ্রুততায় আদালতের সিদ্ধান্তগুলো পরিবর্তিত হলো? স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কি এগুলো ঘটা সম্ভব ছিল? অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা না হয়ে কোনো সাধারণ মানুষ হলে এমনটা ঘটত?
যা–ই হোক, আদালতের আদেশ শিরোধার্য। তাই এটা নিয়ে বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এ ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ওই ঘটনার সূত্র ধরে সেদিনই অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংগঠন জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে জানানো হয়, রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাঁরা মন্ত্রীকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে অধস্তন আদালতের বিচারকেরা সংক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন।
অতীতের নানা ঘটনা তুলে ধরে বিচারকেরা বৈঠকে আইনমন্ত্রীকে বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে র্যাব-পুলিশ ও নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি।…প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা আদালত অবমাননা করলে ক্ষমা চাওয়ার পর তা মঞ্জুর করা হয়েছে। অথচ সামান্য অপরাধে একজন বিচারক ক্ষমা চাওয়ার পরও তাঁকে জেলে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হলো। (কালবেলা, ১৪ অক্টোবর ২০২৩)
‘বিচার বিভাগ স্বাধীন’, ‘আইন নিজস্ব গতিতে চলে’ কিংবা ‘আইন সবার জন্য সমান’—এ কথাগুলো আমাদের দেশে অনেকটা ‘বাতকা বাত’ বা কথার কথা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী এ কথাগুলো ব্যবহার করে থাকে। বাস্তবে এগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের এই বক্তব্যগুলো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কারণ, এটা সত্যি যে পুলিশ ও প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা এবং সরকারি দলের সমর্থক অনেক আইনজীবী নেতা ক্ষমা প্রার্থনা করেই আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছেন। তাহলে নিম্ন আদালতের বিচারকেরাও কেন একই রকম সুযোগ পাবেন না? ‘একযাত্রায় পৃথক ফল’ তাঁরা কেন মেনে নেবেন?
বৈঠকে উপস্থিত বিচারকেরা আইনমন্ত্রীকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আমাদের অভিভাবক। আমরা বিচার বিভাগের সদস্য। সংবিধান ও আইনের আলোকে বিচারকাজ করাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করে সংশোধনের সুযোগ দেবেন, সেটাই প্রত্যাশা করি। (যুগান্তর, ১৪ অক্টোবর ২০২৩)
নিম্ন আদালতের বিচারকদের এ প্রত্যাশাকেও অযৌক্তিক বলা যাবে না। কারণ, ভুলভ্রান্তি একটি মানবীয় ব্যাপার। বিচারক হলেই কেউ সেগুলো থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থাকবেন—এটা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিচারকেরা তাঁদের সংক্ষুব্ধ হওয়া এবং প্রত্যাশার বিষয়টি কেন আইনমন্ত্রীকে জানালেন? বিচারকদেরই বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁরা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং তাঁদের অভিভাবক হলেন সুপ্রিম কোর্ট। সে ক্ষেত্রে তাঁরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারতেন। সেটা না করে তাঁরা গেলেন আইনমন্ত্রী অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের কাছে। এটা কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে ধারণা, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
এ ঘটনা থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হলো, বিচারকেরা যথেষ্ট ‘বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন’। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, কার কাছে গেলে বা কাকে বললে কাজ হবে। বিচার বিভাগে দ্বৈতশাসন চলছে এবং নিম্ন আদালতগুলো অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হয় নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয় দ্বারা—এটা তাঁরা নিজেদের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বেশ ভালোভাবেই জানেন। তাহলে ‘বিচার বিভাগ স্বাধীন’—এমন কথায় তাঁরা কেন ভরসা করবেন?
‘বিচার বিভাগ স্বাধীন’, ‘আইন নিজস্ব গতিতে চলে’ কিংবা ‘আইন সবার জন্য সমান’—এ কথাগুলো আমাদের দেশে অনেকটা ‘বাতকা বাত’ বা কথার কথা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী এ কথাগুলো ব্যবহার করে থাকে। বাস্তবে এগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন ঘটনা বা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সে প্রশ্নগুলো বারবার আমাদের সামনে এসে হাজির হয়; আমরা সংক্ষুব্ধ হই, মর্মাহত হই। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
পুনশ্চ: ‘সকালে সাজা, দুপুরে জামিন ও বিকেলে রায় স্থগিত’ করার ঘটনাটি ঘটেছে ১২ অক্টোবর। একই দিন আপিল বিভাগ আদালত অবমাননার দায়ে দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে। জাহাঙ্গীরকে অবিলম্বে দিনাজপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে গত ২৪ আগস্ট আদালতে হাজির হয়ে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাঁর সেই ক্ষমাপ্রার্থনায় আদালত সন্তুষ্ট হননি। উল্লেখ্য, দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র বিরোধী দল বিএনপির একজন নেতা।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক