‘খেলা হবে’—এই খেলায় মাশুল দিতে হবে কাকে?

‘খেলা হবে’ স্লোগানটির স্রষ্টা সংসদ সদস্য শামীম ওসমান হলেও আমজনতার কাছে জনপ্রিয় করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অপর দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে স্লোগানটি জনপ্রিয় করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের যুব নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য। তিনি রীতিমতো গান বাঁধিয়ে ফেলেছেন। কেবল তা–ই নয়, ‘খেলা হবে’র প্রথম পার্ট বিপুল জনপ্রিয় হওয়ায় এবার তিনি পার্ট টু সামনে আনছেন।

কেবল বাঙালিরা নয়, খবরে জানা যাচ্ছে, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি থেকে যে তাবড় তাবড় বিজেপি নেতা কলকাতায় প্রচারে যাচ্ছেন, তাঁদের মুখেও শোনা যাচ্ছে ‘খেলা হবে’ স্লোগান। কেবল উচ্চারণে কিছুটা গলদ থাকছে। তবে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, কারণ মানুষ হাততালি দিচ্ছে! বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ত্রিপুরা, এমনকি আসামেও ‘খেলা হবে’ স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে।

জনপ্রিয় ও মজার স্লোগানগুলোর শক্তি অসীম। কোটি টাকা খরচা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে, লাখো প্রচারপত্র ছাপিয়ে যে কাজ হয় না, একটিমাত্র স্লোগানে তা হতে পারে। একটি স্লোগানেই বড় কোনো মতবাদ, তত্ত্ব, আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হতে পারে। একটি স্লোগানের বার্তা বিরাট চিৎকার দিয়ে পৌঁছে যেতে পারে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ‘খেলা হবে’ স্লোগানটি নিয়ে তাঁর একধরনের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এটি একটি সস্তা স্লোগান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই স্লোগান এত বেশি দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক স্লোগান। তিনি দিয়ে যাবেন। যাঁর পছন্দ হয় না, তিনি দেবেন না! এ নিয়ে এত কথার কী আছে!

সাম্প্রতিক সময়ে অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলীয় কোনো জনসভায় দাঁড়িয়ে হাত তুললেই জনতা সমস্বরে বলতে থাকে, ‘খেলা হবে।’ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এখন বক্তৃতা শুরু করবেন এবং ‘খেলা’ শুরু হবে!

তবে ওবায়দুল কাদের ছাড়া আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা সাধারণত স্লোগানটি ততটা ব্যবহার করেন না। এমনকি এর ‘জনক’ শামীম ওসমানের মুখেও এখন ততটা শোনা যায় না। আর বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা অন্য দলগুলোর নেতাদেরও ‘খেলা হবে’তে কিছুটা অরুচি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

জনপ্রিয় ও মজার স্লোগানগুলোর শক্তি অসীম। কোটি টাকা খরচা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে, লাখো প্রচারপত্র ছাপিয়ে যে কাজ হয় না, একটিমাত্র স্লোগানে তা হতে পারে। একটি স্লোগানেই বড় কোনো মতবাদ, তত্ত্ব, আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হতে পারে। একটি স্লোগানের বার্তা বিরাট চিৎকার দিয়ে পৌঁছে যেতে পারে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে।

এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে ‘খেলা হবে’, স্লোগানটি একই সঙ্গে জনপ্রিয়, মজার, আনন্দদায়ী ও কৌতুকপূর্ণ। বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ রকম জনপ্রিয় ও মজার স্লোগান এসেছে। বিশেষ করে আন্দোলনে, সংগ্রামে স্লোগানের ভূমিকা বিরাট। বাংলাদেশে বিভিন্ন নির্বাচনে, কি জাতীয়, কি স্থানীয়—সব নির্বাচনেই নানা ধরনের স্লোগানের ব্যবহার রয়েছে। এসব স্লোগানের বড় অংশটিই চমকপ্রদ ও রসোত্তীর্ণ। আবার কিছু স্লোগানকে একটু বড় করে গান বানানোর প্রচলনও রয়েছে।

২.

এবার কয়েকটি মজার স্লোগানের ওপর আলোকপাত করা যাক, যেগুলো গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে ব্যবহৃত হতো। জনপ্রিয় ও মজার সেসব স্লোগান আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো সেভাবে শোনেনি।

ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির এক দশকের মাথায় দেশজুড়ে তীব্র খাদ্যাভাব হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট তীব্র আন্দোলনে নামে সাধারণ মানুষ। পুলিশ চালায় গুলি, নিহত হয় ৮০ জনের মতো। তখন একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার এক শ বারো।’ ওই সময়েরই আরেকটি স্লোগান, ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না/ তা হবে না, তা হবে না।’

পশ্চিমবঙ্গে তখনকার কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন (১৯৬২-১৯৬৭) দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত পরামর্শ, ‘হয় কম খাও, নয় গম খাও।’ তিনি গমের সঙ্গে আলু, কাঁচকলা, বেগুনের মতো আনাজপাতি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় কি না জানি না, বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের আমলে এসেছিল সেই জনপ্রিয় স্লোগান, ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান।’ তবে একে জনপ্রিয় করেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন।

আরও পড়ুন

কেবল এরশাদ নয়, পরবর্তী শাসকদের মধ্যেও বিষয়টি প্রবাহিত হয়েছিল, যা এখনো চলমান আছে। এখন মানুষ অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করলেও তখন করত না। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকেও আক্রমণাত্মক জবাব দিয়েছিল জনতা, ‘বাজার থেকে বেগুন কিনে/ মনটা হলো প্রফুল্ল/ ঘরে এসে দেখি/ এ তো কানা অতুল্য’। (তখন অতুল্ল ঘোষ নামে কংগ্রেসের এক নেতা ছিলেন, কারাগারের মধ্যেই এক ইংরেজ অফিসারের লাঠির আঘাতে যাঁর এক চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।)

গত শতকের ৭০–এর দশক। ভিয়েতনাম যুদ্ধকে ঘিরে দুনিয়া তখন উত্তাল। কমিউনিস্টদের মুখে তখন স্লোগান, ‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’ টিপ্পনী কাটতে সময় নেননি বিরোধীরা। তাঁদের জবাব, ‘বলতে বলতে ভিয়েতনাম/ভুলে গেছে বাপের নাম।’

ওই দশকের শুরুর দিকে একবার নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইয়ের জোট হলো। সিপিআই বাদে অন্য বামপন্থী দলগুলো তা মানল না। শহরের দেয়ালে দেয়ালে তারা স্লোগান তুলল, ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের একটি নির্বাচনে দুই প্রার্থীর মার্কা হাতি ও কমলা। হাতিবিরোধীরা স্লোগান বানালেন, ‘আসছে ধেয়ে বনের হাতি/পিষ্ট হবে দেশ ও জাতি।’ হাতির পক্ষের লোকেরা বসে থাকেন কী করে! তাঁরা জবাব দিলেন, ‘আসছে রে ভাই দুর্দিন/কমলাতে ফরমালিন।’

৩. 

মজার স্লোগানের ফিরিস্তি এখানেই শেষ হোক। ফিরে আসা যাক ‘খেলা’য়। তবে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া সাধারণ মানুষ ঠিক খেলার মধ্যে নেই। প্রাত্যহিক রোজনামচায় জীবনযাপনের লড়াইয়ের পাশাপাশি চারদিকে এত নেতিবাচকতা, এর ওপর সামনে আরও কী হবে, তা ভেবেই পেরেশান তাঁরা। মানুষের পক্ষে, সুদিনের পক্ষে কোনো খেলা হবে বলে মনে হচ্ছে না। এমনিতেই রাজনীতিতে এখন উত্তাপ। এই উত্তাপ সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে রূপ নিতে পারে। রাজনীতিবিদদের ‘খেলা’য় সাধারণ মানুষ যেন বিপন্ন না হয়, এ টুকুই কামনা।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক।
    [email protected]