বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিসংকট নিয়ে আমরা ভাবছি কি

‘বরেন্দ্র এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত সেচের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে।’ছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় আমরা বেশির ভাগ সময় উপকূলীয় অঞ্চলের কথা বলে থাকি। কিন্তু বরেন্দ্র এলাকায় যে ক্রমাগত পানির দুষ্প্রাপ্যতা বেড়ে চলেছে, তা খুব কমই আলোচনায় আসে।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ—এসব জেলার অংশবিশেষ নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল।

বরেন্দ্র এলাকার মাটি শুষ্ক প্রকৃতির এবং এখানে বিশুদ্ধ পানির চরম ঘাটতি রয়েছে। জলবায়ুগতভাবে এই অঞ্চল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, প্রখর তাপপ্রবাহ, তীব্র ঠান্ডা, স্বল্প বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মতো নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় (২০৩০-২০৫০) বাংলাদেশের যে আটটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, বরেন্দ্র অঞ্চল তার অন্যতম। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালে দুর্যোগজনিত এই এলাকায় গড় ক্ষয়ক্ষতি ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন টাকা, যার পেছনে জলবায়ুর পরিবর্তন অন্যতম মূল কারণ। এই অঞ্চলে পানিঘাটতির জন্য মানুষের জীবন ও জীবিকা নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চল প্রায় একুশ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এখানকার মাটির শোষণ ও আর্দ্রতার ধারণক্ষমতা কম। যে কারণে এই অঞ্চলের বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে সহজে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির পূর্ণভরণ করতে পারে না। পাশাপাশি এখানে বৃষ্টির পরিমাণ অনেক কম ও তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় এই অঞ্চল খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টির ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। এই অঞ্চলে সারা বছরের বৃষ্টির পরিমাণে খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও বছরের বৃষ্টির মোট দিনের সংখ্যা কমেছে। শুষ্ক মৌসুম দিন দিন আরও বেশি শুষ্ক হয়ে উঠছে, যা ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কৃষি খাত ও দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহৃত পানির চাহিদা মেটাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বহুদিন ধরেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে আসছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি খরা, বন্যা, বজ্রপাত ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে এই এলাকার কৃষি খাত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

বরেন্দ্র এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত সেচের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে। সেচের নলকূপ চালু থাকলে খাওয়ার পানির জন্য ব্যবহৃত নলকূপগুলো কার্যকর থাকে না। খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের তাই অনেক দূরে যেতে হয়, যেখানে সাবমারসিবল পাম্প, সেচের জন্য গভীর নলকূপ বা তেমন কোনো ব্যবস্থা আছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৮৫ সাল থেকে এই এলাকায় সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। পাশাপাশি বেশ কিছু ব্যক্তি উদ্যোক্তা এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে বছরব্যাপী ফসলি জমিতে সেচের জন্য পানি উত্তোলনের পরিমাণ পূর্ণভরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্প যথেষ্ট পানি উত্তোলন করলেও তারা কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে, সেই তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। সরকারি পর্যায়ে দেশের সব জায়গায়, বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির নিয়মিত মনিটরিং করে তার ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিত করা অবশ্যকরণীয়।

বরেন্দ্র এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত সেচের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে। সেচের নলকূপ চালু থাকলে খাওয়ার পানির জন্য ব্যবহৃত নলকূপগুলো কার্যকর থাকে না। খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের তাই অনেক দূরে যেতে হয়, যেখানে সাবমারসিবল পাম্প, সেচের জন্য গভীর নলকূপ বা তেমন কোনো ব্যবস্থা আছে।

পানিসংকটের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি পানি সংগ্রহ করতে ব্যস্ত থাকায় নারীরা অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত হতে পারেন না। বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারীরা, যাঁরা সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, পানি সংগ্রহের জন্য তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছেন। যদি বরেন্দ্র এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পানির যথাযথ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ কখনো সময়মতো অর্জন করতে পারব না।

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিঘাটতির নানামুখী সমস্যা মোকাবিলার জন্য সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা অপরিহার্য। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য পানির বিকল্প উৎস, যেমন নদী-নালা বা পুকুরের পানি যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পানি নীতিমালা ২০১৮ বাস্তবায়নে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। পানি নীতিমালা অনুযায়ী বরেন্দ্রভূমিতে পানির ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

আরও পড়ুন

পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ও জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি নীতিমালা অনুযায়ী, পানির সংকটাপন্ন এলাকায় খাবার পানি সংরক্ষণ করা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। ‘ওয়ারপো’ সূত্রে জানা যায় সাম্প্রতিক কালে প্রায় ৮৭টি ইউনিয়নে পানির চরম সংকট দেখা গেছে। অন্তত এসব ইউনিয়নকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ‘পানির সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি এলাকায় খাবার পানির জন্য পুকুর এবং গৃহস্থালির কাজের জন্য খালের পানি সংরক্ষণ করে অন্তত খাওয়া, রান্না ও গৃহস্থালির কাজের জন্য পানি নিশ্চিত করতে হবে। বরেন্দ্র এলাকায় কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত সেচপদ্ধতির পরিবর্তন এনে সেচ ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে পূনর্ভরণ করার জন্য বৃষ্টির পানি বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভূগর্ভে প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করে তা নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার।

পানির অভাব মেটাতে বিকল্প পানি সংরক্ষণের পদ্ধতির পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দরকার। এই এলাকার মাটির ধরন ও স্বল্প বৃষ্টির কারণে ভবিষ্যতে এখানে তীব্র পানিসংকট দেখা দেবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও বেশি জটিল আকার ধারণ করবে। যেমন পানিসংকট ও দীর্ঘমেয়াদি খরা এই এলাকার ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যার কারণে খাদ্যসংকট তৈরি হবে। তা ছাড়া তীব্র তাপমাত্রায় কৃষকদের এবং বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।

টেকসই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার কৌশল নিয়ে সম্মিলিত আলোচনা করা জরুরি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার, যেমন কৃষক, নীতিনির্ধারক, সিভিল সোসাইটি এবং গবেষকদের সঙ্গে সংলাপপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে থাকলে চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করা এবং কার্যকর সমাধান চিহ্নিত করে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা প্রয়োজন।

প্রায় চার লাখ জনসংখ্যার বরেন্দ্রভূমিতে ভবিষ্যৎ টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ অপরিহার্য।

  • হাসিন জাহান কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ